পোকামাকড় থেকে ওষুধ
পোকামাকড় থেকে ওষুধ
পোকামাকড় শব্দটার সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষের জড়িয়ে রয়েছে ঘৃণা ও বিরক্তি। থাকবে না-ই বা কেনো। কোনটা ফসলের ক্ষতি করে, কোনটা রোগ ছড়ায়, কোনটা খাবার-দাবার নষ্ট করে আবার কোনটা বিষাক্ত কামড় বা হুল ফুটিয়ে যন্ত্রণা দেয়। আবার কোনটা বইপত্র আসবাব কেটে-কুটে নষ্ট করে। অবশ্যই পতঙ্গ আমাদের যে উপকার করেনা তা কিন্তু নয়। মৌমাছি, রেশমকীট, লক, এগুলো যুগ যুগ ধরে মানুষের আর্থিক উন্নয়নের সাহায্য করে আসছে। অসংখ্য কীপটতঙ্গ ফুলের পরাগ মিলন ঘটিয়ে ফল ও বীজ উৎপাদনে সাহায্য করছে। কিন্তু ওষুধ হিসেবেও যে পোকামাকড় ব্যবহৃত হতে পারে, এটা কিন্তু বেশি লোকের জানা নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনা চিকিৎসকদের বেশ নজর কাড়ে। যেসব সৈন্য আহত হয়ে দীর্ঘ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকতো তাদের ক্ষতস্থানে কোনো রকম সংক্রমন (যেমন, অস্টিওমায়েলাইটিস, এই রোগে হাড়ের যন্ত্রণা হয়) ঘটতো না। অনুসন্ধানকারীরা দেখলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা আহত সৈন্যদের ক্ষতস্থানে এক ধরনের মাছি ডিম পেড়ে যায়। সেই ডিম ফুটে, শুককীট বা লার্ভা বেরোয় তা ক্ষতস্থানের সংক্রমণকে গভীর থেকে পরিষ্কার করে দেয়। আর এটা নাকি ডাক্তারদের চেয়েও ভালো পারে ওই শুককীটগুলো। তখন থেকেই সেই মাছিগুলোর চাষ শুরু হলো। মাছিগুলোর নামও অদ্ভূত। যেমন: নীল বোতল মাছি, সবুজ বোতল মাছি ইত্যাদি। এসব মাছির শুককীটের দেহ নি:সৃত পদার্থের নাম হলো অ্যালানট্রোইন যা ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। বর্তমানে আলানট্রোইন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। দামও বেশি নয়। মারাত্মক ঘা, পোড়া ক্ষত, অস্থি-মজ্জার সংক্রমণ প্রভৃতি নিরাময়ে আজ আলানট্রোইন ব্যবহৃত হয়। এবার মাছি মাত্রই ক্ষতিকর, তা আর বলা যাবে কি?
ছারপোকার নাম শুনলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে। রক্ত চুষে খায়। দুর্গন্ধ আর ঘুমের মধ্যে বিছানায়, ট্রেনে বা থিয়েটার-সিনেমা হলে নাটক সিনেমা দেখার সময় চেয়ারে বসলে ছারপোকা দংশনের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। শুনতে অবাক মনে হলেও কথাটা সত্যি। এই ছারপোকা থেকেও নাকি ওষুধ হয়। এক জাতের ফনিমনসা গাছে মিলি বাগ নামে এক রকম ছারপাকা থাকে, এই ছারপোকা থেকে খুব সুন্দর লাল রঙ পাওয়া যায়। এই রঙের নাম ককিনিয়াল। এটি প্রসাধনী দ্রব্য তৈরিতে, বাহারি কেক সাজাতে, মদ ও ওষুধের রঙ হিসেবে এবং স্থায়ী রঞ্জক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া যন্ত্রণা উপশম করতে এবং হুপিং কাশি ও ¯œায়ু শুলের চিকিৎসায় ককিনিয়াল ব্যবহৃত হয়। এজন্য এই ছারপোকা এখন মেক্সিকো, পেরু ও স্পেনে চাষ করা হচ্ছে। চাষের পদ্ধতি অদ্ভূত। চাষ হয় ঘরের ভেতর। শীতকালে ছারপোকাসহ ফনিমনসার ডাল কেটে ঘরের মধ্যে রাখা হয়। তাতেই বাচ্চা ছারপোকা জন্মায়। তিন মাসের মধ্যে শিশু ছারপোকা পরিণত হয়ে ওঠে। কাটা ডাল থেকে ছারপোকাগুলো থলের মধ্যে ঢুকিয়ে রোদে বা তাপ দিয়ে কিংবা গরম পানি বা বাস্পের সাহায্যে মারা হয়। তারপর মরা ছারপোকাগুলো থেকে ককিনিয়াল নিষ্কাশন করে নিলেই হলো। এক পাউন্ড ককিনিয়াল পেতে দরকার ৭০ হাজার ছারপোকা।
আমাদের দেশি ছারপোকা, মানে সবার চেনা বিছানার ছারপোকাও কিন্তু কম উপকারি নয়। গ্রাম্য ওষুধ হিসেবে ছারপোকা নাকি ম্যালেরিয়ার ভালো নিরাময়কারী ওষুধ। ছারপোকাকে ৫ ভাগ অ্যালকোহলে মিশিয়ে ঠান্ডা ও অন্ধকার স্থানে রাখা হয় ও দিনে দুবার ঝাকানো হয়। কিছুদিন পর তা ছেকে নিলেই তৈরি হয়ে যায় ছারপোকার আরক। তাই, বলা যায় না ব্যবসায়িক ভিত্তিকে কিছুদিনের মধ্যেই ছারপোকার চাষও শুরু হয় যেতে পারে।
এক রকম গুবরে পোকা রয়েছে, যার রস মানুষের ত্বকে লাগলে ফুসকড়ি পড়ে। এদের ইংরেজি নাম বিষ্ট্রার বিটল। এই পোকার জনন অঙ্গে প্রচুর পরিমাণে এক রকম কেলাসিত পদার্থ পাওয়া যায়। যার নাম ক্যান্থারাইডিন। এই পোকার দেহের নির্যাস বা পাউডার মূত্রের পরিমাণ বাড়াতে, পশুর প্রজনন এবং পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মানুষের উপর প্রয়োগে ক্যান্থারাইডিনের ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যাতে বৃক্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে মানুষের চিকিৎসার ক্ষেত্র এটি কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা নিয়ে আজও গবেষনা চলছে।
যখন ‘গুঞ্জরিয়া আসে অলি’ তখন কবিদের কবিত্ব জেগে উঠে। কিন্তু ‘পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে’ যদি হুল ফোটাতে আসে তখন কবিত্ব ছেড়ে পালাতে পথ খুজে পাওয়া যায় না। মৌমাছি অবশ্য এমনি এমনি হুল ফোটায় না। ওদের কাজ বাঁধা সৃষ্টি করলেই সাধারণত হুল ফোটায়। হুলের সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি বিষ থলি। হুল ফোটালেই ইনজেকশনের মতো বিষ হুলের ভেতর দিয়ে শরীরে ঢেলে দেয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, হুলটি একবার ফোটালে তা আর বের করতে পারে না মৌমাছি। ফলে হুল চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যায়। নতুন করে আর হুল তৈরি হয়না বলে হুল ছাড়াই মাছিকে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে হয়।
প্রাচীনকাল থেকই মৌমাছির বিষ নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মৌমাছির বিষে রয়েছে ফরমিক অ্যাসিড, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, অর্থোফসফোরিক অ্যাসিড, ট্রিপ্টোফ্যান, সালফার, তামা, ক্যালসিয়াম, হায়ালিউরোনিডেজ, ফসফোলাইপেজ এবং জ্বালা করার জন্য দায়ী পদার্থ মেলিটিন। মৌমাছির বিষ যে রোগের চিকিৎসায় বেশি ব্যবহৃত হয় তা হলো বাত। এছাড়া কিছু ¯œায়ুর রোগ, চোখের রোগ, ত্বকের রোগ, এমকি বিভিন্ন স্ত্রী রোগ ও শিশুর রোগের কিচিৎসায় মৌমাছির বিষ ব্যবহৃত হয়। মৌমাছির বিষ থেকে ভাইরাপিন ও এপিসার থ্রোন নামে দু’টো ওষুধ তৈরি করা হয়েছে। আমরা মৌমাছি বলতে শুধু মধু আর মোমের কথা ভাবি। কিন্তু মৌমাছির বিষও সাপের বিষের মতোই অত্যন্ত অর্থকরী। তাই বলা যায়, বিষ শুধু প্রাণ কেড়ে নেয় না। প্রাণ ফিরিয়েও দিতে পারে।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?