মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

জীবাণু থেকে বিদ্যুৎ

শেখ আনোয়ার

১১:৫৬, ৫ মার্চ ২০২১

আপডেট: ১১:৫৭, ৫ মার্চ ২০২১

১৫৩৯

জীবাণু থেকে বিদ্যুৎ

জীবাণু, বা অনুজীব ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অতিশয় ক্ষুদ্র হলেও এদের আক্রমণের ফলাফল যে কী সাংঘাতিক, এবার করোনা মহামারীকালে মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। জীবাণুকে খালি চোখে দেখা যায় না। সাধারণত এদেরকে আমরা শুধু বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বলেই জানি। টাইফয়েড, কলেরা আমাশয় প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হলে তখন বলে উঠি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এগুলো বাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ার নাম শুনলেই আগে মানুষের মনে ভীতি কাজ করতো। এখন আর কোন ভীতি নয়। জীবাণুকেও মানুষ করেছে জয়। এখন বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে বেসিলাস নামক ব্যাকটেরিয়াকে। এই বাকটেরিয়া উদ্ভিদ জগতে এতোটাই ক্ষুদ্র উদ্ভিদ যে, এদের খালি চোখে দেখাই মেলে না। দেখতে হলে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নিতে হয়। এ পর্যন্ত পনের’শ প্রজাতিরও বেশি ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে। সর্বপ্রথম অ্যান্টনি ভন লেভেন হুক (১৬৩২-১৭২৩) নামক একজন অনুবীক্ষণ যন্ত্র বিশারদ ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন।

ব্যাকটেরিয়া আকারে খুবই ছোট। সাধারণত ০.৫ মিউ হতে ৫ মিউ (১ মিউ সমান এক মিলিমিটারের এক’শ ভাগের এক ভাগ) পর্যন্ত। আমরা জানি, এদের আকার গোলাকার, দন্ডাকার আবার কখনও সর্পিলাকার অথবা কমা চিহ্নের মতো বক্রাকৃতি আকারের হয়। এরা পরিবেশের সর্বত্রই যেমন, পানি, বাতাস, মাটি, জীবিত এবং মৃত জৈব পদার্থে বসবাস করে। এদের দেহে সবুজ ক্লোরোফিল নেই বলে খাদ্য তৈরি করতে এরা অক্ষম। বাঁচার জন্য পরজীবি হিসেবে প্রাণী বা উদ্ভিদ দেহের উপর জন্মায়। কোন সময় মৃত জৈব পদার্থে জন্মায়। কিন্তু ভয়াবহ ব্যাপারটা কি জানেন? এই ব্যাকটেরিয়া অতিশয় ক্ষুদ্র হলেও এর আক্রমণের ফলাফল সাংঘাতিক। মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটাতে পারে।

জী না। ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতির কথা যতোই আমরা সাধারণভাবে জানি ঠিক ততোটা নয়। ব্যাকটেরিয়া কেবল মৃত্যু কিংবা মানুষের রোগই সৃষ্টি করে না। ক্ষতির পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া মানুষের কল্যাণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বরং এর উপকারিতাই বেশী। কৃষি ক্ষেত্রে, খাবার তৈরিতে, শিল্পে এদের অবদান অতুলনীয়। আমাদের চারিদিকে অহরহ গাছ-পালার পাতা, কান্ড, দেহ প্রভৃতি মাটির উপর জমা হচ্ছে। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এভাবে মানুষ এবং বহু প্রাণীর মৃতদেহ মাটির উপর এসে জমা হয়। কিন্তু এসব কয়েকদিনের মধ্যে মাটির উপর থেকে হারিয়ে যায় এবং পৃথিবীর মাটি পরিষ্কার হয়ে উঠে। তাছাড়া দই, পনির, পাউরুটি, মাখনের জন্মদাতা এই ব্যাকটেরিয়া তো আমরা জেনে শুনেই প্রতিদিন আরাম করে ভক্ষণ করে থাকি। এতে দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়া একটি উপকারী জীবমাত্র।

এই ব্যাকটেরিয়ার আরেকটি চমকপ্রদ গুণের কথা জানা গেলো এবার। বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় এই ব্যাকটেরিয়া থেকে। জী হ্যাঁ। কথাটি শুনতে অদ্ভূত মনে হলেও একেবারে সত্যি। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চার্লস মিলিকেন ও তার সহকর্মীরা ব্যাকটেরিয়া থেকে বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। তাদের আবিষ্কৃত এই বিশেষ ধরনের বাকটেরিয়ার মধ্যে দু’টো মানব কল্যাণধর্মী গুণ রয়েছে। এই ব্যাকটেরিয়া একদিকে যেমন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্যকে খাবার হিসেবে গ্রহণ করে পরিবেশ দূষণ রোধ করে, অন্যদিকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ক্ষমতা রাখে। শুধু কি তাই? এই ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারের একটি ইকেট্রনিক যন্ত্র সার্বক্ষণিকভাবে চালু রাখা যায়। এই ব্যাকটেরিয়াকে যদি পর্যাপ্ত খাদ্য যোগান দেয়া যায়, তাহলে রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা একটানা বিদ্য্ৎু উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞানী মিলিকেন জানান, ডিসালকিটো নামক এক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণায় দেখা যায়, পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী এমন বেশ কিছু পদার্থ ভেঙ্গে ফেলা ও তা থেকে বিষাক্ত অংশ আলাদা করে ফেলার ক্ষমতা রাখে এই ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া এমন সব জিনিসকে খাবার হিসেবে অনায়াসে হজম করে ফেলে যা অন্য ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে ভাবাই যায় না। বিপাকীয় সক্ষমতার কারণে এসব বর্জ্য দ্রব্যকে ব্যাকটেরিয়া অতি সহজেই বিদ্যুতের মতো জ্বালানি রূপান্তরে ব্যাপক সক্ষমতা রাখে। এই ব্যাকটেরিয়াকে ঘিরে প্রকাশিত প্রযুক্তির আওতায় বর্জ্য পানি পরিশোধনের ব্যবস্থা করা যায়। এতে করে একদিকে বর্জ্যরে পরিসর কমিয়ে তা কোন স্থানে স্থানান্তর করা যেমন সহজ তেমনি বর্জ্য পৃথকীকরণের মাধ্যমে তৈরি হয় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। বিজ্ঞানী মিলিকেন বলেন, এই ব্যাকটেরিয়ার জন্মের পর থেকে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলাকালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ কাজটিতে খুব পটু থাকে। কারণ এসময় ব্যাকটেরিয়া থাকে নির্লিপ্ত বা ঘুমন্ত অবস্থায়। এ সময় শুধু খায় আর বেড়ে উঠে এই ব্যাকটেরিয়া। অনেকটা রেশম গুটির প্রাথমিক পর্যায় লার্ভার মতো। যে কোন বর্জ্য পদার্থের ক্ষতিকারক তেজস্ত্রিয়তা এমনকি পানির প্রচন্ড স্রোতের মধ্যেও জীবন ধারণ ও বেড়ে ওঠায় কোনরূপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের বেশি অনুকূল হিসেবে কাজে লাগে। অর্থাৎ বর্জ্যরে উত্তাপ, তেজস্ক্রিয়তা কিংবা পানির স্রোত ব্যাকটেরিয়ার জন্যে কোন বাঁধা হয় না। বরং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন সভ্যতা অচল। কথাটা সবাই জানি এবং মানি। অবাক হলেও সত্যি! আমাদের দেশে এক যুগ আগে সবসময় বিদ্যুৎ থাকতো না। সন্ধ্যা বেলায় হারিকেন মোমবাতি জ্বালিয়ে শিশুদের পড়তে বসতে হতো। তখন সারাক্ষণ লোডশেডিং হতো। এই বিদ্যুতে আমাদের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বর্তমানে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। বাংলাদেশ এখন আলোয় আলোয় উজ্বল। বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ। এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে আমাদের প্রিয় গর্বের বাংলাদেশ।

কিন্তু পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্যকথা। বিদ্যুতের এই প্রচলিত উৎস বর্তমানে অপ্রতুল। তাই বিশ্বব্যাপি বিদ্যুতের অপ্রচলিত উৎস ব্যবহার এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাল উত্তীর্ণ হয়ে প্রয়োগের প্রচেষ্টা চলছে। এই অপ্রচলিত উৎসগুলোর মধ্যে জীবাণু থেকে বিদ্যুৎ একটি টেকসই উৎস হতে পারে। তাই আশা করা যায়, একদিন পরিবেশ দূষণ রোধ ও বিদ্যুৎ তৈরিতে সক্ষম হবে বর্জ্য থেকে উৎপন্ন এই জীবাণু। নব আবিষ্কৃত এই ব্যাকটেরিয়া একদিকে ঢাকার বর্জ্য শোষণ করে পরিবেশ দূষণ রোধ করবে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতেও সক্ষম হবে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank