মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বেতাল গরমে তাল

ছবি ও লেখা: কমল দাশ

০১:০৪, ২০ মে ২০২১

আপডেট: ০৫:১৮, ২০ মে ২০২১

২১৫০

বেতাল গরমে তাল

কচি তাল বেজায় সুস্বাদু।  জ্যৈষ্ঠের খরতাপে এই কচি তালের শাঁস তৃষ্ণা মেটায়। কচি তালের শাঁসে যে পানি থাকে তা শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করে। শরীরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। ডাবের পানির মতোই একটি প্রাকৃতিক পানীয় খাবার এই কচি তাল। এই জন্য এর নামই দেওয়া হয়েছে পানিতাল। গ্রীস্মের এই গরমে পানিতাল খান, তৃষ্ণা মেটান। এ গরম, তাল খাওয়ার গরম। তাই বলে কেউ ‘তালপাকা গরম’র সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না কিংবা তাল পাকিয়ে ফেলবেন না যেনো! তালপাকা গরম নামে বাংলা ভাদ্র মাসে। ঘাম চিটচিটে গরম, ভ্যাপসা গরম, যা-ই বলি না কেন, তালপাকা গরম আসবে আরও পরে। এখন এই গ্রীস্মের খা খা গরমে পানিতালেই ভরসা রাখুন।

তাল নিয়ে কত কথাই না হয়। তাল কিন্তু বাঙালি জীবনে তাল বহুভাবেই আসে এবং আছে। ঘটি না ডুবলেও পুকুরের নাম ‘তালপুকুর’। কেনো তার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তবে তালগাছ পুকুরের পাড়ে বেড়ে ওঠে। হতে পারে পুকুরে পড়বে পাকা তাল। তাতে তা ফেঁটে কাদামাখা হবে না। ফলে তাল চটকে, তাল বের করে বেশ করে তাল খেতে পারবেন। তবে এখনি এসব নিয়ে ভাবতে বসবেন না যেনো। তাতে এই গরমে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারেন। আর তাতে দেখা গেলো তিলকে তাল বানিয়ে ফেলেছেন। তিলকে তাল বানাতে বাঙালির জুড়ি নেই। সে গল্পেও যাচ্ছি না। পাছে বৈদ্যুতিক ফ্যানের বাতাসে না কুলোয়! আর তালপাখার হাওয়া খেতে হয়। আর তাল পাতায় লেখা পুঁথির গপ্পে ডুবে যেতে হয়।

এরকমতো শুনেই থাকি- সবাই আছে যে যার তালে। তাই থাকুন। তাতে তালে বাজাতে পারবেন। তালে তাল মেলাতে পারবেন। বেতালে বাজিয়ে ধরা খাবেন না।

ওসব বাদ। আসুন এই তালওয়ালার গল্প শুনি। তার নাম ইদরিস আলী। বয়স কত? তা কুড়ি দুয়েকতো হবেই। কিন্তু কী তেল তেলে তালবেচা একটা চেহারা! দেখুনই না, কড়া রুপালী রোদ কৃষ্ণকপালে আর নাকে পড়ে কেমন ঝিলিক মেরেছে। তালের পসার সাজিয়েছেন চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিবাজারের সামনে।

ইদরিস আলি এসেছেন কুমিল্লার সাতঘরিয়া থেকে। সে গ্রাম নাকি তালগাছেরই গ্রাম। সেখানে শ্যামল সবুজ মাঠের পাশে সারিসারি তালগাছ। ছবি তুলতে পারলুম না। তবে ইদরিস আলীর চোখে মধ্যে দেখে নিলুম সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। অনেকেই সে দৃশ্য দেখার জন্য প্রতিবছর এসব গ্রামে ঘুরতে যায়, তা নিয়ে ইদরিস আলীর গব্বই ফুটে উঠলো মুখে। 

তালের কিছু পরিসংখ্যান, আরও কিছু খবরাখবর তার জানা। জানালেন, কেবল সাতঘরিয়া কেন সে অঞ্চলে জগন্নাথদীঘি, লালমাইসহ সতেরো উপজেলায় তালের চাষ হয়। কয়েক বছর আগে ৩২ হজার তালের চারা রোপণ করা হয়েছিল, সে তথ্যও জানালেন ইদরিস আলী।

পুরোটব না জানলেও চাঁদপুর ও  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাল গাছের চারা রোপণ করা হয় প্রতিবছর, সেটা শুনেছেন।

মূলত এসব এলাকা থেকেই চট্টগ্রামে এই সময়ে তাল আসে। পানিতাল। প্রতিদিন গড়ে ১৫ ট্রাক করে। ওদিকে ঢাকায়ও যায়। সেখান থেকে অন্যসব জেলায়ও। তবে সেখানে বিক্রিবাট্টার খবর ইদরিস আলীর জানা নেই। তিনি জানেন, চাটগাঁয়ে পানিতালের এই ভর মওসুমে প্রতিটি তাল গড়ে ২০ টাকা বিকোয়। তবে তাল বুঝে, আর তালের আকার বুঝে কেউ কেউ ৫০ টাকা পর্যন্ত দর হেঁকে ফেলেন। বিক্রিও হয়ে যায়। 

এই যে মুখে দিলেন, আর স্বাদ নিয়ে সাধু সাধু বলে তৃপ্তির ঢোক গিললেন। কিন্তু আপনার মুখে এই তাল তুলে দিতে ইদরিস আলীদের কিন্তু কম ঝক্কি নিতে হয় না। তাল গাছ ৬০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। আর তাল ধরে তার মাথায়। সেই ৬০ ফুট উচুতে মসৃন গাছ বেয়ে উঠতে হয়। কেউ কেউ বাঁশ লাগিয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু ৬০ ফুট লম্বা বাঁশ মেলা দুষ্কর। আর বেয়ে উঠতে হলে মাথার দিকটা ভীষণ মসৃণ, তা বেয়ে ওঠা যে কারো কম্ম নয়। কথায়ই বলে, তাল গাছের আড়াই হাত।

এরপর মাথায় উঠেই যে টুক করে তাল পেড়ে আনবেন, তার জো নেই। সেখানে তালের ড্যাগায়, মানে তালপাার গোড়ার থেকে পাতা পর্যন্ত দেড়-দুই ফুট মোটা চ্যাপ্টা অংশ তার দুই দিকে কড়াত মতো বসানো। যারা চাক্ষুস দেখেছেন তারা বোধ করতে পারবেন, যারা আগে দেখেননি তারা দেখলেই ভয় পাবেন। যেনো তাল মাতা তার কড়াতপাতার ঝোপ বানিয়ে তারই মধ্যে এই সুস্বাদু কচি কচি তালগুলো নিয়ে তা দিচ্ছেন। তার মধ্যধান দিয়ে এপাতা ওপাতা সরিয়ে দুএকটা আঁচড় অবধারিতভাবে খেয়ে কাস্তে চালিয়ে তবেই কেটে আনতে হয় তালের কাদি। এরপর কোমড়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া মোটা দড়িতে সে তালের কাদি বেঁধে দিয়ে ধীরে ধীরে কপিকলের মতো নামিয়ে আনতে হয় এক-এক ঝাঁক তাল। একেক বার কতোই আর হবে, বিশ-পঁচিশ কিংবা পঞ্চাশটি। তার বেশিতো নয়। এই করে করে এতো এত তাল নামিয়ে এনে গাড়িতে চাপিয়ে, চালিয়ে তবেই বেচতে আনা। তা দামতো একটু পড়বেই!

তালগাছ সব গাছের উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের জমিদার কবি, কবিগুরুর চোখও তা এড়াতে পারেনি। ভূ-বাংলার স্কুলপড়ুয়া ছেলেমাত্রই তা জানে। তালগাছে চেনা যায় নিজের গাঁ। তালে আরও কত কিছু হয়! পীঠে-পুলি-পায়েশ এইসব আর কি। সেসব পাকা তালের কাণ্ড। সে গপ্প ভাদ্রেই শোনাবো। আগে তো তাল পাকুক। এখনই শোনাতে গেলে তালগোল পেকে যেতে পারে। একে তো গরম। তায় কত্তকিছু ঘটছে আশেপাশে। পাছে তালের গল্প শোনাতে গিয়ে বেতালে না কিছু বলে ফেলি! বরং আমরা তালেই থাকি।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank