এলইডি’র আলো কতোটা ভালো
এলইডি’র আলো কতোটা ভালো
ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের সড়কে রাতের অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলা হলুদ ফ্যাকাশে পুরনো সোডিয়াম আলোর বাতি এখন আর নেই। শহরের রাস্তাঘাটে আলোর পরিমাণও আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এর কারণ লাইট ইমিটেটিং ডায়োড বা এলইডি নামক বাতি স্থাপন। বর্তমানে অত্যাধুনিক এলইডি বাতিতে আলো ঝলমলে রূপ পেয়েছে ঢাকা। আগে সন্ধ্যার পর পরই চলাচল করতে ভয় লাগতো। রাস্তা পুরো অন্ধকার হয়ে থাকতো। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট পুরোটাই বদলে গেছে। দিনের আলো শেষে রাতের অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠছে এলইডি বাতি। সন্ধ্যা হলেই আলোয় ঝলমল হয়ে উঠছে পুরো এলাকা। যতদূর চোখ যায় এলইডি বাতির কারণে স্পষ্ট দেখা যায়। ঝলমলে আলোয় আলোকিত এলাকায় চলাচল অনেকটা নিরাপদ মনে হয়। এলইডি বাতিতে আলোকিত হওয়ায় সঙ্গে সিসিটিভি ক্যামেরার কারণে কমেছে ছিনতাকারী, মাদকসেবীদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড।
শুধু রাস্তায় নয়। যতো দিন যাচ্ছে, ততোই ঘরের ভিতরে ও বাইরে এলইডি আলোর ব্যবহার বাড়ছে। এলইডির সুবিধা অনেক। টিউবলাইট বা অন্যান্য লাইট থেকে যতোটা আলোকশক্তি বেরিয়ে আসে, ততোটাই আলো বেরিয়ে আসে অনেক কম ক্ষমতার, কম ওয়াটের এলইডি আলো থেকে। দেখা যায়, ১০০ ওয়াটের টিউবলাইট যতোটা আলো দেয়, মাত্র ২০ ওয়াটের এলইডি বাল্ব আলো দেয় ততোটাই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলইডি আলোর বাল্বগুলো টেকেও অনেক দিন। ফলে বিদ্যুৎশক্তির ব্যবহার কমে গেছে ৮০ শতাংশ। এলইডি বাতি স্থাপনের ফলে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। আগে যারা বিদ্যুৎ খরচের ভয়ে রাতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানোর আগে দু’বার ভাবতেন, সস্তায় উজ্জল হয়ে যাচ্ছে বলে তারাও এখন যত্রতত্র এলইডি আলো ব্যবহার করছেন। বিদ্যুতের খরচ কমাতে মানুষ কম ওয়াটের এলইডি আলো বেশি কিনছেন ও ব্যবহার করছেন। এতে বিদ্যুৎ ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি বেশি আলো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে, অনেক বেশি পরিমাণে এলইডি আলোয় ভরে উঠছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্যকথা। আলোয় ভরিয়ে আমরা রাতকে দিন করে ফেলছি বটে, কিন্তু তার ফলটা মোটেই ভালো হচ্ছে না। রাতে এলইডি আলোর যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের ঘুম কমিয়ে দিচ্ছে তো বটেই। মানুষের নানা রকমের শারীরিক সমস্যাও তৈরি করছে। ক্ষতি করছে আমাদের চারপাশে থাকা অণুজীবদেরও। তারাও ওই কৃত্রিম আলোর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছে না।
এলইডির আলো নিয়ে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা হতবাক! সাধারণ এলইডি স্ট্রিট লাইট এবং বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ডে ব্যবহৃত লাইট থেকে নির্গত নীল আলো প্রোস্টেট ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে এক গবেষণা থেকে। বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ এবং ব্রিটেনের গবেষকরা জানিয়েছেন, বড় বড় শহরে রাতের বেলায় যারা এই নীল আলোর কাছাকাছি দীর্ঘক্ষণ থাকেন তাদের প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ১.৫ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া স্তন ক্যানসারের আশঙ্কাও করা হয় এলইডির কারণে।
প্রসঙ্গত স্তন ক্যানসার এবং প্রোস্টেট ক্যানসার, দু’টোই হরমোনের সঙ্গে যুক্ত। শরীরে হরমোনের ওপর প্রভাব ফেলে এই এলইডি। এ সংক্রান্ত তথ্য এবং গবেষণা এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সপেক্টিভ এ প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, একথা ঠিক, ক্ষতিটা বেশি করছে নীল রংয়ের এলইডি আলোয়। নীল রংয়ের এলইডি আলো মানুষের বেশি পছন্দের হলেও তা ঘুম কমিয়ে দিচ্ছে। এলইডির এই নীল রশ্মির জন্য শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। এবার স্মার্টফোন এবং ট্যাবলেট থেকে নির্গত এলইডি’র নীল আলো কতটা ক্ষতি হচ্ছে এ বিষয়ে জোরদার গবেষণার কাজ এগিয়ে চলছে। গত বছর মার্কিন মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সতর্কতা জারি করে নীল রংয়ের এলইডি আলোর ব্যবহার কমাতে বলা হয়। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২০, এই ৫ বছরে কৃত্রিম আলো বিশ্বের দিন-রাতের ভেদ-রেখা মুছে দিয়েছে। এ সময়ে ভূপৃষ্ঠের কৃত্রিম ভাবে আলোকিত এলাকা ফি বছরে বেড়েছে ২.২ শতাংশ হারে। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতের সংখ্যা পৃথিবীতে যথেষ্টই কমে গেছে।
গবেষণাপত্রে যে চিত্রটি বেরিয়ে এসেছে, আদতে পরিস্থিতি তার চেয়েও বেশি খারাপ বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, যার থেকে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, সেই এলইডি থেকে যে নীল আলো বেরোয়, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য মহাকাশে থাকা উপগ্রহগুলো থেকেও মাপা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি এলইডির নীল আলোও মাপা যেতো, তাহলে দেখা যেতো রাতগুলো আরও বেশি আলোকিত হয়ে গেছে। জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার কাইবা বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার রাতগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি আলোকিত ও ঝকঝকে হয়ে গেছে। আলো ঝলমলে রাতের সংখ্যা বেশি বেড়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। দাবানলের কারণে অবশ্য কিছুটা কমেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়।’ গবেষকরা বলছেন, এর ফলে এমন একদিন আসবে, যখন ধনী দেশগুলোর মানুষ সুস্বাস্থ্যের জন্যে রাতের আকাশকে আরও বেশি অন্ধকার দেখতে চাইবেন। ঘরও রাখতে চাইবেন ঘুটঘুটে জমাট অন্ধকার।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?