মধ্যপ্রাচ্যে পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে, ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা
মধ্যপ্রাচ্যে পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে, ভয়াবহ পরিণতির আশঙ্কা
ইরানের হ্রদ উর্মিয়া লেকের ছোট ছোট দ্বীপে একসময় যেসব ফেরি আসা-যাওয়া করতো সেগুলোতে এখন মরিচা ধরেছে। জীর্ণশীর্ণ হয়ে নষ্ট হচ্ছে। দুই যুগ আগেও মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম হ্রদ উর্মিয়া ছিল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। সেখানে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট চলতো হ্রদকে কেন্দ্র করেই।
বন্দর শহর শরাফখানর সাবেক সাংবাদিক আহাদ আহমেদ সিএনএনকে বলেন, "মানুষ এখানে সাঁতার কাটতে আসত এবং থেরাপিউটিক কাজে কাদা ব্যবহার করত। তারা অন্তত কয়েকদিন এখানে থাকত"। এসব তথ্য জানিয়ে তিনি ১৯৯৫ সালের কিছু ছবিও দেখান।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই এই উর্মিয়া লেক দ্রুত মৃতপ্রায় অবস্থায় গেছে। ১৯৯০ সালে যেখানে হ্রদটির আয়তন ছিল ৫ হাজার ৪০০ কিলোমিটার বর্তমানে তা কমে হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার।
পশ্চিম আজারবাইজানের পরিবেশ সুরক্ষা বিভাগের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের এই হ্রদটি পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু ইরানেই নয়, এ ধরনের সমস্যা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই দেখা যাচ্ছে। অঞ্চলগুলোতে পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত খরা এবং তাপমাত্রা এত বেশি যে সেখানে মানুষের বসবাস কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। পানি অব্যবস্থাপনা এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের পাশাপাশি পানিবায়ু পরিবর্তন যুক্ত হওয়ায় এখানে পানির ভবিষ্যত নিয়ে ভয়াবহ শঙ্কার কথা উঠে আসছে।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) এর পানি বিষয়ক পরিচালক চার্লস আইসল্যান্ড সিএনএনকে জানান, ইরান, ইরাক ও জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ সেচের মাধ্যমে নিচ থেকে প্রচুর পানি উত্তোলন করছে। তার কারণ হলো সেখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়া।
তিনি বলেন, "তারা বৃষ্টির মাধ্যমে নিয়মিতভাবে যতটুকু পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করছে। আর তাই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস পাচ্ছে কারণ আপনি বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে তা পুনরায় পূরণ করার চেয়ে দ্রুত পানি বের করছেন।"
ইরানেও তেমনটা ঘটছে। দেশটিতে মোট ব্যবহৃত পানির ৯০ শতাংশ ব্যবহার হয় কৃষি খাতে। আইসল্যান্ড বলেছে, "এই দেশগুলিতে বৃষ্টিপাত এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে অনেক নদী, হ্রদ এবং জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে।"
পানি এভাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এলাকাগুলি বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠতে পারে; নদী ও হ্রদের মতো পানিসম্পদ কীভাবে ভাগ এবং পরিচালনা করা যায় তা নিয়ে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে এবং আরও রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইরানের আবহাওয়া দপ্তর অনুযায়ী, পাঁচ দশকে সবচেয়ে শুষ্ক অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীতকালে পৃথিবী যত উষ্ণ হবে ততই শুষ্ক হয়ে উঠবে এবং গ্রীষ্মকাল যখন ভেজা থাকবে, তখন গরম সে পানিকে শুষে নিবে।
সৌদি আরবের বাদশা আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চের পরিচালক মনসুর আলমাজরুই সিএনএনকে বলেন, "সমস্যা হল, এই পুরো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে যেটুকু বৃষ্টি হবে তা বাষ্প হয়ে যাবে। অথবা বৃষ্টি বেড়ে চরম বন্যা হবে, যেমন চীনে, জার্মানিতে, বেলজিয়ামে ঘটছ। এই বন্যা মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা হবে। এটি সত্যিই একটি বড় পানিবায়ু পরিবর্তন ইস্যু। "
ইরানের জ্বালানি মন্ত্রালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে হ্রদের মৃত্যুর জন্য পানিবায়ু পরিবর্তন ৩০ শতাংশ দায়ী। এই পরিবর্তনগুলি কেবল পানির পরিমাণের উপর প্রভাব ফেলছে তা নয়, সেগুলি গুণমানকেও প্রভাবিত করছে।
উর্মিয়া লেকের পানি এমনিতেও ছিল লবনাক্ত। যেহেতু এটি সঙ্কুচিত হয়েছে, লবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এত চরম হয়ে উঠেছে যে এটি সেচের জন্য ব্যবহার করলে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি করছে।
লেকের কাছে টমেটো, সূর্যমুখী, চিনি বিট, বেগুন চাষবকারী রী কিওমার্স পাউজেবেলি সিএনএনকে বলেন, লবণাক্ত পানি বিপজ্জনক। এখানের মাটি ফসল উৎপাদনে অচল হওয়র দিন বেশি দূরে নয়।"
ভয়াবহ ভবিষ্যৎ
পানি কম ব্যবহার করা দেশগুলোর অন্যতম জর্ডান। সেখানের মানুষ পানি কম ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে উঠছে।
প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস -এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, জর্ডানবাসীদের শতাব্দীর শেষ নাগাদ তাদের মাথাপিছু পানির ব্যবহার অর্ধেক করতে হবে। নিম্ন আয়ের অধিকাংশ জর্ডানবাসী প্রতিদিন ৪০ লিটার পানি ব্যবহার করে। এ পানি দিয়েই তারা পান করা, স্নান করা এবং কাপড় ও থালাবাসন ধোয়ার কাজ করে। আমেরিকানরা এরচেয়ে ১০ গুণ বেশি পানি ব্যবহার করে।
জেরুজালেমের দ্য হিব্রু ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের প্রোগ্রামের অধ্যাপক ড্যানিয়েল রোজেনফেল্ড বলেন, জর্ডানের অনেক বাড়িতে প্রতিদিন পানি পাওয়া যায় না। এমনকি রাজধানীতেও এমন সমস্যা আছে।
জর্ডানের কিছু অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বছরে এক মিটারেরও নিচে নেমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলে অনেক দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের কারণে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে।
জর্ডানের পানি কর্তৃপক্ষের মহাসচিব বাশার বাতায়েনেহ সিএনএনকে বলেন, পানির এই বর্ধিত চাহিদা মোকাবেলার জন্য দেশকে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আরও অর্থ সহায়তা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে জর্ডান সিরিয়ার শরণার্থী সংকটের ভার বহন করেছিল। শরণার্থীরা প্রতি বছর পানির খাতে ৬০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করে এবং জর্ডান এই পরিমাণের একটি অংশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পেয়েছিল," তিনি বলেছিলেন। ।
তিনি আরও বলেন, জর্ডানে ২০২০ সালে আগের বছরের তুলনায় অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে, যা এক চতুর্থাংশের বেশি পানি সম্পদকে ঝুঁকিতে ফেলেছে এবং খাবারের পানির উৎসকে অর্ধেক করে দিয়েছে।
এছাড়া দেশটি জর্ডান নদী ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে, যা ইসরায়েল, পশ্চিম তীর, সিরিয়া এবং লেবাননের মধ্য দিয়েও চলে এবং নদীর ধারে বাঁধ নির্মাণ জর্ডানে পানির প্রবাহকে মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে।
জর্ডানও সেচের জন্য নদীর পানি ব্যবহারের জন্য খাল ব্যবহার করে। অতীতে নদী ব্যবস্থাকে ঘিরে বেশ কয়েকবার সংঘাতও দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে জর্ডানের কাছে ইসরায়েল থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি কেনার বিকল্প নেই। ইসরায়েলের একটি বিশাল ডিসালিনেশন প্রোগ্রাম রয়েছে, যেখানে এটি সমুদ্রের পানি থেকে লবণ সরিয়ে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করা হয়। কিন্তু ডিসালিনেশন হল জ্বালানী নির্ভর। সে জ্বালানী আবার সবুজ না হওয়ায় তা জলাবয়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
যেহেতু পানিবায়ু উষ্ণ হতে থাকে এবং পানির অভাব হয় তাই মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সমাধানে কৃষিতে পানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক রোজেনফেল্ড বলেন, এর অর্থ হতে পারে কৃষকদের খাদ্য ও রপ্তানির ধরন পরিবর্তন করা। উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলে আমরা প্রচুর পরিমাণে কমলা চাষ করতাম, কিন্তু এক পর্যায়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে তারজন্য যে পরিমাণ পানি আমাদের প্রয়োজন সেটি নেই।
বাগদাদের উত্তর-পূর্বে দিয়ালা প্রদেশে বসবাসকারী পাঁচ সন্তানের জনক ৫৪ বছর বয়সী রাদ আল-তামামি পানির জন্য টাইগ্রিস নদীর উপনদী ‘দিয়াল’ এর নির্ভর করেন। দিয়াল বহু বছর ধরে শুকিয়ে যাচ্ছে এবং আল-তামামীকে তার তিনটি খামার জুড়ে ফল উৎপাদন অর্ধেক করতে বাধ্য করেছে। তাদেরকে অনেক সময় পানি পেতে এক মাসও অপেক্ষা করতে হয়।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরো পানির উপর এই নির্ভরতা বিড়ম্বনার সাথে খাদ্যের প্রাপ্যতাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। বিষয়টি সব সময় আল-তামামিকে ভাবিয়ে তোলে।
তিনি বলেন "আমি সহ অনেক কৃষক এই পেশাটি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি, যা বাবা-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। এখন আমরা এমন চাকরির সন্ধান করছি যা সন্তানদের ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ করে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- নর্ড স্ট্রিম ২ কী? কেন এটি নিয়ে এত বিতর্ক? পর্ব ১
- বিশেষ সাক্ষাৎকার
`চিকিৎসা সম্ভব, সমাজে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে কেউ থাকবে না` - চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচায় জীবিত খরগোশ গুনছিলো মৃত্যুর ক্ষণ
- মগবাজারে বিস্ফোরণে অপরাজেয় বাংলার সম্পাদক-নির্বাহী সম্পাদক আহত
- যশোরে মিঠা পানিতে নোনা ট্যাংরার বাণিজ্যিক চাষ
- ১৪১ বছরের পুরনো পাগলা গারদে পাগল হওয়ার দশা!
- পাহাড়ি জঙ্গলে এলাচের বন, সবুজ গুটিতে স্বপ্ন ভাসে ওমর শরীফের
- করোনায় দৃশ্যমান স্বেচ্ছাসেবার শক্তি
- মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর ও মেধাবী, তবে ভারতীয়
কৈশোরেই ব্রিটেনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক বাঙালি নারীর গল্প - স্বচ্ছতা, বিশ্বস্ততা সোনালী লাইফকে পৌঁছে দিয়েছে নতুন উচ্চতায়: রাশেদ আমান