সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ || ৯ পৌষ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন

গোলাম মোরশেদ, গবেষক

১৭:০৪, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৭:২৫, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

৮৭৪০

শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন

বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্রমাগত হারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। বেকারত্বের হার নিয়ে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন উপাত্ত রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৪.২ শতাংশ (২৭ লাখ) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

গত কয়েক বছরের বাংলাদেশের বেকারত্বের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রতিবছর দেশে কমপক্ষে নতুন ১ লাখ বেকার বাড়ছে। তবে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। অথচ এর মধ্যে স্থায়ীভাবে কাজে ঢুকতে পারছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। 

আর এই বেকারদের মধ্যে শিক্ষিতদের বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অশিক্ষিতদের তুলনায় শিক্ষিতদের বেকারত্ব হার তিন গুণ বেশি। এবং শিক্ষার লেভেল বিবেচনায় উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী। যেমন, নিম্ন মাধ্যমিকের তুলনায় উচ্চ মাধ্যমিক পাশকৃতদের বেকারত্ব প্রায় ৪ গুণ আর স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তরদের মাঝে বেকারত্ব ৩ গুণ বেশি। অর্থাৎ দেশে অল্পশিক্ষিত বেকারের তুলনায় স্নাতক বেকারের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য দেশের শ্রমবাজার তুলনামূলক সংকুচিত।

সুতরাং দেশে বেকারত্ব যে হারে বাড়ছে তার বড় অংশ শিক্ষিত বেকার। এর অন্যতম কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের চাহিদাকে বিবেচনায় না নেয়া। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রমবাজারমুখী না হওয়ায় প্রতিবছর দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

ইউজিসির তথ্য মতে, বাংলাদেশের জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেড় শতাধিক পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। এছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার্থী রয়েছে আরও কয়েক লাখ। কিন্তু দেশের এই শিক্ষা ব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের চাহিদার মাঝে রয়েছে লক্ষণীয় ভারসাম্যহীনতা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, শ্রমবাজারে যেসকল বিষয়ের চাহিদা বেশি আছে তুলনামূলক তাদের যোগান কম। আর যেসকল বিষয়ের চাহিদা তুলনামূলক কম সেসকল বিষয়ের যোগান বেশি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজারে এসব বিষয়ে শিক্ষিতদের জন্য কর্মসংস্থানের বিশেষ ঘাটতি রয়েছে। আবার বাণিজ্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোতে চাহিদা বেশি থাকলেও যোগানের পরিমাণ কম। এছাড়া এমন অনেক বিষয়ে স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে যেগুলোর শ্রমবাজারে কোন বিশেষ চাহিদা নেই বা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অথচ প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এরকম নতুন নতুন বিষয় চালু করার ঘটনা ঘটছে। একারণে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভারসাম্যহীনতার দুষ্ট চক্রে পড়ছে।

কিন্তু এই বেকারত্বের কারণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ নয় বরং শ্রমশক্তির কর্ম দক্ষতার অভাব। শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণের সাথে সমানতালে কর্মদক্ষ হয়ে ওঠছে না। আর একারণেই মূলত এই বিশাল জনশক্তি জনসম্পদে পরিণত হতে পারছেনা। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো শ্রমবাজারের চাহিদা মোতাবেক জনশক্তি তৈরি করতে না পারায় দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দক্ষতা তৈরিতে সক্ষম হতো তাহলে এই ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতো না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তাদের সিলেবাস প্রনয়ণ করছেনা। প্রতিবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থী শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও যথেষ্ট দক্ষতার অভাবে বেকার থাকছে। এই চিত্র যে শুধু সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তা নয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও তাই। চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কিংবা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার পরেও শিক্ষার্থীরা দক্ষতার অভাবে চাকুরী পাচ্ছে না। অথচ দেশের বেশির ভাগ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ শ্রমিকের সংকটে ভুগছে। অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ভাল অংকের বেতন দিয়ে কর্মী নিতে আগ্রহী হলেও চাহিদামত দক্ষ লোকবল পাচ্ছে না। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠগুলোতে পড়াশুনা করার পরেও প্রযুক্তিগত ও ভাষাগত দক্ষতার অভাবে অনেকেই বেকার থেকে যাচ্ছে। দক্ষতার ঘাটতি দেশকে শ্রমশক্তিতে পিছিয়ে দিচ্ছে।

আবার যারা দেশের বাইরে কাজের সুবাদে যাচ্ছে তারাও শুধু দক্ষতার অভাবে তুলনামুলক বেশি বেতনের চাকরির সুযোগ হারাচ্ছে। শুধু ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে না পারার কারণে বিদেশের মাটিতে প্রতিবছর লাখ লাখ শ্রমিক ভাল কাজের সুযোগ হারাচ্ছে।

দেশে বর্তমানে সরকারি পলিটেকনিক্যাল কলেজের সংখ্যা মাত্র ৪৫টি এবং বেসরকারি পলিটেকনিক্যাল কলেজের সংখ্যা আনুমানিক ৪৫০ টি। এবং কারিগরি শিক্ষার হার মাত্র ১৪ শতাংশ যেটাকে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিশ্বের উন্নত দেশেগুলোর কারিগরি শিক্ষার হারের মধ্যে অন্যতম জার্মান ৭৩%, জাপান ৬৬%, সিঙ্গাপুর ৬৫%, অস্ট্রেলিয়া ৬০%, চীন ৫৫%, দক্ষিণ কোরিয়া ৫০%, এবং মালয়েশিয়া ৪৬%। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধি প্রয়োজন। দেশের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী বেকার থাকা সত্ত্বেও শুধু দক্ষতার অভাবে লাখ লাখ বিদেশী বাংলাদেশ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। দেশের জনশক্তি দক্ষতার চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য দেশের বাইরে থেকে শ্রমশক্তি আমদানী করতে বাধ্য হচ্ছে। 

দেশের চাকরির প্রস্তুতি পর্ব ও পড়াশুনার ধরণ একাডেমিক পড়াশুনা থেকে অনেকাংশেই আলাদা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে শ্রমবাজারের এরূপ ভারসাম্যহীনতার কারণে বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক পড়াশুনার তুলনায় চাকুরীর পড়াশুনায় বেশি মনোযোগী। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কেন্দ্রীয় পাঠাগারে গেলে দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশুনার পরিবর্তে চাকুরীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকাল বেলা পাঠাগারের সামনে বিশাল লাইন দেখে মনে হতে পারে আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনায় এত মনোযোগী? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে, তাঁরা প্রত্যেকে হাতে চাকুরীর প্রস্তুতির বই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর কারণ যেহেতু শিক্ষার্থীরা মনে করছে যে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে কর্মক্ষেত্রের সামঞ্জস্য নেই তাই স্নাতক পর্বের শুরুতেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চাকুরীর পড়াশুনার প্রতি ঝুঁকছে। 

তাই দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষত সিলেবাসকে শ্রমবাজারের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ইন্টার্নশীপের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কম চাহিদা সম্পন্ন বিষয়ের তুলনায় শ্রমবাজারে বেশি চাহিদা সম্পন্ন বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সদ্বিচ্ছার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি আরো সচেতন হতে হবে। বিশ্বের চাহিদা বিবেচনায় প্রতিটা শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা এবং প্রযুক্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের তাত্ত্বিক শিক্ষাকে বাস্তবতার সাথে একীভূত করে প্রায়োগিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। দেশের সরকারী চাকুরীর পাশাপাশি বেসরকারী চাকুরীকেও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ ও মান আরো দুটোই উন্নত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিদেশী ভাষা শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানীর ক্ষেত্রেও তাদের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশের বেকারত্ব হ্রাস করতে শিক্ষার হার বৃদ্ধির তুলনায় দক্ষতা সৃষ্টির প্রতি জোরারোপ করতে হবে।

গোলাম মোরশেদ: গবেষক ও কলামিস্ট, পিজ্যান্ট এ্যান্ড লেবার ডিভিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট। লেখকের গবেষণার আগ্রহের বিষয়সমূহ হলো শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব, শ্রমবাজার, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইত্যাদি। ইমেইলঃ [email protected] 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank