গবেষণাগারে প্রাণ সৃষ্টি রহস্য
গবেষণাগারে প্রাণ সৃষ্টি রহস্য
পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি, আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে? কবে হয়েছে? এই নিয়ে গবেষকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্ত নেই। আজ পর্যন্ত অসংখ্য গবেষণা, অসংখ্য থিওরি থিসিস তৈরি হলেও এ ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞানীই শেষ কথাটি বলতে পারেননি। প্রাণের সৃষ্টির ব্যাপারে বিজ্ঞানে মোটামুটি যেসব তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে সেগুলো হলো, বিশেষ সৃষ্টি তত্ত্ব, স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি তত্ত্ব বা আবায়োজেনেসিস, কসমোজোয়িক বা প্যান্সস্পার্মিয়া তত্ত্ব এবং জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি তত্ত্ব ইত্যাদি। তবে এদের মধ্যে শেষেরটিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
বিজ্ঞানী হেকেলের মতে, পৃথিবী সৃষ্টির একেবারে গোড়ার দিকে বিভিন্ন অজৈব বস্তুর ওপর বিকিরণ বা বৈদ্যুতিক ক্রিয়ায় প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিলো। বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার অপারিন, হ্যালডেন এবং গবেষক স্ট্যানলি মিলার এই তত্তে¡র স্বপক্ষে প্রচ‚র তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেন। এতে ধরে নেয়া হয় যে, একেবারে শুরুর দিকে পৃথিবীতে উত্তপ্ত গ্যাস এবং জলীয়বাষ্প ছাড়া কিছুই ছিলো না। অত্যাধিক তাপমাত্রা থাকার জন্য সমস্ত কঠিন পদার্থও গ্যাসীয় অবস্থায় ছিলো। ওই তাপমাত্রায় কোনো পদার্থের পক্ষেই স্বাধীনভাবে থাকা সম্ভব নয় বলে, তাদের মধ্যে খুব দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ফলে প্রচুর সংখ্যক অক্সাইড, কার্বাইড, নাইট্রাইড যৌগ, পানি আর সৃষ্টি হয় অ্যামোনিয়া। বিজ্ঞানীদের মতে, সমস্ত পদার্থই তখন গ্যাসীয় অবস্থায় ছিলো। পৃথিবীকে ঘিরে সে সময় কোনো ওজোন স্তর না থাকায় পৃথিবীতে অতিবেগুনি রশ্মির সরাসরি অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো।
এরপর পৃথিবীর তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমতে থাকলে গ্যাসীয় পদার্থগুলো তরল এবং কঠিন অবস্থায় পরিণত হতে শুরু করে। জলীয়বাষ্প বৃষ্টিতে পরিণত হয়। কিন্তু তখনও পৃথিবীর কিছু অংশ গরম থাকায় তাদের সংস্পর্শে এসে আবার তা বাষ্পে পরিণত হয়। একে হাইড্রো-সাইকেল বলা হয় এবং কয়েক লাখ বছর ধরে এই হাইড্রো-সাইকেল চলতে থাকে। পৃথিবী আরোও ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের সৃষ্টি হয়। এই সমুদ্রের পানিতেই বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ যেমন-অ্যামোনিয়া, মিথেন, পানি এবং আরো নানা ধরনের যৌগ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে।
জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানী ওপারিন বলেছেন, সমুদ্রের পানিই এই পদার্থগুলো বিদ্যুৎ বা বিভিন্ন বিকিরণের প্রভাবে ক্রমশ জটিল ধরনের যৌগ গঠন করতে থাকে। সে সব জটিল যৌগ ক্রমাগত পলিমারাইজেশনের ফলে বৃহদাকার অণুর সৃষ্টি করে। সেই অণুরা নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া করে আরো জটিল অণু তৈরি করে এবং স্বাধীনভাবে নিজের বিভিন্ন অণু প্রতিস্থাপন করার ক্ষমতা পায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়। প্রথম ধাপে বিভিন্ন জৈব যৌগ অর্থাৎ অ্যামাইনো অ্যাসিড, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটি অ্যাসিড, গ্লিসারল ইত্যাদি তৈরি হয়। অতিবেগুনি রশ্মি, অন্যান্য বিকিরণ এবং বিভিন্ন বৈদ্যুতিক শক্তির (যেমন আয়ন বিকিরণ) প্রভাবে কার্বোহাইড্রেট, অ্যামোনিয়া এবং পানি নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া করে অ্যামাইনো অ্যাসিড সৃষ্টি করে। জীবন সৃষ্টির প্রাণ ভোমরা হলো এই অ্যামাইনো অ্যাসিড। বিজ্ঞানী মিলার বিজ্ঞান ল্যাবরেটরিতে এই বিক্রিয়াটির প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। একটি বদ্ধ কাঁচের ফ্লাস্কে মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং জলীয়বাষ্পের একটি মিশ্রণ রেখে তার মধ্য দিয়ে তড়িৎ স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়। এক সপ্তাহ পর বিক্রিয়াজাত পদার্থ পরীক্ষা করে তার মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। এই পরীক্ষাকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে এসব সরল জৈব যৌগগুলোই নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া করে তৈরি করে বিভিন্ন জটিল জৈব যৌগ। বিজ্ঞানী হ্যালডেনের মতে, এই জৈব যৌগগুলো উত্তপ্ত সমুদ্রের পানিতেই তৈরি হয়েছিলো। যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘হট ডাইলুট সুপ’। কিন্তু আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের থার্মোডিনামিক্সের সূত্র অনুসারে, এই যৌগগুলো কোনোও তরল মাধ্যমে গঠিত হলে সেগুলোর গঠনের চেয়ে বেশি দ্রুতগতিতে ভেঙে যায়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই যৌগগুলো হয়তো পুরোপুরি তরল মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। হয়তো এগুলো সমুদ্রের তীরের অনেকটা কাদা কাদা ধরনের পদার্থে সৃষ্টি হয়েছিলো। তৃতীয় ধাপে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ধরনের নিউক্লিয়িক অ্যাসিড অর্থাৎ প্রথমে আরএনএ এবং তারপর ডিএনএ তৈরি হয়। এই নিউক্লিয়িক অ্যাসিডকেই বলা হয় নগ্ন জিন। যার মধ্যে নিজের প্রতিকৃতি তৈরি করার ধর্ম লক্ষ্য করা যায়। সবশেষে তৈরি হয় বিভিন্ন নিউক্লিয়িক প্রোটিন। বিজ্ঞানী-গবেষকদের কাছে পৃথিবীতে এটিই প্রাণ সৃষ্টির গোড়ার কথা।
তবে এই প্রাণ বা জীবনের ধর্মগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা কেউ। এতো বিক্রিয়া, এতো ধাপ আবিষ্কার করা সত্তে¡ও বিজ্ঞানীরা এক ফোঁটা রক্ত তৈরি করতে পারেননি। জানতে পারেননি, কীভাবে, কখন, কোন বিক্রিয়াটি ঘটলে ‘প্রাণ’ নামক জিনিসটি সৃষ্টি হয়। যে বিভিন্ন জীব অণূর ধর্মগুলো আস্তে আস্তে প্রোটোপ্লাজমের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে। সেই ধর্মগুলোরই বা উৎপত্তি কোথা থেকে? এখন এসব জানার জন্য বিজ্ঞানী গবেষকরা চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। আগামী দিনের গবেষকরা হয়তো এসব জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?