শূন্যের সংখ্যা হয়ে ওঠার লড়াই
শূন্যের সংখ্যা হয়ে ওঠার লড়াই
শূন্য (০) সংখ্যাটি ছাড়া গণিতের হিসাব- নিকাশ অসম্ভব। এখন কেউ যদি এসে বলে- শূন্য বলে নেই কোন সংখ্যাই। বোকার মত শোনাবে না? তবে একটা সময় কিন্তু ছিল এমনই। বহু পথ পাড়ি দিয়ে, বহু সভ্যতা ঘুরে ফিরে- তবেই শূন্যের আজ সংখ্যা হয়ে ওঠা, শূন্যের বৃত্ত (০) রূপ অর্জন। জানতে হলে, যেতে হবে বহু যুগ পেছনে।
প্রথমেই সুমেরীয় সভ্যতার কথা
প্রায় ৪০০০-৫০০০ বছর আগের কথা। লেখা ও গণনার পদ্ধতি একই সঙ্গে প্রথম আবিষ্কার হয়েছিলো সুমেরীয় সভ্যতায়। সাধারণত সে সময় সুমেরীয়রা লিখে রাখতো বিভিন্ন সংখ্যা বা হিসাবপত্র। তবে শূন্যের বেলায় ছিলো গা ছাড়া এক ভাব। শূন্য ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লেই জায়গাটা খালি রেখে চলে যেত তারা।
জেনে নিই ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ইতিহাস
কিছু সময় পর এ সভ্যতার মানুষও অনুসরণ করেছিলো সুমেরীয়দের গণনা পদ্ধতি। ফলে তাদের কাছেও শূন্য বলতে পাত্তা ছিল না কোন সংখ্যারই। কিন্তু আজ যেমন শূন্য ছাড়া আমাদের গণিতবিদ্যা অচল, তখনও ঠিক তাই হবার দশা। পাত্তা না দিলেও, একেবারেই যে ফেলে দেয়া যেত না শূন্যকে। ব্যাবিলনীয়রা তাই শূন্যকে প্রকাশ করতে শুরু করলো (’’) এ রকম কোণাকৃতি সংকেত হিসেবে। কোথাও আবার দুটির বদলে ব্যবহার করা হতো (’) একটি কোণাকৃতি সংকেত রূপে। আজকের দিনে এমন হলে কেমন হতো ভাবা যায়! স্কুলে একজন শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ১০। পরীক্ষার খাতায় তাকে লিখতে হতো ১’’ বা ১’। মোবাইল নম্বরের বিষয়টা ভাবলে তো আরও বেশি মুশকিলে পড়ার দশা। আমাদের দেশের সব মোবাইল নম্বর তো শুরুই হয় শূন্য ব্যবহার করে। লেখার সময় না হয় রোল নম্বরের মতোই লেখা যেত একই ভাবে, কিংবা কল করার সময় মোবাইলের বাটনে অপশন রাখারও ব্যবস্থা করতো মোবাইল কোম্পানিগুলো। কিন্তু মুখে কী করে বলতাম আমরা! শূন্য সংখ্যা না হোক, অন্ততপক্ষে এ জন্য হলেও তো প্রয়োজন পড়তো শূন্য নামের। অথচ শূন্য নামেরও নেই কোন নাম- গন্ধ।
উল্টো লাফে এক সভ্যতা পেছনের ইতিহাস আঁকড়ে ধরেছিলো মায়া সভ্যতা
আরও ৬০০ বছর পরের কথা। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পুরনো সভ্যতাকে বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো মায়া সভ্যতার গণিতবিদদের। বাস্তবে ঘটলো তার উল্টো। খানিকটা এগিয়ে না গিয়ে, পেছনের দিক থেকে দিয়ে লাফিয়ে ব্যাবিলনীয়দের টপকে এ সভ্যতার লোকেরা আঁকড়ে ধরলো সুমেরীয়দের চিন্তা ও চেতনা। বলাই বাহুল্য, সুমেরীয়দের দেখা দেখি এরাও ক্যালেন্ডারে শূন্যকে রাখতে লাগলো ফাঁকা জায়গা হিসেবেই।
ঘুরে আসা যাক পিরামিডের রাজ্যে
জ্ঞান- বিজ্ঞানের দৌড়ে ধীরেধীরে সবাইকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো মিশরের লোকেরা। জ্যামিতি আর জ্যোতির্বিজ্ঞানে একের পর এক সব আবিষ্কারে তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলো গোটা বিশ্বকে। সেখান থেকেই শূন্যের প্রয়োজনটা বুঝতে শুরু করে মিশরের গণিতবিদরা। কিন্তু জেগে থেকে ঘুমের ভান ধরলে কি আর ঘুম ভাঙানো যায়! তাদের বেলায়ও ঠিক তাই। শূন্য এলেই কোনরকম পাশ কাটিয়ে বাঁচতো এ মহাশয়রা। সবার মনে হতে পারে- নতুন একটা সংখ্যা এলেই বা কী দোষ! জেনে বুঝেই বা কেন জোর করে সরিয়ে রাখা হচ্ছে একে! বড় বড় গণিতবিদদের কেনই বা এত কিপটেমি, তাই না? আসলে শূন্যের গুরুত্ব তারা বুঝতে পেরেছিলো ঠিকই। কিন্তু তাকে মেনে নিয়ে সংখ্যার মর্যাদা দেয়ার বেলায় ছিলো যত গোঁড়ামি। তাদের ধারনা ছিলো, ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হয় শূন্যর মাধ্যমে। যুক্তি ছিলো- “শূন্য মানেই ঈশ্বর নেই” এমন। তাই শয়তানের বন্ধু এবং ঈশ্বরের বিরোধী ভেবেই মিশরীয়দের শূন্যকে এমন জেনে বুঝে দূরে সরিয়ে রাখা।
শূন্যকে অপছন্দ করতো পন্ডিত মশাই পিথাগোরাসও
গ্রীক পন্ডিত পিথাগোরাসের নাম কে না জানে! শূন্যের অস্তিত্ব খুব ভালো করেই টের পেয়েছিলেন তিনি। এরপরও আর সবার মতো তিনিও বাদ রাখতেন না নাক সিটকানো। যদিও তাঁর অসুবিধে অন্য এক জায়গায়। পিথাগোরাস বাদ্যযন্ত্র বাজাতে ভীষণ পছন্দ করতেন। আর যন্ত্রণাটা ছিলো সেখানেই। বাদ্যযন্ত্রের তারগুলো শূন্য বা অমূলদ সংখ্যার মানে বাজালেই, সুরগুলো শোনাতো যাচ্ছে তাই। এ থেকেই তাঁর মনে হয়েছিলো, শূন্য ও অমূলদ সংখ্যাগুলো ভারী দুষ্টু। নিয়ম মানার বালাই নেই এদের।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই ক্লাইমেক্সের শুরু
বাকিসব সভ্যতায় শূন্যকে তাচ্ছিল্য করা হলেও, ভারতীয় উপমহাদেশ ছিলো এ ক্ষেত্রে বেশ ভিন্ন। তাদের কাছে শূন্য মানেই অসীম, আর অসীম হলো ঈশ্বর ব্রহ্মার প্রতীক; তবে সংখ্যা আকারে তখনও দেখা মেলেনি শূন্যের।
৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে প্রথম অস্তিত্ব পাওয়া যায় শূন্যের। সেখানে সংস্কৃতি ভাষায় একে নির্দেশ করা হয়েছিলো “খালি জায়গা বা শূনিয়া” বলে। ভারতীয়রা পরে জানতে পারলো ব্যাবিলনীয়দের গণনা পদ্ধতির কথা, যেখানে শূন্যকে তারা সংখ্যার মান দেয়নি; কিন্তু একটি আলাদা জায়গা হিসেবে নির্দেশ করেছে ঠিকই। এরপরই ভারতীয়রা শূন্যকে স্থান দেয় সংখ্যা মালায়। শূন্য জায়গা পায় দশম সংখ্যা রূপে। ধারাবাহিক ভাবে সে সময় ১-৯ এর পরের সংখ্যাটি ছিলো শূন্য।
শূন্যের সংখ্যা হওয়া
ভারতীয় উপমহাদেশের এক গণিতবিদের নাম ব্রহ্মগুপ্ত। সংখ্যা হিসেবে শূন্যের প্রথম ব্যবহার তাঁর হাত ধরেই। শূন্য হিসেবে ডট চিহ্ন ব্যবহার করতেন তিনি, ঠিকঠাক মতো যোগ- বিয়োগ, গুণও করেছিলেন শূন্য ব্যবহার করে; কিন্তু ভাগ করার সময় এসে বাঁধে গোলমাল। ব্রহ্মগুপ্তের মতে- শূন্য দিয়ে কোন সংখ্যা ভাগ করলেও, গুণের মতো শূন্যই হবে। পরে আরেক ভারতীয় গণিতবিদ ভাস্কর তাঁর এ ভুলটি ধরিয়ে দেন।
শূন্যের শূন্য (০) রূপ
৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে শূন্য এসে পৌঁছায় বাগদাদ শহরে। ভারতীয় গণিতবিদদের থেকে শূন্য সংখ্যার ব্যবহার শিখে নিয়েছিলো আরবরা, সংখ্যা মালায় জায়গাও দেয় একে। এ ভাবেই চলছিলো, এক পর্যায়ে পারস্যের গণিতবিদ মুসা আল খোয়ারিজমি শূন্যকে রূপ দেন বৃত্ত(০) আকারে। আমরা যাকে আজ শূন্য হিসেবে চিনি- জানি; যদিও তিনি এর নাম দিয়েছিলেন “সিফর”। কালের পরিক্রায় সে সিফর আবার গিয়ে পৌঁছায় ইউরোপীদের হাতে, সেখান থেকে আরেকটু ঘুরে ফিরে শেষমেশ সেটি পরিচিতি পায় শূন্য নামে।
এ ভাবেই বহু পথঘাট পেরিয়ে, সমুদ্র- আকাশ পাড়ি দিয়ে সেদিনের শূনিয়া বা সিফর হয়ে ওঠে আজকের শূন্য(০) নামে, শূন্য রূপে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?