শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

করোনায় দৃশ্যমান স্বেচ্ছাসেবার শক্তি

আতিক উল্লাহ

১৫:৩৭, ৩ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৬:৪০, ৩ জানুয়ারি ২০২১

৪৩৬২

করোনায় দৃশ্যমান স্বেচ্ছাসেবার শক্তি

সঙ্কট আর দৈব-দুর্বিপাকে বিত্তবানরা এগিয়ে আসবেন সহায়তা নিয়ে। আর একঝাঁক স্বেচ্ছাসেবী সঙ্কট ও ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বিপদসংকুল পরিবেশেও দুর্গতদের পাশে দাঁড়াবে এটাই প্রত্যাশা। চিত্রটি অতীতের বন্যা-খরা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশে অনেক বেশি দৃশ্যমান থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তার কিছুটা অনুপস্থিতিই দেখা গেছে। তবে করোনার অতিমারি যখন বাংলাদেশেও ছোবল মারলো তখন আমরা দেশে ফের দেখতে পেলাম স্বেচ্ছাসেবার শক্তি।

কোভিড-১৯ এর সময় লকডাউনের কারণে অনেক মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষত দিনমজুররা পড়েছেন বেশি বিপাকে। পিকআপ ভ্যানে বাসার জিনিসপত্র নিয়ে ঢাকা ছাড়ার অনেক দৃশ্য ভেসে বেড়িয়েছে সংবাদপত্র থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সরকারি উদ্যোগে কখনই সম্ভব ছিলনা এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে সহায়তা দেয়া। সম্মুখসারির যোদ্ধা হয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করেছেন দুর্গত মানুষের মাঝে গিয়ে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে।

দেশজুড়ে হাজারও সংগঠন কাজ করেছে মহামারিকালে। করোনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে ছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে। কেউ চালু করেছে বিনামূল্যে বাজার, কেউ বা মানুষের পাশাপাশি রাস্তার কুকুরের জন্যও রেখেছে খাবার। এমন মানবিক কাজগুলোকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছে অপরাজেয় বাংলা। 

২৫ লাখ মানুষের পাশে ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন

সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন (ইএসডিও)। মূলত ঠাকুরগাঁও কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে ৪৯ জেলায় পরিচালিত হচ্ছে সংগঠনটির কার্যক্রম। সম্প্রতি ঢাকায় খোলা হয়েছে ইএসডিও এর নিজস্ব অফিসও। 

সূচনাতে ত্রান কার্যক্রম পরিচালিত হলেও বন্যা পরবর্তী পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠী প্রধানত সমাজের সুবিধা বঞ্চিত, বিত্তহীন ও ভুমি হীন মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনিয়তা উপলদ্ধি করে ইএসএসডিও তার কার্যক্রম অব্যহত রাখে। 

কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সংগঠনটির কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। শুধু করোনা পরিস্থিতি ও বন্য মোকাবেলায় ১৪ টি প্রকল্প ছিল ইএসএসডিওর। যেখানে ছিল খাদ্য, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম সরবরাহ, শিশু নিরাপত্তা, ত্রাণ বিতরণ, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ এবং এককালীন অর্থ সহায়তা। যেগুলো থেকে প্রত্যক্ষ সুবিধা পেয়েছেন ১০ লাখ ৭৪ হাজার ৩৬৩ মানুষ। এবং পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছেন ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৪১৩ জন। কার্যক্রমে মোট ব্যয় ছিল ১৬ কোটি ২৪ লাখ ৫১ হাজার ২২৪ টাকা। 

খাদ্য ও কোভিড নিরপত্তা সরঞ্জাম বিতরণ করা হয় ৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬৩ জনের মাঝে। ৪১ হাজার ৭৬১ জনকে দেয়া হয়েছে নগদ অর্থ সহায়তা। এছাড়া বিভিন্ন সরকারী হাসপাতালে দেয়া হয়েছে ৪ হাজার ৪৬ টি পিপিই ও ৫০০ অ্যান্টিভেনম।  

নিজেদের কার্যক্রম প্রসঙ্গে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. শহিদুজ্জামান জানান, ১৯৮৮ সালে বন্যাকবলিত অঞ্চলে মানুষদের সহায়তায় কাজ শুরু করি আমরা। তারপর থেকে যে কোন ধরনের দুর্যোগ ও সামাজিক কাজে মানুষের পাশে থেকেছে ইএসএসডিও। ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় প্রথম দিকে যে সংগঠনগুলো কাজ করেছে তাদের মাঝে আমরাও ছিলাম।

করোনার প্রথমদিকে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। তারপর খাবার, নগদ অর্থ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়েছি সারাদেশে। বৈশ্বিক এই সমস্যা হয়তো ভ্যাকসিন ছড়িয়ে যাওয়ার পর বন্ধ হবে। তবে এর কারণে যত মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের আর্থিক অবস্থা ও জীবনমান উন্নয়নে অনেক সময় লাগবে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা তিন বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।  

বহুমুখী বিদ্যানন্দ ফাউন্ডশেন

দেশের সেচ্ছাসেবী সংগঠনের নাম লিখলে প্রথম দিকেই আসবে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের নাম। আনন্দের মাধ্যমে শেখা, এ মূলমন্ত্র থেকেই সংগঠনটির এমন নামকরণ। পড়বো, খেলবো, শিখবো এ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে কার্যক্রম শুরু করা সংগঠনটি মাত্র সাত বছরেই উঠে আসে আলোচনার শীর্ষে। নানামুখী উদ্ভাবনী প্রকল্প পরিচালনার জন্যই মূলত সংগঠনটির এমন এগিয়ে চলা। করোনাকালেও সংগঠনটি পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষের। এখানেও ছিল বিদ্যানন্দের উদ্ভাবনী সব প্রচেষ্টা। 

কোভিড-১৯ চলাকালীন লকডাউন পরস্থিতিতে শহরের স্বল্প আয়ের হাজার হাজার মানুষের মাঝে রান্না করা খাবারের প্যাকেট সরবরাহ করে বিদ্যানন্দ। বস্তিবাসীসহ বিভিন্ন জায়গার শ্রমিক, রিকশা-গাড়ি চালক, গৃহকর্মী যৌনকর্মী, পাহাড়ী আদিবাসী, বেদে পল্লীতে এসব খাবার বিতরণ করা হয়। 

রান্না করা খাবারের পাশাপাশি অসংখ্য পরিবারকে শুকনো খাবারও সরবরাহ করে বিদ্যানন্দ। প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র শহর পর্যায়ে এমন কার্যক্রম চললেও পরবর্তীতে বেশিরভাগ জেলায় শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। 

প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার পরিবারকে চাল, ময়দা, মসুর ডাল, চিনি, লবণ, মশলা ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। বিদ্যানন্দের এই কার্যক্রমের পাশে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশসহ মোট ৭৩ টি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। 

করোনায় সংগঠনটির আরও একটি কার্যক্রম ছিল বিনামূল্যের বাজার। দেশের প্রতিটি কোণ থেকে হাজার হাজার টন ফসল, শাক-সবজি, মৌসুমী ফল সংগ্রহ করে এনে উন্মুক্ত স্থানে বাজার বসায় বিদ্যানন্দ। যেখানে ছিলনা কোন দোকানদার। বাজার থেকে বিনামূল্যে নিজের প্রয়োজনীয় বাজার নিতে পারতেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এই বাজারের ফলে দুস্থরা যেমন পেয়েছেন খাবার, তেমনি ফসল নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন অসংখ্য কৃষক। 

করোনায় আইসোলশেনে থাকা রোগীদের মৌসুমী তাজা ফল, ভিটামিন সি এর জন্য সাইট্রাস এবং বিভিন্ন শুকনো খাবার প্যাকেট করে উপহার হিসেবে দেয় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। আরোগ্য কামনা করে প্রতি রোগীকে ঝুড়ির সাথে হাতে লেখা একটি শুভচ্ছো র্কাডও দেয়া হয়। অনেক মানুষের অনুরোধের ভিত্তিতে চাকরি ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়া পরিবারের শিশুদের জন্য দুধ ও শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন খাবারও সরবরা করে বিদ্যানন্দ। 

করোনা বিস্তার রোধে ঢাকা ও চট্টগ্রামের হাসপাতাল, বাস স্টেশন, রেল স্টেশন, থানা, লঞ্চ টার্মিনাল এবং বস্তি এলাকা গুলোতে ৮২০ টন স্যানিটাইজার স্প্রে করে সংগঠনটি। এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজারের বেশি পিপিই দেয়ার পাশাপাশি অসংখ্য মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেছে বিদ্যানন্দ। 

করোনা রোগীদের সহজলভ্য চিকিৎসা নিশ্চিতে চট্টগ্রামে ফিল্ড হাসপাতাল নির্মান করে বিদ্যানন্দ। ১০০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে উন্নত খাবার এবং ওষুধের ব্যবস্থা সহ, পুরুষ এবং নারী রোগীর জন্য পৃথক ওয়ার্ড, নন-কোভিড রোগীদের জন্য বহির্বিভাগ ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা ছিল। হাসপাতালে ১২ জন চিকিৎসক, ১৮ জন নার্স ও ৫০ জন সেচ্ছাসেবী কাজ করেছেন। 

 ২০২০ সালের ২১ মে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। যার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপকূলীয় অনেক জেলা। এছাড়াও কয়েকটি জেলায় ছিল বন্যার প্রকোপ। এসব অঞ্চলের মানুষেদের সহায়তায় বিদ্যানন্দ তৈরি করে ভাসমান হাসপাতাল ‘জীবন খেয়া’। বাংলাদশ কোস্টর্গার্ডের তত্ত্বাবধানে মংলা বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে উপকূলে ২১ টি  পয়েন্টে চিকিৎসা দিয়েছে জীবন খেয়া। ১২ জন চিকিৎসকের পাশাপাশি কয়েকজন নার্স, ফার্মাসিস্ট, সেচ্ছাসেবক হাসপাতালটি পরিচালনা করে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০,০০০ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করেছে ‘জীবন খেয়া’।

করোনার পাশাপাশি আম্পানেও ভলেন্টেয়ার ফর বাংলাদেশ

সমাজের অগ্রগতিতে যুবসমাজের ভূমিকাকে অপরিহার্য মনে করে ২০১১ সালে ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’(ভিবিডি) নামক সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলে জাগো ফাউন্ডেশন। প্রথম থেকেই শিশু অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে সংগঠনটি। ২০১৯ সালে ভিবিটিতে কাজ করেছে ২৬ জেলার ৩৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী।    

করোনায় পরিস্থিতি শুরুর কিছুদিন পরই স্বল্প আয়ের মানুষদের পাশে দাঁড়ায় সংগঠনটি। মহামারিতে মৃত্যু ভয়ে মানুষ যখন গৃহবন্দি তখন দ্বারে দ্বারে গিয়ে খাবার পৌঁছে দিয়েছে ভিবিডির সদস্যরা। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুরো দেশের মোট ৫০ হাজার পরিবারকে নিয়মিত খাবার দেয় ভিবিডি। এছাড়াও বিভিন্ন জেলার সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে সহায়তা করেছেন অসংখ্য মানুষকে। 

২১ মে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলো আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। এসময় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ আরও বেশ কিছু জেলাতে। আম্পানের আগে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে সাইক্লোন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া থেকে আবারও বাড়িতে পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় কাজ করেছে ভিবিডির সদস্যরা। তাদেরকে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সরবারহ করেছে সেচ্ছাসেবীরা। সাতক্ষীরায় আম্পানের ঝড়ে অনেক জায়গা ডুবে গেলে প্রতিদিন নৌকা ভাড়া করে মানুষদের কাছে খাবার নিয়ে গেছে তারা।   

এছাড়া নগরের সৌন্দর্য রক্ষায় দারুণ উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা ভিবিটি। প্লাস্টিকের বোতল কেটে সেগুলোতে গাছ লাগিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন দেয়ালে লাগিয়ে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবীরা। যেটাকে বলা হচ্ছে ‘সবুজ দেয়াল’ প্রকল্প। এর আওতায় ইতোমধ্যে পাল্টে গেছে পাঁচলাইশ ও কোতয়ালী থানার চিত্র।  আর কুষ্টিয়াতে ভুট্টা কেটে কৃষকদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে ভিবিডি কুষ্টিয়ার সদস্যরা।

করোনায় মানুষদের সতর্ক করতে নভেম্বরের ১২ তারিখ সারাদেশে অফলাইন ও অনলাইনে কাজ করেছে সংগঠনটির ১০ হাজার তরুণ। এসময় অসংখ্য মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেছে ভিবিডি।  

২০২০ সালে নতুন করে ১৫ জেলায় নিজেদের সেচ্ছাসেবী কমিটি গঠন করেছে ভিবিডি। বর্তমানে তাদের কার্যক্রম চলছে ৪১ জেলায়। ২০২১ সালের শেষে ৬৪ জেলাতেই কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। 

এপ্রসঙ্গে জাগো ফাউন্ডেশনের ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সহকারী ব্যবস্থাপক সৌরভ সাহা জানান, জাগো ফাউন্ডেশনের বড় শক্তি তরুণরা। আমরা তরুণদের নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। এখন পুরো বিশ্ব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনই তরুণদের সামনে এগিয়ে আসা দরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাস ও পরবর্তীতে স্বৈরাচার পতনে তরুণদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলাতেও তরুণরা সামনে এগিয়ে আসলে জয় আমাদের হবেই।    

মৃতের জানাজায় গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশ

‘তখন এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়, চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মানিক ভাই ফোন দিয়ে জানান করোনায় এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে। ফোন দিয়ে সংগঠনের কয়েকজনকে রাজি করালাম সাথে যেতে। রাত তখন ১০ টা, আমরা কেউ গোসল করাতে জানিনা তাই খবর দেয়া হলো পারদর্শী একজনকে। তিনি আসলেন, কিন্তু করোনা রোগীকে গোসল করাতে হবে শুনেই একটু হাঁটার নাম করে গেলেন পালিয়ে । 

তারপর আরেক বিপত্তি। সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি পিপিই দেয়া হবে। কিন্তু আইইডিসিআর থেকে মাত্র চারজনের পিপিই বরাদ্দ ছিল। শেষ পর্যন্ত মানিক ভাই আরও দুটি পিপিই ব্যবস্থা করে দিলে একটা সিএনজি জোগাড় করে যাই মাস্ক আর স্যানিটাইজার কিনতে। কিন্তু ফিরে এসেই দেখি সিএনজি গায়েব। লকডাউন থাকায় আর কোন সিএনজি পাচ্ছিলামনা। রাত ১২ টার দিকে আরেকাট সিএনজি ফোন করে আনাই, তবে সবাইকে সাবধান করে দেই যেন মৃত ব্যক্তির জানাজা দিতে যাচ্ছি তা কেউ উচ্চারণ না করে। 

সিএনজি নিয়ে আমরা যাই মৃত্য ব্যক্তির গ্রাম ধোপল্লাতে। সামনে কাঁদা থাকায় বাড়ি পর্যন্ত যেতে চাইলেন না ড্রাইভার। আগে কখনও না যাওয়ায় তার বাড়িও আমরা চিনিনা। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চারজনকে দেখতে পাই যারা এগিয়ে আসছে একই রাস্তা ধরে। তাদেরকে মৃত ব্যক্তির নাম বলে বাড়ি দেখিয়ে দেয়ার কথা বলতেই দৌড়ে পালালো সবাই। একজন অবশ্য পরে ফিরে এসে দূর থেকে দেখিয়ে দিল বাড়ির রাস্তা। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে তার বাড়িতে গিয়ে দেখি লাশ এখনও আসেনি। এসময় শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। তারপরও আমাদের ঘরে ঢুকতে দেয়নি মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা। খেতেও দেয়নি কিছু।

তারপর লাশ আসলে বৃষ্টির মাঝেই শেষ করতে হয় দাফন কাজ। পিপিইগুলো ভেজা থাকায় পোড়াতেও কষ্ট করতে হয়েছে। সবকিছু শেষ করে ভোর চারটায় আমরা বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম।’’

করোনায় মৃত ব্যক্তির প্রথম জানাজার ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করেন গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের শাহরাস্তি শাখার কর্মী মো. বাদরুদ্দোজা। করোনা রোগী শুনলেই যখন প্রাণ ভয়ে পালিয়েছে মানুষ, এমন প্রতিকূল পরিস্থিতেই সারাদেশে ১৭৭৩ জন মুসলমানের জানাজা ও ২৫ জন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সৎকারের ব্যবস্থা করে সংগঠনটি। অপরাজেয় বাংলাকে সংখ্যাগুলো নিশ্চিত করেন গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় যুগ্ন মহাসচিব আইনজীবী মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার। 

শুধু জানাজা বা সৎকারেই সীমাবদ্ধ ছিলনা গাউছিয়া কমিটির কর্মকাণ্ড। শ্বাসকষ্টে থাকা করোনা রোগীদের জন্য দ্রুত অক্সিজেন সরবরাহ, রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং অসহায় মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণও করছে সংগঠনটি। ইতোমধ্যে সারাদেশে প্রায় এক লাখ অসহায় ও গরিব মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে তারা। 

পশুপাখির পাশেও ‘সঙ্গে আছি’

করোনায় ব্যতিক্রমী মানবিক উদ্যোগ নিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সঙ্গে আছি’। মানুষের পাশাপাশি পশুপাখির জন্যও খাদ্য সরবরাহ করেছে সংগঠনটি। লকডাউনের কারণে আয়-রোজগার বন্ধ ছিল বেদে সম্প্রদায়ের। তাই তুরাগে এই সম্প্রদায়ের ৬৫ পরিবারকে খাদ্যসামগ্রী দিয়েছে ‘সঙ্গে আছি’। 

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথচারী, রিকশাচালক, সিএনজি চালক, ভিক্ষুক ও ছিন্নমূল ২ হাজার মানুষকে খাবার দিয়েছে সংগঠনটি। এছাড়া হিজড়া সম্প্রদায়ের ২০০ জনকে দেয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী।

অন্যদিকে করোনায় লকডাউনের সময় পথেঘাটে উচ্ছিষ্ট খাবার না থাকায় বেশ খাদ্য সংকটে পড়ে রাস্তার কুকুর। অভুক্ত কুকুরকেও খাবার দিয়েছে ‘সঙ্গে আছি’। লকডাউনেও গভীর রাতে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ৪ হাজার কুকুরকে খাবার দিয়েছে এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। এছাড়া পুরান ঢাকার অলিগলিতে থাকা ১৫০ বানরের মুখে খাবার তুলে দেয় তারা। 

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বারেক কায়সার জানান, করোনার এই খারাপ সময়ে মানবিক কারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। অভুক্ত প্রাণিদের খাবার দিয়েছি। সত্যিকার অর্থেই করোনায় ক্ষতিগ্রস্থদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি আমরা।

ব্যক্তিগত উদ্যোগের অনন্য দৃষ্টান্ত রিদুয়ান ইবনে ছাত্তার

রিদুয়ান ইবনে ছাত্তার, পড়ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের মার্কেটিং বিভাগে। করোনায় লকডাউনের ফলে ঘরে বসেই কাটছিল তার জীবন। একদিন বিবিরহাটের বাসা থেকে মুরাদপুর যাওয়ার পথে দেখেন অসহায় মানুষের দুর্দশা। লক্ষ্য করেন আয়রোজগার না থাকা পরিবহনশ্রমিক, রিকশাওয়ালা, চা–দোকানি, বাদাম বিক্রেতা কিংবা পথশিশুদের হাহাকার।

বাসায় ফিরে মানুষের এমনে কষ্টের কথা জানাতেই মানুষদের খাওয়াতে রাজি হয়ে যান মা রাশেদা শারমিন। নিজেই রান্না করা খাবারের প্যাকেট করে তুলে দেন ছেলের হাতে। রিদুয়ান এই খাবারগুলো নিয়ে বিতরণ করতেন চট্টগ্রামের ফুটপাতে। তার কাজে সহায়তা করেছেন আরেক ভাই রাশেদ ইবনে ছাত্তারও। করোনায় মা-ছেলে মিলে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার প্যাকেট খাবার বিতরণ করেছেন বলে অপরাজেয় বাংলাকে জানান রিদুয়ান। আগামী বছল রমজান মাসে ৩০ দিনই মানুষদের ইফতার করানোর পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি। 

অসচ্ছলদের দিকে হাত বাড়ানো ‘গিভ অ্য হ্যান্ড’

২০২০ সালেই ‘গিভ অ্য হ্যান্ড’ নামক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন মডেল ও সমাজসেবক বারিশা হক। আর এই এক বছরেই সংগঠনটিকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়। করোনা শুরুর পর প্রথম বৈঠকে সংগঠনের কোভিড-১৯ পরিকল্পনা গৃহীত হয় বারিশা হকের উদ্যোগেই। 

লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে ৩০০ জন অসচ্ছল মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করে ‘গিভ অ্য হ্যান্ড’। প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের কাজের পরিধিও বাড়ায় সংগঠনটি। লকডাউনে আড়াই হাজার পরিবারের কাছে খাবার পৌঁছে দেয় তারা। পরিবারের সদস্য ৫ জন হিসাব করে সবেইকে এক সপ্তাহের করে খাবার সরবরাহ করা হয়। যেখানে চাল, ডাল, আলুর পাশাপাশি ছিল সাবান, মাস্ক ও স্যানিটাইজারও। 

তারপর সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে রাস্তায় খাবার বিতরণের কার্যক্রম বন্ধ করে হোম ডেলিভারি পদ্ধতি চালূ করে গিভ অ্য হ্যান্ড। যেখানে ফোন পেলেই খাবারের পাশপাশি ওষুধও পৌঁছে দেয় সংগঠনটি। 

বর্তমানে সপ্তাহে একদিন পথশিশুদের খাওয়ানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে গিভ অ্য হ্যান্ড। ভবিষ্যতে নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে বড় পরিসরে কাজ করা হবে বলেও জানান বারিশা হক। 

দক্ষিণ ঢাকায় মানুষের পাশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প

ইউএনডিপি ও ইউকেএইডের আর্থিক সহায়তায় মহামারির শুরু থেকেই করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে পড়েন ইউনাইটেড ন্যাশনস ভলেন্টেয়াররা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত। 

নাসরিন আক্তার ও তার সহকর্মীরা মূলত কাজ করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশনে। যেখানে জনসচেতনা তৈরিতে কাজ করেন ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রতিটি বস্তিতে। হাত ধোয়ার সঠিক পদ্ধতি শেখানো থেকে শুরু করে বিতরণ করেছেন ১ লাখ ১২ হাজার সাবান ও ২০০ হ্যান্ডওয়াশিং ডিভাইস। এছাড়া মাইকিং, ব্যানার, লিফলেটের মাধ্যমে মানুষকে করেছেন সতর্ক। 

লকাডাইনের প্রথম পর্যায়ে আড়াই হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সামগ্রি বিতরণ করেন নাসরিন ও তার দল। প্রতিটি বস্তায় ছিল ৩০ থেকে ৩৫ কেজি সমমূল্রের খাদ্যদ্রব্য। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে সমপরিমাণ খাদ্যদ্রব্য দিয়েছেন দেড় হাজার পরিবারকে। 

নিজের কার্যক্রম সম্পর্কে এই সমাজকর্মী জানান, মিশ্র অনুভূতি নিয়ে করোনায় কাজ করতে হয়েছে আমাদের। বৈশ্বিক মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিক প্রশান্তি যেমন ছিল তেমনি নিজের নিরাপত্তা নিয়েও ছিল ভয়। ভবিষ্যতেও এভাবে সমাজের সেবা করতে চাই।

মানবতার সেবায় ''মার্সি ইউনিভার্স''

দারিদ্রমুক্ত সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে পহেলা জানুয়ারি ২০১৭ থেকে কাজ শুরু করে ''মার্সি ইউনিভার্স''।  যার স্লোগান ‘নট হিউম্যান, বিলিভ ইন হিউম্যানিটি’।  প্রতিষ্ঠার পর থেকে গরীব-অসহায়দের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, মেডিকেল সাপোর্ট, শীতবস্ত্র ও রমজান মাসে ইফতারসহ বিভিন্ন দুর্যোগে খাবার বিতরণ এবং ছোট ছোট রাস্তা,ব্রিজ সংস্কার ও ভলান্টিয়ার দ্বারা অপরিচ্ছন্ন জায়গা পরিস্কার করার কাজ করতো ''মার্সি ইউনিভার্স''।

করোনা পরিস্থিতি এসবের পাশাপাশি নানামুখি কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সংগঠনটি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক প্রচারণা। বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তার,স্টাফ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সেচ্ছাসেবকদের মাঝে  প্রায় ৯৬৭ পিস পি.পি.ই, সমাজের বিভিন্ন স্থরের মানুষের কাছে প্রায় ৪ হাজার মাস্ক ও ৫০০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ। করোনাক্রান্ত রোগীদের ফ্রি ঔষধসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ। এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৮৫০ পরিবারের মাঝে ১ মাসের শুকনো খাবার বিতরণ।

নিজেদের কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবরার নেওয়াজ জানান, করোনায় মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছি আমরা। ভবিষ্যতেও এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে ''মার্সি ইউনিভার্স''।

করোনা মোকাবেলায় এত বেশি সংখ্যক সংগঠন আত্মমানবতার সেবায় কাজ করেছেন যাদের বর্ণনা আসলে পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও অর্থনৈতিকভাবে পড়েছেন অনেকে। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি এমন সব সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমেই সম্ভব ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ নির্মাণ।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)

আরও পড়ুন

Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
বিশেষ সংবাদ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত