পাথরে কি ভাগ্য ফেরে?
পাথরে কি ভাগ্য ফেরে?
কি পাষাণ হৃদয় রে! রেগে মেগে এমন কথা আমরা তো কতই বলি। পাষাণ বা পাথর শব্দটার সঙ্গে একটা শক্ত শক্ত আকৃতি, একটা অনমনীয় অনুভূতি আমরা মনের চোখে দেখে থাকি। তাই হয়তো যাবতীয় কঠিন বিষয়ের সঙ্গে পাথরের উপমা জুড়ে দেয়া হয়। উপমা দেয়া হয় নিথর নিস্তব্দ বা ভারি কোনো বস্তুর সঙ্গে। সত্যিই, পাথর আমাদের অতীতের গল্প বলে। বুড়ো দাদুর মতো সে আমাদের এ পৃথিবীর পূর্ব ইতিহাসকে বলে আসছে। পাথর আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক। একথা কে না জানে যে, আগুন ছাড়া বর্তমান পৃথিবী অচল। সেই আগুনের উদ্ভব হয়েছে দু’টো পাথরের ঠোকাঠুকিতেই। পাথর শুধু পাষাণ নয়, ওই তাজমহলের পাথর, এ যে প্রেমিকের পরানের ছন্দ আনন্দের এক মিলনবাসর।
প্রশ্ন জাগে, পাথর সৃষ্টি হয়েছে কেমন করে? উত্তরে বিজ্ঞানীরা জানান, পাথর সৃষ্টি হয়েছে বালি ও পানির কণা থেকে। পাথর জড় বস্তু হলেও বড় হয়, বেড়ে উঠে। পৃথিবী তৈরিকালে যে মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং হয় এবং তা থেকে যে বিশাল শিলাখণ্ড পৃথিবীর বুকে আটকে যায়। পরে তা ই হয়ে যায় পাথর মাটি। কালের প্রবাহে অনেক শিলা ধ্বংস হয়ে মাটি তৈরি করেছে। আবার যেগুলো খুবই শক্তিশালী, সেগুলো আজও টিকে রয়েছে পাথরের পাহাড় হিসেবে।
সাধারণভাবে বলা হয় যে, পৃথিবী তৈরি হয়েছে তারকা বা নক্ষত্র থেকে। শুধু তাই নয়, সৃষ্টি হয়েছে মহাকাশের ধূলিকণা থেকে। ধারণা করা হয়, হয়তো এই ধূলিকণা এসেছে তারকা বা নক্ষত্রের বিস্ফোরণের পর। আমাদের সৌরজগতে যতো গ্রহ, গ্রহাণু রয়েছে, যা কীনা অন্যান্য সব তারকা ও নক্ষত্রের চারপাশের কক্ষপথে নিয়মিত ঘুরে বেড়ায়। সেগুলো সৃষ্টি হয়েছে মহাজাগতিক ধূলিকণা থেকে। এসব ধূলিকণা দলবদ্ধ হয়ে ছিটকে পড়েছে চারপাশে। তারপর- ধীরে ধীরে আকারে বড় হয়েছে। এসবের পেছনে প্রচুর বৈজ্ঞানিক যুক্তি রয়েছে। তবে এসব ধূলিকণা সর্বপ্রথম কোথায় এবং কিভাবে সৃষ্টি হয় বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই তার সুরাহা করতে চেষ্টা করছিলেন। স¤প্রতি যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হেইলি গোমেজ এক গবেষণায় এর সুরাহা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এসব ধূলিকণা বা আদী পাথর সৃষ্টি হয়েছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ থেকে। ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এরকম কিছু সক্রিয় ধূলিকণা, পাথরের সন্ধানও পেয়েছেন।’ বিজ্ঞানীদের এবারের গবেষণার পর এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে বিস্ফোরণের পরপরই পাথর ও ধূলিকণার সৃষ্টি হয়েছে। তারপর সেগুলো বড় হতে হতে এক সময় এই পৃথিবীর মতো গ্রহের সৃষ্টি হয়। আবার এখন থেকে কয়েক লাখ বছর আগে পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং ভূমিকম্পের কারণে পৃথিবীর অনেক জীব ও গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। মাটির নিচের প্রচুর চাপ এবং তাপে তা পরিবর্তিত হয়েও শিলা পাথরে পরিণত হয় ।
জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। পাথরের জন্ম কথা যাই হোক। পৃথিবীতে জন্মের পর থেকেই পাথরের সঙ্গে মানুষের সখ্য। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ লাখ বছর আগে মানুষ সত্যিকারভাবে পাথরের ব্যবহার শুরু করে। যাকে আমরা বলি প্রস্তর যুগ। তখন মানুষের দৈনন্দিন আসবাবপত্র, থালাবাসন, অস্ত্র সবই ছিলো পাথরের তৈরি। সে যুগের অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু আজো আমরা পাথরের মাহাত্ব্য ভুলতে পারিনি। বাড়ি বানাতে, রাস্তা তৈরিতে কিংবা ভাস্কর্য শিল্পে পাথরের বিকল্প নেই। পাথরের আবার রকমফের রয়েছে। মূল্যহীন পাথর যেমন রয়েছে। তেমনি রয়েছে অধিক মূল্যবান পাথর। যে পাথর দিয়ে আমরা রাস্তা তৈরি করছি সে পাথর দিয়ে বাড়ি তৈরি হয় না। বাড়ি বানাতে এবং সাজাতে আমরা ব্যাবহার করি শ্বেত পাথর বা মর্মর পাথর। আবার গহনা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় নীলা, চুনি, পান্না ইত্যদি উজ্জ্বল নানান স্ফটিকযুক্ত মূল্যবান পাথর। পাথরের সৌন্দর্য্য ও মূল্য একেক স্থানে একেক রকম। যেমন, পাথরের পিরামিডের সৌন্দর্য্য এক রকম। আবার তাজমহলের সৌন্দর্য্য অন্যরকম। আবার প্রাচীনকালে নির্মিত পাথরের ভাস্কর্যগুলো এক রকম। ভূতাত্বিকরা এই পাথরের স্তর দেখেই বলতে পারেন অতীতের পৃথিবী দিনের পর দিন কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে আজকের এই রুপ লাভ করেছে। পাথরের মাধ্যমেই পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের ফসিল। যা থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন আমাদের সভ্যতার ইতিহাস।
আর হ্যাঁ। নান্দনিক রঙ্গিন পাথর মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ সূত্র ধরেই সারা পৃথিবীর তথাকথিত ভাগ্য গণনাকারী ‘পাথরে ভাগ্য ফেরে’ কথাটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পাথর ভাগ্য বদল করতে পারে না এবং মুশকিল আসান করে দিতে পারে না। বিজ্ঞান প্রযুক্তির এ যুগেও জ্যোতিষীভক্ত তথাকথিত কিছু কুসংস্কারচ্ছন্ন প্রগতিশীল দাবিদার মানুষ তাদের আঙ্গুলে মুশকিল আসান পাথরের আংটি ব্যবহার করে থাকেন। এতে লাভবান হয়ে থাকেন কেবল জ্যোতিষীরা।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?