শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের গল্প শুনুন

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

০৯:৫৮, ৭ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৯:৫১, ৮ ডিসেম্বর ২০২০

৩৫৭৯

বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের গল্প শুনুন

বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের দেখা হয় সমাজের কলঙ্ক হিসেবে। তারা এখানে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা, অবহেলার শিকার হন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। মুলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শেষ থাকেনা।

দেশের সংস্কৃতিটাও এমন। যেখানে যৌনকর্মীদের চরিত্রহীন হিসেবে গন্য করা হয়। তারা কেবল নিগৃহীত, নিপীড়িতই হন। সমাজে কেউ তাদের দাম দেননা, সম্মানতো দূরের কথা। পেশার কারণে পরিবারও ওদের গ্রহণ করেনা। প্রতি পদে পদে বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়।

সারাদেশে যৌনকর্মীদের ক্ষতিকারক এলিমেন্ট হিসেবে দেখা হয়। যেখানে তারা শুধু ব্যবহৃত ও অপব্যবহৃত হন। পুরো বিষয়টি একটি ছাঁচিকরণে পরিণত হয়েছে। যার মূল ভাবার্থ দাঁড়িয়েছে সমাজের সবচেয়ে সস্তা বস্তু নারী। তাদের সামাজিক মর্যাদা বিতর্কিত। বলতে গেলে কোনো অস্তিত্বই নেই।

শুধু যৌনকর্মীরাই নন, যৌন ইন্ডাস্ট্রিতে অবহেলিত পতিতা তথা বেশ্যারাও। পতিতাবৃত্তি শব্দটাই যেন ঘৃণার। যে সমাজ কিংবা যারা এ সেবা গ্রহণ করেন, তারাই এটিকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। এর গায়ে কলঙ্কের কালিমা লিপ্ত করছেন।

স্বাভাবিকভাবেই আজ পতিতাবৃত্তি কোনো আকাঙ্ক্ষিত জীবন ধারা নয়। অনেকে পেশা ছেড়ে দিতে মরিয়া। সুস্থ জীবনের আশায় একে পেছনে ফেলতে চান। কিন্তু সেইপথে কতটা সফল হন তারা?

মানবাধিকার সংস্থা  ‘তেরেদেসহোমেস’ বলছে- দারিদ্র, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, অসহায়ত্ব, বলপ্রয়োগ, অপব্যবহারের কারণে বাংলাদেশে যৌনকর্মে যোগ দেন নারীরা। অনেকে প্রলোভনে পড়ে এ পেশায় নিয়োজিত হন। তাদের উন্নত জীবন দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিবর্তে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়।

যারা বিক্রি হন, তারা মূলত চুক্তিভিত্তিক সেখানে থাকেন। নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে নিজেদের মুক্ত করতে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন ওরা। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এ পেশা ছেড়ে দেবেন,না স্বাধীন থাকবেন। মেয়াদ শেষে অনেকে তা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরতে চান।

তবে নতুনভাবে তাদের জীবন শুরু করা কঠিন। কারণ,শরীরে অতীতের দুর্গন্ধ লেগে থাকে। তারা সমাজে ঠাঁই করে নিতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত জীবন-জীবিকার জন্য ফের বেশ্যালয়ে ফিরে যান।

বাংলাদেশে যৌনকর্মীরা ক্ষতিকর কিছু ওষুধ সেবন করেন। এর মধ্যে অন্যতম ‘ওরাডেক্সন’। যেটা পশু মোটাতাজাকরণে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত শারীরিক সৌন্দর্য বাড়াতে বা ধরে রাখতে এটি খান তারা। যেন বেশি মক্কেল পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে বেশি অর্থ উপার্জন করা যায়।

দীর্ঘ মেয়াদে সেসব ওষুধ ব্যবহার তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিকল করে দেয়। সর্বোপরি, এ অভ্যাস মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত নারীরা সেসব ওষুধ খেলে তার ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন, স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সম্পর্কেও বোঝেন। তবুও সেগুলোই খেতে থাকেন। একসময় সে ওষুধ খেতে খেতেই তাদের মৃত্যু হয়।

শিশু যৌনপাচার এবং বয়স বৈষম্য
হাইকোর্ট ২০০০ সালে যৌনকর্মকে বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে সেক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ১৮ বছরের উপরে। তাহলেই তাদের যৌনকর্মী হিসেবে গণ্য করা হবে।

সচরাচর এদেশে বিপাকে পড়ে যৌনকর্ম জীবন গ্রহণ করেন নারীরা। বেঁচে থাকার জন্য যা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য এপথ কখনই বেছে নেন না কেউ। বেশ্যালয় হচ্ছে জেলখানা। যেখানে জীবিকার তাগিদে কাজ করেন তারা। কেউ কেউ কম বয়সেও এই কাজে বাধ্য হন। আবার অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদেরই এখানে বিক্রি করা হয়।

বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি আইনে কমবয়সী বালিকাদের বিক্রি করা নিষিদ্ধ। ৩৬৪-এ, ৩৬৬-এ ও ৩৭৩ ধারায় বলা হয়েছে, কমবয়সী বালিকাদের বিক্রি করা গুরুতর অপরাধের আওতায় পড়বে। এর শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।

বিশ্বের অন্যতম বড় পতিতালয় দৌলতদিয়া। যেখানে বয়সটাই এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। নতুন কর্মীদের গড় বয়স ১৪ বছরের কম। এটি শিশু যৌন পাচারের ফল। সাধারণত, কমবয়সী মেয়েরা অপহৃত হয়ে বেশ্যালয় ও হোটেলে আশ্রয় পায়। 

প্রেমের নামে ফুসলিয়ে কিংবা সৎ মায়ের কারসাজিতে শিশুগুলো যৌনপল্লীতে স্থান পেয়েছে এমনটাই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। 

যেসব লোকজন নারীদের পতিতাবৃত্তির পথ বেছে নিতে বাধ্য করেন অথবা বেশ্যালয়ে বিক্রি করেন; পরে সেই তারাই তাদের সমাজবিচ্যুত করেন। সুশীল সমাজ থেকে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করেন ওই কুচক্রী মহলই। যৌনকর্মীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেখলেই সুশীল লোকদের ভন্ডামিটাও স্পষ্ট হয়। 

জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউএনএআইডিএস’র ২০১৬ সালের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজার যৌনকর্মী রয়েছেন। শুধু দৌলতদিয়াতেই ১ হাজার ৬ শত নারী যৌন কর্ম করেন। এখানকার অনেক মেয়েই কম বয়সের। তবে এ ব্যাপারে অন্ধ কর্তৃপক্ষ।

কিছু মেয়ে সেখানেই জন্ম নেয়। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের দেখভালের জন্য এ পেশায় জড়িয়ে পড়ে। বাকিরা পাচার হয়ে আসা। পল্লীর ‘ম্যাডামরা’ তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন।

অপহৃত মেয়ে শিশুদের অধিকাংশের স্থান হয় যৌন ইন্ডাস্ট্রিতে। পরিণামে এসব ভবঘুরে শিশুদের সাহায্যার্থে হাত না বাড়িয়ে তাদের উপর অত্যাচারের পথ প্রশস্ত করা হয়। ওদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয় অসাধু লোকজন।

যৌন ইন্ডাস্ট্রিতে কিশোরীদের চাহিদা বেশি। কুমারি ও তরুণী হওয়ায় তাদের এ চাহিদা। কে কত খাঁটি, এর ওপর দাম হাঁকান ক্রেতা তথা ক্লায়েন্টরা। অথচ এরই মধ্যে সমাজে অবস্থান হারিয়ে ফেলেছেন তারা।

তরুণী যৌন কর্মীদের সেবা পছন্দ করেন ক্লায়েন্টরা। এখানেই বয়সের বৈষম্যের ধরনটা ফুটে ওঠে। কারণ, যাদের একটু বয়স বেশি; তাদের চাহিদা কম। তাই বয়স বৃদ্ধিও একটি নেতিবাচক দিক। এতে তাদের অর্থকষ্ট বাড়তে থাকে।

দৌলতদিয়ায় যৌনকর্মীদেরও থাকার জন্য ভাড়া দিতে হয়, নানা ধরনের (পানি, বিদ্যুত) বিল পরিশোধ করতে হয় এবং খাবার খরচ বহন করতে হয়। ফলে বয়স্ক যৌনকর্মীরা সহজেই বিপাকে পড়েন। 

দেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ১৫ বছরের নিচেই অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এটি সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু যৌন ইন্ডাস্ট্রিতে কম বয়সী মেয়েদের কাজ করার হার কত তা উপেক্ষা করে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

যৌনকর্মীদের শিশুরা
পতিতাবৃত্তির কলঙ্ক যৌনকর্মীদের শিশুদের ওপরও প্রভাব ফেলে। যখন কেউ গর্ভধারণ করেন, তখন থেকেই তিনি আশা করেন, তার মেয়েও যৌনকর্মী হবেন এবং এ মাধ্যমে আয় রোজগার করবেন। যেইমাত্র দৌলতদিয়ায় শিশু কন্যা জন্ম নেয়, সেইমাত্র তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। কারণ, তার কথিত বাবা তাকে গ্রহণ করতে চায় না। ফলে তার জীবন বিপদের মুখে পড়ে যায়। তাকে পতিতালয়েই বড় হয়ে উঠতে হয় আর পতিতাই হতে হয়। 

বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে এখনও একটা বদ্ধমূল ধারণা প্রোথিত রয়েছে পরিবারের নতুন সন্তানটি ছেলে হোক, মেয়ে নয়। কিন্তু যৌনপল্লীতে একজন একটি মেয়ে সন্তানই কামনা করেন। আর জন্মানোর ১২ বছর পূর্ণ হলেই সেই বালিকা যৌন কর্মে ঢুকে পড়ে। এভাবেই কম বয়সী পতিতাবৃত্তি বাড়ে। আর একবার এই বৃত্তি শুরু করলেই তার পরিচয় নির্ধারণ করে দেয় সমাজ।

যৌনকর্মীদের শিশুরা খুব একটা শিক্ষিত হতে পারেন না। কারণ এ পথে নানা প্রতিবন্ধকতা। নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে পতিতাপল্লীর শিশুদের পড়াশোনা করতে দিতে চান না গ্রামবাসী। এজন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছেন পতিতালয়ের আশেপাশের গ্রামের অভিভাবকরা। পরিপ্রেক্ষিতে আরেকভাবে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয় এই পল্লীর শিশুরা। হাজারো চেষ্টা করলেও তাদের আর মুক্তি মেলে না।

১৯৯৭ সালে দৌলতদিয়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেভ দ্য চিলড্রেন। পতিতালয়ে যারা জন্ম নেবে, কেবল তাদের জন্যই এ স্কুল। শিশুদের কিছু মৌলিক শিক্ষা দেয়া হয়। এতে কিছুটা সুফল পাওয়া গেছে। এতে কিশোর-কিশোরীরা আর বেশ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোয় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। অনেক মেয়ে যৌনকর্মে না যেয়ে নিজেকে এই বলয় থেকে বের করতে পেরেছে। মাদক বেচাকেনা, পাচার থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পেরেছে ছেলেরা।

যদিও এসব শিশুকে বৈষম্যের হাত থেকে খুব একটা রক্ষা করতে পারেনি স্কুলটি। বেশ্যার ছেলেমেয়ে হওয়ায় তাদের প্রতিনিয়ত হাসির খোরাকই হতে হয়। অপমানের জীবনই তাদের বহনকরে চলতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্যে পড়ে যার ব্যাপক প্রভাব। 

মৃত্যুতেও কলঙ্ক

এখন শুনুন পতিতা মারা গেলে কি হয়। বলা বাহুল্য, মরে গেলেও শান্তি নাই দৌলতদিয়ার বেশ্যাদের। এ নিয়ে দুর্ভোগের কথা শিকার করেছেন এক যৌনকর্মী। তিনি বলেন, আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় সবাই। এখানে নয়,অন্য কোথায় মৃতদেহ কবর দিতে আমাদের বাধ্য করেন গ্রামবাসী।

অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত যৌন কর্মের কলঙ্ক থাকে। গ্রাম্য কবরস্থানে মৃত পতিতাদের কবর দিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন গ্রামবাসী। ফলে অনেক ক্ষেত্রে মৃতদের নদীতে ফেলে দেন তারা। অনেক সময় মৃত বেশ্যাদের বেশ্যালয়ের নিকটবর্তী বালুর স্তূপের নিচে কবরদেয়া হয়। 

মরণ হলেও আর তারা পতিতালয় ছেড়ে যেতে পারেন না। কিছু ক্ষেত্রে তাদের যেখানে-সেখানে কবর দেয়া হয়। থাকে না কোনো নাম, মৃত্যুর তারিখ কিংবা স্মৃতিচিহ্ন। 

যৌনকর্মীদের সুরক্ষায় যা করা হয়
বাংলাদেশে যৌনকর্মীরা প্রান্তিক সম্প্রদায়। সবকিছুতে তারা বেষম্যের শিকার।  যতদিন বাঁচেন ততদিন দুঃখ, কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করেন। তারা মানবপাচারের শিকার এবং শোষন ব্যবস্থার দাস। 

দেশে ২০টি লাইসেন্সধারী বেশ্যালয়ের মধ্যে একটি দৌলতদিয়া। এর বাইরে লাল সংকেত পাওয়া আরও অনেক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি ফরিদপুর। যৌনকর্মীদের সুরক্ষায় প্রস্টিটিউট অ্যাসোসিয়েশন অব ফরিদপুর গড়ে উঠেছে। 

এর প্রেসিডেন্ট হায়া বেগমের উদ্ধৃতিটা এমন-
“মানব চাহিদা পূরণে যৌনকর্মীদের ব্যবহার করে সমাজ। অথচ তাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়। যারা এ ইন্ডাস্ট্রিকে চাঙ্গা রাখে, তাদেরই ছোট চোখে দেখা হয়। কিন্তু কেন?”

সেভ দ্য চিলড্রেনের পাশাপাশি কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে যৌন কর্মীদের  কল্যাণে কাজ করছে। অনেকে দলগত ও ব্যক্তিগতভাবেও অর্থায়ন করছেন। যাতে তারা সুষ্ঠু, সুন্দর, পরিশীলিত জাবনযাপন করতে পারেন? কিন্তু সেটা কি পর্যাপ্ত?
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)

আরও পড়ুন

Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
বিশেষ সংবাদ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত