মতিঝিলে এক ব্যতিক্রমী রফিক
মতিঝিলে এক ব্যতিক্রমী রফিক
ঢাকার ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। এখানে মানুষ শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এ ছুটে চলা জীবিকার জন্য। এ ছুটে চলা জীবনের জন্য। বড় বড় অফিস, ব্যাংক-বীমা ইত্যাদির আকাশচুম্বী ভবন। সে সবের লাখো কর্মী। বড় বড় কর্মকর্তা। তাদের আনা-নেওয়া করা শত শত গাড়ি। দীর্ঘ গাড়ির লাইন। এসবেরই ভিতর দিয়ে শত শত পথচারির রুদ্ধশ্বাস পথচলা। তারই মাঝখানে ফুটপাতে হকারের পসরা সাজিয়ে হরেক রকম ব্যবসা। কান ঝালাপালা করে তোলা মজমাতো জমেই থাকে এখানে ওখানে। সব মিলিয়ে দিনের মতিঝিল এক সদা ব্যস্ততা আর শোরগোলের স্থান।
এই মতিঝিলে সেই অসংখ্য মানুষের একজন মো. রফিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার একটি ছবি ঘুরছে। বাহবাও পাচ্ছেন বেশ। মো. রফিকের কথা শুনতে অপরাজেয় বাংলা যায় মতিঝিলে।
শতশত গাড়ি, যানজট আর মানুষের জট পার হয়ে মতিঝিলের দিলকুশায় রফিককে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। একজন সিকিউরিটি গার্ডকে ছবি দেখালে বললেন, "তারেতো এখন সবাই চেনে। সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সামনে চলে যান পাওয়া যাবে।"
সাধারণ বীমা কর্পরোশনের ঠিক সামনে শত শত গাড়ি পার্ক করা। তারই মাঝে একটি গাড়িতে চোখ আটকে গেল। বুঝা গেল এটাই মো. রফিকের গাড়ি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছুই 'ফেক' আসে। কিন্তু রফিককে নিয়ে দেওয়া তথ্য শতভাগ সঠিক।
দেখা গেলো একটি সাদা গাড়ির সামনের অংশ নীল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। আর পেছনের খোলা অংশে হ্যাংগারে ঝুলানো ছোটদের জামা-কাপড়। পথচারীরা দাঁড়িয়ে গাড়ির পেছনে ঝুলানো কাপড়গুলো নেড়ে-চেড়ে দেখছেন। কারো পছন্দ হলে দাম-দর করে কিনেও নিয়ে যাচ্ছেন।
এটাই রফিকের এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।
পার্কিংয়ে যে গাড়ির পেছনের অংশে নানা বর্ণ ও সাইজের কাপড় সাজিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে এই গাড়িররই চালক মো. রফিক। এই গাড়িটির মালিক মতিঝিলের কোনো একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা। মালিককে প্রতিদিন সকালে মতিঝিলে অফিসে নিয়ে আসতে হয় রফিককে। আর অফিস শেষে বাসায় নিয়ে যেতে হয়। এর মাঝের পুরো সময় গাড়ি ফুটপাতের পাশে পার্কিংয়ে থাকে। রফিক অলস সময় না কাটিয়ে মালিকের অনুমতি নিয়ে গাড়ির পিছনের ডালা তুলে বক্সে ছোটদের কাপড় সাজিয়ে রাখেন। কম দামে সেগুলো বিক্রি করেন। মতিঝিলে হাজারো লোকের সমাগম হয় এখানে। সে কারণে বিক্রিও খারাপ নয়। পরে অফিস টাইম শেষ হলে, জামা কাপড় গাড়ির পেছনে গুছিয়ে রেখে মালিককে নিয়ে বাসায় চলে যান।
এই প্রতিবেদক যখন পৌঁছান তখন গাড়ির কাছে একজন দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বললেন, তিনি রফিক নন। তিনি এখানে ফলের ব্যবসা করেন। রফিক গাড়ির ভিতরে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। তাই একটু সামনে দাঁড়িয়েছেন।
দুপুরের খাবার খেয়ে বের হলেন মো. রফিক। পরিচয় পেয়ে হেসে ফেললেন। বললেন, ফেসবুকে তার ছবি কে যেন দিয়েছে। একারণে, লোকজন তাকে চিনতে পারছে।
আপনি পেশায় গাড়ি চালক। গাড়ির পেছনে কাপড় সাজিয়ে রেখে বিক্রি করার অভিনব আইডিয়া কিভাবে এলো? এমন প্রশ্নে রফিক বললেন, "করোনা শুরুর পর মালিককে অফিসে নামিয়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে এই পার্কিংয়েই অপেক্ষা করতে হয়। মনে হলো এভাবে অলস সময় না কাটিয়ে কিছু করা যেতে পারে। কয়েকজন বুদ্ধি দিল। জামা কাপড়ে ব্যবসা করার। পরে গাড়ির মালিকের কাছে অনুমতি নিয়ে কাজটি শুরু করি।
"মালিক উৎসাহও দিয়েছেন, বললেন রফিক। আর জানালেন ছয়মাস ধরে তিনি গাড়ির মালিককে অফিসে নামিয়ে দিয়ে পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে জামা-কাপড় বিক্রি করছেন।
রফিকের বাড়ি শরীয়তপুর । ১৫ বছর ধরে গাড়ি চালান তিনি। ঢাকায় বেশ কয়েকজন মালিকের চাকরি করে বর্তমান মালিকের কাছে কাজ নিয়েছেন ছয়বছর আগে।
মালিক ভাল বলে, যেসময়টা বসে থাকেন, সে সময়টা ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছেন, মত রফিকের।
কথা বলার সময় আশা-পাশে বেশ লোকজন জমা হয়েছে। একজন পাশ থেকে বললেন, রফিক ভাল কাজ করেছে। অলস সময় কাটাননা।
মানুষে নাকি কাজ পায়না ? আর রফিক একসঙ্গে দুইটা কাজ করে, বললেন আরেক জন।
কথা বলার সময়, অনেকেই তাদের মোবাইল ফোনে ছবি তুলছিলেন ।
রফিক বলেন, কোন কাজ ছোটো না। ইচ্ছা আর পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকলে, কেউই বেকার থাকেনা। মানুষের কাছে হাত পাততে হয়না। সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করা যায়।
একসঙ্গে দুই কাজ করছেন, সমস্যা হয়না? প্রশ্নে রফিক বললেন, গাড়ির মালিককে নামিয়ে দিয়েতো বসে থাকতে হয়। সে সময়টা নষ্ট না করে কাজ করছি। আবার আমার মূল কাজ অর্থাৎ গাড়ি চালানো, মালিকের অফিস ছুটি হবার আগেই সব কিছু গুছিয়ে রেখে, মালিকের জন্য অপেক্ষা করি। আমি কোন কাজে ফাঁকি দিইনা। এজন্য সমস্যা হয়না।
রফিক জানালেন, এভাবে পার্কিংয়ে গাড়িতে জামা-কাপড় বিক্রি করে তার মাসে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা আয় হয়।
গাড়ির মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তিনি ভাল মানুষ । এজন্য আমাকে এভাবে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। আসলে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করলে জীবন ধারণ অনেক সহজ হয়।
"এর আগে দুইজন জাতীয় সংসদ সদস্যের গাড়ি চালিয়েছি। কোন দিন কোন অবৈধ কাজে জড়িত হইনি। সৎ পথে আছি বলেই , ভাল আছি, গর্বের উচ্চারণ রফিকের।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ক্রেতারা আসছিলেন। বিক্রিও হচ্ছিলো। ক্রেতাদের অনেকেই রফিকের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের প্রশংসা করছিলেন।
মতিঝিলের হাজার হাজার মানুষের মধ্যে সবাই যে কাজের মধ্যে আছে, বিষয়টা তেমন না। অনেকেই উদ্দেশ্যহীণ, বেকার ঘোরাঘুরি করছেন। অনেককেই দেখা গেলো বগলে ফাইল চেপে চাকরি খুঁজছেন। এক অফিস থেকে আরেক অফিস যাচ্ছেন। শত শত মানুষের মধ্যে মো. রফিকের এই ব্যতিক্রম উদ্যোগ, একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। তার এই কাজ এ বার্তাই দিচ্ছে- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। নিজের হাতের সঠিক ব্যবহার হলে, কারো কাছে হাত পাততে হয়না।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- নর্ড স্ট্রিম ২ কী? কেন এটি নিয়ে এত বিতর্ক? পর্ব ১
- বিশেষ সাক্ষাৎকার
`চিকিৎসা সম্ভব, সমাজে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে কেউ থাকবে না` - চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচায় জীবিত খরগোশ গুনছিলো মৃত্যুর ক্ষণ
- মগবাজারে বিস্ফোরণে অপরাজেয় বাংলার সম্পাদক-নির্বাহী সম্পাদক আহত
- যশোরে মিঠা পানিতে নোনা ট্যাংরার বাণিজ্যিক চাষ
- ১৪১ বছরের পুরনো পাগলা গারদে পাগল হওয়ার দশা!
- পাহাড়ি জঙ্গলে এলাচের বন, সবুজ গুটিতে স্বপ্ন ভাসে ওমর শরীফের
- করোনায় দৃশ্যমান স্বেচ্ছাসেবার শক্তি
- মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর ও মেধাবী, তবে ভারতীয়
কৈশোরেই ব্রিটেনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক বাঙালি নারীর গল্প - স্বচ্ছতা, বিশ্বস্ততা সোনালী লাইফকে পৌঁছে দিয়েছে নতুন উচ্চতায়: রাশেদ আমান