মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পথ থেকে পাওয়া

কে এই আগন্তুক!

কাইসার রহমানী

১২:০২, ২৩ মে ২০২১

আপডেট: ১২:২৩, ২৩ মে ২০২১

৯৮০

পথ থেকে পাওয়া

কে এই আগন্তুক!

মফস্বল শহরে পথহারা মানসিক ভারসাম্যহীন আগন্তুকের সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আছে। এরকম বৈশিষ্ট্যের মানুষেরা কিছুদিন মফস্বলে থাকলেই, এখনো মফস্বলবাসীর একাংশ মনে করেন আগন্তুক হয়তো গোয়েন্দা। তাই সাধারণ মানুষ তাকে ত্যক্ত-বিরক্ত না করে দূরে দূরে থাকেন। আরেক অংশ আবার আগন্তুককে গোয়েন্দা মনে করে অনেক খাতির যত্ন করেন। কেউ কেউ আবার পাগল মনে করে ঘৃণা করেন, বিরক্ত করেন। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে ২০১৫ সালের দিকে ৫৫ বছরের বেশ মোটা সোটা গড়নের এক আগন্তুক আসেন। বেশ লম্বা। ফর্সা। স্বাস্থ্য একটু বেশিই ভাল। পরিস্কার লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে থাকেন সবসময়। রহনপুর বড় বাজারে মানুষটি স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করলেন। কারো সঙ্গেই তেমন কোন কথা বলেন না। পিঠে সবসময় বস্তা থাকে। তার কাজই হলো সারাদিন বিভিন্ন প্রকারে ময়লা কুড়িয়ে বস্তায় জমিয়ে রাখা। কখনো কখনো তার কাঁধে থাকা ময়লা ভর্তি বস্তার ওজন দুই থেকে আড়াই মন হয়ে যায়। এতো ওজনের বস্তা তিনি বয়ে বেড়ান আর চোখের সামনে রাখেন সবসময়। মনে হয় যেন বস্তার ভিতর কোন মূল্যবান রত্ন রাখা আছে!

প্রায় ৭ বছর ধরে মানুষটি রহনপুরে। একদল তাকে এখনও মনে করেন গোয়েন্দা, আরেকদল ভাবে পাগল।  

একবার রহনপুর পুণর্ভবা নদীর সিঁড়ি ঘাটে একা পাওয়া গেল তাকে। মোটা ভূড়িটায় হাত বুলাচ্ছেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি।

কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করতেই মহাবিরক্ত হলেন। তবে দৃষ্টি সরালেননা আকাশ থেকে। আবারো নাম জিজ্ঞেস করা হলো। বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। ভাষাটা অপরিচিত, কিছুটা ভোজপুরী ভাষার মতো। বাড়ি কথায় জিজ্ঞেস করতেই ভোজপুরীর মতো ভাষায় বিড় বিড় করলেন। তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আলাপ করতে বিরক্তিবোধ করছেন, একা থাকতে চাচ্ছেন। বাড়িতে কে কে আছেন আপনার? এই এলকায় কিভাবে আসলেন? ঘর ছেড়েছেন কেন? ইত্যাদি কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভোজপুরী ভাষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে তারমতো করে কি কি যেন বলে গেলেন। কিছুই বুঝা গেলনা তার কথার অর্থ। বিরক্ত হয়ে কাছেই রাখা ময়লা ভর্তি বস্তা কাঁধে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে গেলেন তিনি রহনপুর বড় বাজারের দিকে।

মফস্বল এলাকায় রাত ১০ টার আগেই বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন ঝড় আর বৃষ্টির কারণে অনেক আগেই মানুষ শূণ্য বাজার। রাত ১১ টার দিকে নীরব বাজারে একটা পান দোকানের পাশে ল্যাম্প পোস্টের আলোর নীচে বসে আছে মানুষটি। পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করে তাকে দেয়া হলে তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। মুখে হালকা হাসি দিলেন। পাশের পান দোকানদার বললেন, এই পাগলকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে দেখছেন। কারো কাছ থেকে তিনি টাকা পয়সা নেননা। এমনকি সবার কাছ থেকে খাবারও নেননা। পছন্দের কয়েকজন আছে তারা কিছু দিলে তবেই নেন। কাউকে বিরক্তও করেননা। মানুষটিকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার বাড়ি কোথায়? মানুষটি হাসতে লাগলো। তার ভোজপুরী ভাষায় বিড়বিড় করতে লাগলো। পান দোকানদার বললো, ওর ভাষা শুনে মনে হয় ইন্ডিয়া বাড়ি তার। পাগল লোক, কেউ তারে বর্ডার পার কইরা দিয়েছে। আর রহনপুরে লাস্ট ট্রেন স্টেশন। ইন্ডিয়া থেইকা এই পথেই ট্রেন ঢুকে। যেকোন জায়গা থেইকা পাগলরা ট্রেনে উইঠা পরে। এখানে আইসা যখন দেখে ট্রেন অনেকক্ষন চলেনা, তখন নাইমা পরে। এজন্য রহনপুরে পাগল বেশি। 

তাকে নিয়ে আলাপ সম্ভবত মানুষটি পছন্দ করছেননা। লম্বা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ উঁচু করে আকাশ দেখছেন অপলক চোখে। আমাদের দিকে কোন মনযোগ নেই। পান দোকানী বললো, পাঁচ বছর ধরে সে এখানে আছে। কারো সঙ্গে কোন কথা তেমন বলেনা। তবে বাংলা কথা সে বুঝে মনে হয়। মাঝে মাঝে নাকি গ্রামের ভিতরে চলে যান তিনি। গ্রামের বয়স্ক পুরুষ- মহিলাদের কথা নাকি খুব মনযোগ দিয়ে শুনেন। বিশেষ করে মহিলাদের নাকি খুব শ্রদ্ধা করেন। পানওয়ালা বললো, কোন কাঠ মিস্ত্রি কাজ করলে সে মনযোগ দিয়ে কাজ করা দেখে। কাঠ মিস্ত্রিকে বিভিন্নভাবে কাজে সাহায্য করেন। এসব দেখে তাদের ধারণা মানুষটি মনে হয় কাঠ মিস্ত্রি ছিলেন অথবা তার পরিবার এ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

গল্প বলতে-শুনতে অনেক রাত হয়ে গেছে। মানুষটি তখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। এরমাঝে পানের দোকানে এক যুবক আসলো পান নিতে। মানুষটিকে দেখে জোর গলায় বললো, কিরে গোয়েন্দা? তাকে বললাম, এ গোয়েন্দা নাকি? যুবকটি বললো, ভাই ওর শরীর দেখেন, কোন পাগলের এত সুঠাম শরীর হয়? নিশ্চয় ও গোয়েন্দা। পান নিয়ে যুবকটি চলে গেল। পানওয়ালা নিজের দোকানের পান নিজের মুখে দিলেন। পান চিবিয়ে বললেন, ঐ মিয়া তোমার গোয়েন্দাগিরী শেষ, চাকরি নট । মানুষ বুইঝা গেছে তুমি গোয়েন্দা। পানওয়ালার কথা শুনে দুজনেই হাসতে লাগলাম। হাসলোনা শুধু আমাদের আলোচনার মানুষটি।

মানুষটি মানুষ শূণ্য অন্ধকার বাজারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে শূণ্যতা, কিছু সন্ধানের ব্যাকুলতাও ছিল। হয়তো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজছে তার ফেলে আসা আপনজনকে। হয়তো খুঁজছে তার পরিচিত বসত ভিটা। সেখানে হয়তো তার মা উঠানে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে হয়তো বাইরে বারবার উঁকি দিয়ে তার বউ অপেক্ষা করছে তার ফিরে আসার। বাবাও হয়তো রাতে না ঘুমিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আর ভাবছে, ছেলে ফিরবে। পারবে কি মানুষটা আপনজনের কাছে ফিরে যেতে! আকাশের দিকে তাকিয়ে এ ভাবনা যেন আমাদের উপরেও ভর করলো।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank