পরিবেশ দূষণ রোধে বিজ্ঞান সমাধান
পরিবেশ দূষণ রোধে বিজ্ঞান সমাধান
গ্রিন হাউজ এফেক্ট হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা ভূপৃষ্ঠ হতে বিকীর্ণ তাপ বায়ুমণ্ডলীয় গ্রিন হাউজ গ্যাসসমূহ দ্বারা শোষিত হয়ে পুনরায় বায়ুমণ্ডলের অভ্যন্তরে বিকিরিত হয়। এই বিকীর্ণ তাপ ভূপৃষ্ঠের উপরের উপস্থিতি ঘটে। এটি বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ফিরে এসে ভূপৃষ্ঠের তথা বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়।
বিজ্ঞানী, গবেষকরা অনেকদিন থেকে এক বাক্যে স্বীকার করে আসছেন, গ্রিন হাউস এফেক্টের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পরিবর্তন হচ্ছে আবহাওয়া। বর্তমানে অনাবৃষ্টি, খরা, আবার অতিবৃষ্টি বন্যা, বাতাসে বেড়ে যাওয়া কার্বন-ডাইঅক্সাইডের কারণে পৃথিবী যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে তা সবারই জানা। অনেকে শুনলে আঁতকে উঠবেন যে ২০৫০ সালে পৃথিবীর বাতাসে বিষাক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে ১৫০ গুণ বেশি হবে। আর ঐ অবস্থায় পৃথিবী পৌঁছানোর অনেক আগেই পৃথিবীর দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। যার ফলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের বিরাট অংশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর এক থেকে দেড় মিটার বাড়লেই সমুদ্রতলে বিলীন হবার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের মোট স্থলভাগের বহু অংশ।
এতোদিন পর্যন্ত গ্রিন হাউস এফেক্টে সৃষ্ট পৃথিবীর এ সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানোর চেষ্টা পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও বৃক্ষরোপণ অভিযান আর সচেতনতার সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গ্রিন হাউস এফেক্ট থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে এমন দু’টো নতুন সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। গ্রিন হাউসের কারণে সৃষ্ট বাড়তি পরিমাণ কার্বন-ডাইঅক্সাইড সাগরের তলদেশে মাটির নিচে পুঁতে রাখা সম্ভব যা পৃথিবীকে রক্ষা করবে। এ পদ্ধতি বিফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর দ্বিতীয় আবিষ্কারটি হয়তো পৃথিবীকে টিকে থাকতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয় আবিষ্কারটি হলো উচ্চ কার্বন-ডাইঅক্সাইড শুষে নেয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন পাইন গাছ রোপন। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখেছেন- পাইন গাছ অন্যান্য অনেক গাছের তুলনায় অধিক পরিমাণে কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম।
সমুদ্রের তলদেশে কার্বন-ডাইঅক্সাইড সংরক্ষণ কিভাবে সম্ভব? সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখেছেন- পৃথিবীর বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত হওয়া কার্বন-ডাইঅক্সাইড যদি প্রযুক্তির সহায়তায় সমুদ্রের তলদেশের দু’ মাইল নিচে জমা করে রাখা যায় তাহলে ঐ গভীরতায় তাপমাত্রা অনেক কম হওয়ায় তা কঠিন বস্তুতে পরিণত হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে আবদ্ধ থাকবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক ড্যানিয়েল সচরাগ জানিয়েছেন, শিল্প কারখানার ক্ষতিকর বর্জ্য যা বাতাসে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তা পাম্পের মাধ্যমে সমুদ্র তলদেশে পুঁতে রাখা হলে পৃথিবীকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে বাঁচানো সম্ভব। সমুদ্র তলদেশের স্বল্প তাপমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড কঠিন বস্তুতে পরিণত হবে। আর সেই কঠিন বস্তু ভূমিকম্প রোধেও কাজ করতে সক্ষম। অবশ্য গবেষক দল এটাও জানিয়েছেন, পদ্ধতিটি বেশ ব্যয়বহুল। হার্ভার্ড এর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের কেমব্রিজে অবস্থিত একটি বেসরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটাকে পৃথিবীর সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করা হয়।) এই ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এ পদ্ধতিটি কত কম খরচে সফলভাবে প্রয়োগ করা যায় এখন তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক নিকোলাস স্কুলের পরিবেশ ও পৃথিবী বিজ্ঞানের প্রফেসর রাম ওরেন সম্প্রতি তার এক গবেষণায় দেখেছেন- পাইন গাছ পরিবেশে অধিক কার্বন-ডাইঅক্সাইড থাকা অবস্থায়ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। পাইন গাছ অধিক কার্বন-ডাইঅক্সাইডের মধ্যেই বেড়ে ওঠতে পারে। তা স্বল্প কার্বন-ডাইঅক্সাইডে বেড়ে ওঠা পাইন গাছের তুলনায় বৈরী পরিবেশে ভালোভাবে টিকে থাকতে সক্ষম।
গ্রিন হাউসের ক্ষতি থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানী গবেষকদের হাতে আশার আলো দেখা যাওয়ার মানে এই নয় যে আমরা নিশ্চিত মনে কার্বন-ডাইঅক্সাইড উৎপাদন করে যাবো। সচেতন থাকতে হবে সকল মানুষকেই। উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থের জন্য কলকারখানা থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড উৎপাদন করে পৃথিবীকে বিপন্ন করবে আর আমরা গাছ লাগিয়ে পরিবেশ দূষণ কমানোর চেষ্টা করবো তা যেমন ঠিক নয়। তেমনি আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকাও ঠিক নয়। এজন্য কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়া বায়ুমন্ডলে নির্গত না করে উপযুক্ত ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধন করে নির্গত করতে হবে। জ্বালানি শক্তির সংক্ষেণের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাসের উত্তরোত্তর পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করতে হবে। সৌর, পানি, বায়ু ইত্যাদিকে পারমাণবিক শক্তির মতো পুনঃপুনঃ ব্যবহার যোগ্য শক্তি হিসেবে ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের ফলে বিভিন্ন গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি হয়, তাই ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের ব্যবহার রোধ করতে হবে। বর্তমানের চেয়ে প্রতি কিলোমিটারে অনেক কম জ্বালানি তেল প্রয়োজন হয় এমন মোটরযান ইঞ্জিন উদ্ভাবন করতে হবে।
এছাড়াও কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদনকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যথাসম্ভব কম করতে হবে। বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও নিয়মিত ব্যাপক বনায়নের মাধ্যমে নতুন নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। কৃষি কাজে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার ব্যাপক প্রচলন করতে হবে। সিএফসি বা ক্লোরোফ্লোরো কার্বন সাধারণত রেফ্রিজারেটর, এসি, স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়। এর সস্তা বিকল্প আবিষ্কার করতে হবে। সিএফসি ব্যবহার এবং উৎপাদন বন্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। উপক‚লে উপযুক্ত বাঁধ ও দেয়াল নির্মাণ করে ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।
আসুন, আগামী প্রজন্মকে বাসযোগ্য একটি পৃথিবী উপহার দিয়ে যেতে অপ্রয়োজনে পরিবেশ দূষণ করা থেকে আমরা প্রত্যেকে সচেতন হই, বিরত থাকি।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?