যেমন গেলো ২০২০
অপরাধ ও অভিযানে ২০২০
যেমন গেলো ২০২০
অপরাধ ও অভিযানে ২০২০
করোনা মাহামারি যেমন পৃথিবীকে একটু একটু করে গ্রাস করেছে বছরজুড়ে, থামিয়ে দিয়েছে জীবনের স্বাভাবিক স্পন্দন। তেমনি কিছু অপরাধ আর দুর্নীতির ঘটনাতেও থমকে যেতে হয়। এমন নয় যে, করোনার আগে পৃথিবী স্বর্গরাজ্য ছিল, কোথাও কোনো অপরাধ, সংঘাত, আক্রমণ ছিল না৷ ছিল, সবই ছিল৷ কিন্তু করোনাকালে তা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে৷ দেশের প্রতারণা-জালিয়াতির কয়েকটি বড় ঘটনা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি অভিযান আলোচনা তৈরি করেছে এই বিশেষ বিদায়ী বছরে।
জেকেজির সাবরিনা দম্পতির প্রতারণা
ফোন করলে বাসায় গিয়ে করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করা হতো। বিনিময়ে নেওয়া হতো সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু সেই নমুনার কোনো পরীক্ষা ছাড়াই একদিন পরেই পরীক্ষার ফল দেওয়া হতো। ২০২০ এর জুন মাসে এমন অভিযোগ ওঠে জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার (জেকেজি হেলথকেয়ার) বিরুদ্ধে।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশীদ সে সময় গণমাধ্যমকে জানান, একজন ভুক্তভোগী তাদের কাছে এই অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন। এমন অভিযোগের পর তদন্তে নামে পুলিশ। তারপর জেকেজি হেলথ কেয়ারের কর্মচারী হুমায়ুন কবির ও তার স্ত্রী তানজিনা পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানার পুলিশ। জবানবন্দিতে হুমায়ুন কবীর জেকেজি হেলথ কেয়ারে চাকরি করার সময় কীভাবে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা এবং ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেছেন, সে ব্যাপারে সবিস্তার তুলে ধরেন।
জানা যায়, করোনা জালিয়াতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন জেকেজির হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান চিকিৎসক সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুল হক চৌধুরী। পরে গ্রেপ্তর করা হয় আরিফুল ও সাবরিনাকে। এরপর করোনাভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে আট কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটিতে গত ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে সিলগালা করে দেওয়া হয়। বাতিল করা হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস চিকিৎসা ও পরীক্ষার অনুমোদন। পরে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা হয়। সেটি এখন বিচারাধীন আছে।
জেকেজি বিনা মূল্যে নমুনা সংগ্রহের জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পৃথক ছয়টি স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল। এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ করত জেকেজি। শর্ত ছিল, সরকার–নির্ধারিত করোনা শনাক্তকরণ ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠাতে হবে। জেকেজি হেলথকেয়ার, ওভাল গ্রুপের একটি অঙ্গসংগঠন।
প্রতারণার অকল্পনীয় উদাহরন
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আরও বেশি। বিনামূল্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষা ও চিকিৎসা করাতে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল তারা। কিন্তু হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরার দুই শাখাতে করোনার নমুনা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হতো। বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত। ২০১৪ সালের পর লাইসেন্স নবায়ন না করেই হাসপাতাল দুটি চালানো হচ্ছিল। আর করোনা সংক্রমণের পর থেকে সাহেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার লাগানো নম্বরবিহীন গাড়ি ব্যবহার করছিলেন।
এসব অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ৬, ৭ ও ৮ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখা বন্ধ করে দেয় র্যাব। সে সময় আটজনকে আটক করা হয়। ওই অভিযানের গা-ঢাকা দেন হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম, যিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা কাজ হাসিল করে আসছিলেন।
গত ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা দেবহাটা সীমান্তবর্তী কোমরপুর গ্রামের লবঙ্গবতী নদীর তীর থেকে পিস্তলসহ তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তার বিরুদ্ধে আসতে থাকে প্রতারণার নানা অভিযোগ। এর মধ্যে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে পুলিশের করা এক মামলায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাহেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এর মধ্যে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসতে থাকে, এই সাহেদ করিম আদতে একজন প্রতারক। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজের যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাকে প্রভাবশালী বলেই মনে হয়।
ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির সাধারণ সম্পাদক শাম্মী আহমেদ পরবর্তীতে জানিয়েছেন, সাহেদ করিম কমিটির সদস্য নন। তিনি মাঝে মাঝে বৈঠকে আসতেন। আগে কোনো একসময় সদস্য ছিলেন।
বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরোয়, সাহেদ করিম কখনো মেজর, কখনো সচিব, আবার ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস হিসেবেও নিজের পরিচয় দিয়েছেন। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার নথিতে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে জাহির করেন।
মাস্ক দুর্নীতি ঠেকাতে অভিযান
দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর গত মার্চে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লাখ মাস্ক সরবরাহ করতে জেএমআই হাসপাতাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সে সময় এন-৯৫ মাস্কের বাক্সে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া গেলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। চিকিৎসক, নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীদের ‘মৃত্যুর ঝুঁকিতে’ ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে জেএমআই গ্রুপের এমডি মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার পর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালতে জামিন পান।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল ‘এন-৯৫’ মাস্ক সরবরাহ করায় ছাত্রলীগের এক সাবেক নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মামলার আসামি শারমিন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর ২৪ জুলাই রাতে শারমিন জাহানকে শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি রমনা বিভাগ।
র্যাবের জালে গোল্ডেন মনির
বিপুল অর্থ, অস্ত্র-মদ ও সোনাসহ গত ২০ নভেম্বর রাতে র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হন মনির হোসেন, যিনি ‘গোল্ডেন মনির’ নামেই পরিচিত। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় মনিরের ছয়তলা বাড়িতে অভিযানের পর এক কোটি নয় লাখ টাকা, চার লিটার মদ, আট কেজি সোনা, একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করার কথা জানানো হয় র্যাবের পক্ষ থেকে। গ্রেপ্তারের পর মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা হয়। মামলাগুলো তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।
রেহাই পায়নি সেলিমপুত্র
গত ২৪ অক্টোবর রাতে ধানমণ্ডি এলাকায় সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো হাজী সেলিমের একটি গাড়ি থেকে নেমে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধর করা হয়। ওই ঘটনায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওয়াসিফ।
পরদিন ২৫ অক্টোবর পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবীদাস লেইনে হাজী সেলিমের বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালায় র্যাব। আটক করা হয় ইরফান ও তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে। ওই ভবন থেকে দুটি অবৈধ পিস্তল, গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করার কথা জানায় র্যাব। মদ আর ওয়াকিটকির জন্য ইরফান ও তার দেহরক্ষী জাহিদকে তাৎক্ষণিকভাবে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। দেবীদাস লেইনে ওই অভিযানের মধ্যেই চকবাজারের আশিক টাওয়ারে ইরফানের ‘নির্যাতন কেন্দ্রের’ সন্ধান পাওয়ার কথা জানায় র্যাব। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিমকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদ থেকেও বরখাস্ত হন তিনি। র্যাবে ওই অভিযানের পর রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় হাজী সেলিমের দখলদারিত্বের খবর আসতে থাকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- নর্ড স্ট্রিম ২ কী? কেন এটি নিয়ে এত বিতর্ক? পর্ব ১
- বিশেষ সাক্ষাৎকার
`চিকিৎসা সম্ভব, সমাজে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে কেউ থাকবে না` - চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচায় জীবিত খরগোশ গুনছিলো মৃত্যুর ক্ষণ
- মগবাজারে বিস্ফোরণে অপরাজেয় বাংলার সম্পাদক-নির্বাহী সম্পাদক আহত
- যশোরে মিঠা পানিতে নোনা ট্যাংরার বাণিজ্যিক চাষ
- ১৪১ বছরের পুরনো পাগলা গারদে পাগল হওয়ার দশা!
- পাহাড়ি জঙ্গলে এলাচের বন, সবুজ গুটিতে স্বপ্ন ভাসে ওমর শরীফের
- করোনায় দৃশ্যমান স্বেচ্ছাসেবার শক্তি
- মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর ও মেধাবী, তবে ভারতীয়
কৈশোরেই ব্রিটেনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক বাঙালি নারীর গল্প - স্বচ্ছতা, বিশ্বস্ততা সোনালী লাইফকে পৌঁছে দিয়েছে নতুন উচ্চতায়: রাশেদ আমান