ভালোবাসার রসায়ন
ভালোবাসার রসায়ন
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় হেনরী তখন দেশটির গদিতে। মারিয়া নামে এক অপরূপা সুন্দরী তন্বী তরুণী একদিন সম্রাটের আমন্ত্রণে রাজপ্রাসাদের ডিনার পার্টিতে নাচতে এলেন। নাচে ভীষণ মুগ্ধ হলেন সম্রাট। কথিত রয়েছে, নাচ শেষ হবার পর ঘর্মাক্ত শরীরটা একটি তোয়ালে দিয়ে মুছলেন মারিয়া। তারপর তোয়ালেটা সম্রাটের দিকে ছুড়ে মারলেন। সম্রাট সেই তোয়ালে পেয়ে ‘ভালোবাসার গন্ধে’ এমনই মাতোয়ারা হয়ে গেলেন যে, মারিয়াকে সে রাতে আর প্রাসাদ থেকে যেতে দেয়া হয়নি। তাকে নিজের জীবন সঙ্গী, সম্রাজ্ঞী হিসেবে বরণ করে নিলেন।
ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা বলতে গেলে ঘামের গন্ধের কথা না বললে চলে না। সঙ্গী নির্বাচনে শরীরের ঘামের গন্ধকে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করে বিজ্ঞান। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে ঘামের গন্ধের অনুভূতিই সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। হাল আমলের বিজ্ঞানীরা জিনের পাশাপাশি ঘামের গন্ধ পরিবহণের পিছনে এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন। যাকে বলে ফেরোমোন। ১৯৫৯ সালে বিজ্ঞানী হিল্ডা ব্রুসের ইঁদুরের উপর এক গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, মিলনের পর যদি কোন ইঁদুর অপরিচিত কোন ইঁদুরের গন্ধের খোঁজ পায় এবং মেয়ে ইঁদুরটি সেদিকে যায়। তাহলে তার জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপিত না হয়ে ঝরে পড়ে। তবে পরিচিত বা পছন্দের সঙ্গীর গন্ধ গর্ভধারণে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। তার মানে, ফেরোমোনের সাহায্যে পছন্দের সঙ্গীর মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে কিংবা বাতিল করতে পারে এ ধরণের ইঁদুর। ইঁদুরের নাকে খুঁজে পাওয়া গ্রাহকগুলো ফেরোমোন সনাক্ত করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক ইঁদুরের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ফেরোমোনের গ্রাহক জিন খুঁজে পান, তার অন্ততঃ ছয়টি মানুষের মধ্যেও পাওয়া যায়।
গ্রিক শব্দ ফেরো এবং হরমোনকে সমন্বয় করে ফেরোমোন নামকরণ করা হয়। ফেরো অর্থ ‘আমি বহন করি’ এবং ‘হরমোন’ অর্থ নিঃসরিত হওয়া। এটি এমন এক রাসায়নিক বস্তু, যা স্বতন্ত্রভাবে শরীরের বাইরে ক্ষরিত হয় এবং হরমোনের মতো আচরণ করে। প্রানীজগতে ফেরোমোনের ভূমিকা খুব ভালোভাবে প্রমাণিত এবং মানুষের মধ্যে এর সরাসরি সম্পর্ক খুব জোড়ালো। তবুও সমালোচকরা বলেন, ‘একথা ঠিক, অন্য প্রানী তাদের বেঁচে থাকা এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘামের গন্ধের উপর খুব বেশি মাত্রায় নির্ভর করে। তবে বিবর্তনের ক্রমধারায় ঘামের গন্ধের উপযোগিতা এবং গুরুত্ব মানব প্রজাতিতে কমে এসেছে। মানুষ তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবনেন্দ্রিয় কিংবা বুদ্ধিমত্তার উপর যেভাবে নির্ভর করে ঠিক তেমনভাবে সঙ্গীর ঘামের গন্ধের উপর নির্ভর করে না।’ এরপরও ঘামের ফেরোমোনের গন্ধে ভালোবাসার নিশ্চিত প্রমাণ দিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘আচার-আচরণ, শরীর কাঠামো বা দৈহিক সৌন্দর্য্য শক্তিকে প্রাধান্য দেয় না আজকালের প্রেমিক-প্রেমিকারা। তারা শরীরের গন্ধকেই বেশি প্রাধান্য দেয়।’
অন্য প্রানীদের মতো মানুষের জীবন যাত্রাতেও ফেরোমোনের প্রভাবের ব্যাপার নিয়ে গবেষনা করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্থা ক্লিনটক এবং ক্যাথলিন স্টার্ণ। গবেষণা থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে বা ছাত্রী-হোস্টেলে একই কক্ষে একাধিক ছাত্রীরা অবস্থান করলে তাদের ঋতু বা রজঃস্রাব একই সময়ে হয়ে যায়। এই রহস্যময় ব্যাপারকে বলে মিনস্ট্রুয়াল সিনক্রনি। মার্থা ক্লিনটক তার গবেষণাপত্রে দেখান, এর পেছনে মূখ্য ভুমিকা পালন করে ফেরোমোন। ফেরোমোন প্রবাহের কারণেই এমনটি হয় বলে বেশ কিছু গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৯৮ সালে মার্থা ক্লিনটক তার আগের গবেষণাকে আরো বিস্তৃত করে এই পরীক্ষায় দেখান, ফেরোমোন মিনস্ট্রুয়াল সিনক্রনি করে শুধু তা কিন্তু নয়। মেয়েদের অনিয়মিত মাসিককে নিয়মিত করতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। গবেষণায় বলা হয়, প্রেমিক পুরুষের গায়ের গন্ধ বা ঘাম মেয়েদের ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। ভালো লাগার ছেলের ঘামের গন্ধের প্রতি মেয়েদের অবচেতন আকর্ষণ খুব সম্ভবতঃ বিবর্তনজনিত। স্নায়ুবিজ্ঞানী লোয়ান ব্রিজেন্ডিন তার সা¤প্রতিক ‘মেইল ব্রেইন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- নতুন গন্ধটি টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে পুরুষের দেহজ ঘামগ্রন্থি থেকে নির্গত ফেরোমোন এবং অ্যান্ড্রোস্টেনেডিওনের একধরণের সুষম মিশ্রণ। প্রিয় পছন্দের ছেলের এই গন্ধটা মেয়েরা পায় প্রবৃত্তিগতভাবে। ঘ্রাণজ আবরণীকলার মাধ্যমে নয়। বরং এর বাইরে আরেকটি পৃথক অঙ্গের মাধ্যমে। যাকে বলে ভোমেরোনাসা তন্ত্র। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে ভোমেরোনাসা তন্ত্র নামক পৃথক একটি তন্ত্র ফেরোমোন সনাক্ত এবং প্রবাহে ভূমিকা রাখছে ।
ঘামের গন্ধ যে প্রেম, ভালোবাসা, মানুষের মনের মর্জি পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে তা আমরা প্রাত্যহিক জীবনের নানা উদাহরণ থেকে খুব সাধারণভাবেই জানি। ঘামের গন্ধ তৈরি হয় ঘামের ব্যাক্টেরিয়া পচনের ফলে। যা আবহাওয়ায় ছড়ায় কিছু সময়ের জন্য। ঘামের পঁচা গন্ধ আমরা অপছন্দ করি বটে! খুব সূক্ষ্ম সচেতনভাবে ঘ্রাণ নিলে এই পঁচা গন্ধের মধ্যে দেহজাত খুবই সূক্ষ্ম গন্ধ পাওয়া যায়। এটিই ফেরোমোন। আমরা যতই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকি না কেনো, গন্ধটা সবসময়ই দেহ থেকে বের হতে থাকে। টিনেজ ছেলে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে তাদের দেহ হয়ে উঠে নানা নতুন ধরণের গন্ধের ভান্ডার। যা তার আগেকার শিশু বয়সের গন্ধ থেকে একেবারেই ভিন্ন। বিজ্ঞানী ক্লাউস ওয়্যাই, ক্যারোল ওবার, তামারা ব্রাউনসহ অনেকের মতে, ‘আমাদের ডিএনএতে প্রকাশিত এই ভালোবাসার সংকেতগুলো শেষ পর্যন্ত ফেরোমোন প্রবাহের মাধ্যমে মস্তিকে পৌঁছায়। যার ভিত্তি মূলতঃ লুকিয়ে রয়েছে সঙ্গীর গায়ের গন্ধের মধ্যেই।’ এখন তাই বিলিয়ন ডলারের ম্যাচমেকিং সাইটগুলো ভালোবাসার রসায়ন বুঝতে ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি গায়ের গন্ধ নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে দৃঢ়ভাবে বলা যায়, আর সব প্রানীর মতো মানুষও অবচেতন মনেই গন্ধ শোঁকার মাধ্যমে সঙ্গী বাছাইয়ের কাজটি করে থাকে।
গবেষকরা জোর দিয়ে বলেন, প্রানীদের মতো মানুষও গন্ধের মাধ্যমে জিন সনাক্ত করতে পারে বলেই বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের পরিবারের সদস্যদের ঘামের গন্ধে যৌন আকাংক্ষায় উদ্দীপ্ত হয় না। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন অন্য প্রানীদের মতো মানুষও অবচেতনভাবেই ঘামের গন্ধের সাহায্যে ব্যাপারটির ফয়সালা করে। বিবর্তনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমাদের প্রবৃত্তিগুলো এমনভাবেই তৈরি হয়ে গেছে। যার প্রমাণ দিয়েছেন জীববিজ্ঞানী ক্লাউস তার গবেষণায়। সুইজারল্যান্ডের বার্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ১০০ জন কলেজ ছাত্রকে আলাদা করে তাদের সুতির টি শার্ট পরিয়ে রাখেন দু’দিন ধরে। সেই দু’দিন তারা কোন ঝাল-ঝোল খাবার খায়নি, ধূমপান করেনি, কোন ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করেনি, এমনকি কোন সুগন্ধী সাবানও নয়। যাতে নমুনাক্ষেত্র প্রভাবান্বিত হবার ঝামেলা না হয়। এরপর তাদের টিশার্ট একত্রিত করে আরেকদল অপরিচিত ছাত্রীদের দিয়ে শোঁকানো হয়। তাদের গন্ধ শুঁকে বলতে বলা হয় কোন টি শার্টের গন্ধকে তারা নিজ নিজ পছন্দের গন্ধ, আবেদনময় গন্ধ বলে মনে করে?
দেখা যায়, মেয়েরা সে সমস্ত টিশার্টের গন্ধকে পছন্দ করেছে, যে সমস্ত টি-শার্টের অধিকারীদের দেহজ জিন নিজেদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আর যাদের জিন নিজের জিনের কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয়, তাকে মেয়েরা অনেকটা নিজের ভাই এর মতো জ্ঞান করে থাকে! সেক্ষেত্রে ঘামের গন্ধ অগ্রাহ্য করে, জোর করে কিংবা অন্য কোনভাবে সঙ্গী করা হলেও সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ হয় বলে বিজ্ঞানীরা আশংকা ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং ভালোবাসার দিনে প্রেমিক-প্রেমিকা ঘামের গন্ধ ফেরোমোন ছড়ালেই তো হবে না। সেটা গ্রহণ যে করবে তার কাছে ‘যুৎসই’ লাগে কী না সেটিও নিজে নিজে পরখ করে নেয়া জরুরি।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?