মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার ঐতিহ্য মেলের তৈরি মাদুর

এসএম শহীদুল ইসলাম, সাতক্ষীরা

১৪:০০, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০

১৪২৫

বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার ঐতিহ্য মেলের তৈরি মাদুর

প্লাস্টিকের দৌরাত্মে বিলুপ্তির পথে মেলেঘাসের তৈরি মাদুর শিল্প। সাতক্ষীরাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে এক সময় চাষ হতো মেলে ঘাস। মেলেঘাস চাষ হতো মাদুর শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে। কিন্তু মেলে চাষের জমিতে মাছের ঘের হওয়ার কারণে মাদুর শিল্প আজ ধ্বংসের শেষ প্রান্তে উপনীত। এভাবেই বলছিলেন সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কচুয়া গ্রামের মেলেচাষী রেজাউল ইসলাম। 
তিনি বলেন, আশাশুনি, পাইকগাছা ও কয়রা অঞ্চল মূলত মাদুর শিল্পের জন্য গোটা দেশে পরিচিত। মাদুর বোনার কাজটি পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও করে থাকেন। কয়েকটি পরিবারের নারীরা একত্রে বসে পাল্লা দিয়ে বুনতো মাদুর। পাটের তৈরি সুতলি আর মেলেঘাস দিয়ে তৈরি হয় মাদুর। একটি পাটাতনে সুতলি বিশেষ কায়দায় টানটান করে সারি সারি বাঁধার পর তাতে একটি একটি করে বোনা হয় মেলে। ভাজ ও নকশার জন্য জানতে হয় বুননের কৌশল। কয়েক পরিবারের নারীরা বাড়ির উঠোনে বসে মাদুর বুনতো আর তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনার গল্প। মেলের প্রতিটি বুননের মাঝেই লুকিয়ে থাকতো একেকটি পরবারের প্রতিচ্ছবি। 

দুই দশক আগেও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার তেঁতুলিয়া, কাদাকাটি, কচুয়া, বড়দল, গোয়ালডাঙা, মহিষাডাঙা, খাজরা, কল্যানপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো ‘মেলে’ দিয়ে হাতে তৈরি মাদুর বিক্রি করে। অথচ বর্তমানে এসব গ্রামটি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার। যারা এখনো মাদুর তৈরি করছেন, কাঁচামাল সংকট ও বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় তারাও এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার কথা ভাবছেন। সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে জেলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পটি অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

দেশের বাজারে সাতক্ষীরার মাদুরের ভালো চাহিদা থাকায় মাদুর তৈরির মূল কাঁচামাল মেলে ঘাস উৎপাদন করতেন বহু কৃষক। কিন্তু মাদুরের চাহিদা ও দাম কমতে থাকায় কৃষকরা এখন আর তেমন মেলে উৎপাদন করছেন না। তাছাড়া যেজমিতে মেলে চাষ হতো সেই জমিতে এখন মাছ চাষ হয়। ফলে মাদুর শিল্পীদের কাছে কাঁচামালটি হয়ে পড়েছে দুর্লভ।

আশাশুনির সুব্রত দাশ ও গোবিন্দ মন্ডল বলেন, মাদুর তৈরি করে এখন আর তেমন লাভ হয় না। তাছাড়া কাঁচামাল মেলে ঘাস এখন আর ঠিকমতো পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায়, তার দাম অনেক বেশি। এদিকে এক জোড়া বড় আকারের মাদুর তৈরিতে ৫০০ টাকা খরচ হলেও বাজারে দাম পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা। সারা দিনে এখন বেশি হলে তিনি দুই জোড়া মাদুর তৈরি করতে পারছেন। এ থেকে যা লাভ হয়, তা দিয়ে সংসার চলে না। শুধুমাত্র বংশগত পেশার কারণেই তিনি এখনো এ কাজ ধরে রেখেছেন। আশাশুনির কাদাকাটি এলাকার মনোয়ারা খাতুন বলেন, আগে এ এলাকায় অন্তত ৫০০ পরিবার মাদুর তৈরি করতো। কিন্তু লোকসানের কারণে এ পেশায় এখন ৫০টি পরিবারও যুক্ত নেই।

এদিকে আশাশুনির তুয়ারডাঙ্গা গ্রামের তারাপদ মন্ডল বলেন, তারা চার পুরুষ ধরে মাদুর তৈরি করছেন। কয়েক বছর আগেও তাদের তৈরি মাদুর খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও কয়রার মোকামে বিক্রি হতো। ভালো চাহিদার কারণে মেলে ঘাষ চাষ হতো প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু এখন আর মেলে পাওয়া যাচ্ছে না, যা মাদুর উৎপাদনের প্রধান অন্তরায়। তাছাড়া বাজারেও মাদুরের যে দাম, তাতে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকছে খুবই সামান্য।
তিনি আরও বলেন, আগে সপ্তাহে যেখানে ২০০-২৫০ জোড়া মাদুর তৈরি হতো, সেখানে বর্তমানে তৈরি হচ্ছে ৮-১০টি। মূলত মেলে সংকটের কারণেই এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। ফলে এ গ্রামের মাদুর শিল্পীরা অন্য পেশায় চলে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ জেলার বাইরে ইটভাটায়, কেউবা সাতক্ষীরা ও খুলনা শহরে ভ্যান চালাচ্ছেন।

এদিকে সাতক্ষীরা সুলতানপুর বড় বাজারের পাইকারি মাদুর ব্যবসায়ী কওছার আলী জানান, তিন দশক ধরে তিনি মাদুরের ব্যবসা করেন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাদুর কিনে তা জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করেন তিনি। এখন প্রতি জোড়া মাদুর আকারভেদে ৩০০ থেকে ৬৫০ পর্যন্ত টাকা দরে বিক্রি করছেন। কিন্তু প্লাস্টিকের মাদুর বাজারে আসায় মেলের তৈরি মাদুরের চাহিদা অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের তৈরি একটি মাঝারি আকারের মাদুর বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। এর বিপরীতে মেলের তৈরি একটি মাদুরের দাম পড়ছে ৩০০-৩৫০ টাকা। ফলে ক্রেতারা আর মেলের তৈরি মাদুর কিনছেন না।

সাতক্ষীরা শিল্প ও বণিক সমিতির পরিচালক মনিরুল ইসলাম মিনি বলেন, মেলে দিয়ে তৈরি মাদুর এ জেলার ঐতিহ্য। আশাশুনিতে একসময় মাদুর তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিল অন্তত চার হাজার পরিবার। এখন এ সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এখানকার মাদুর একসময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এ শিল্প চরম সংকটে পড়েছে। এর সঙ্গে জড়িতরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ফলে এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হলে সংশ্লিষ্টদের সহজ শর্তে ঋণের পাশাপাশি প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাবে এই মাদুর শিল্পটি।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank