থার্টি ফার্স্টের আতশবাজি
থার্টি ফার্স্টের আতশবাজি
প্রায় হাজার বছর আগে চীনদেশ সর্বপ্রথম আবিষ্কার করে আতশবাজি। এখন বিশ্বব্যাপি থার্টি ফার্ষ্ট নাইট বা নববর্ষের উৎসবের একটি ঐতিহ্যবাহী ও অপরিহার্য্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে আতশবাজি। আতশবাজি যখন জ্বলে, তখন তরুণ প্রজন্মের মন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে।
আজকাল আমাদের দেশেও থার্টি ফার্স্ট নাইট বা অন্য যে কোনো উৎসব, উদযাপনে ফায়ারক্রেকার বা আতশবাজি, পটকা ফাঁটানোর প্রচলনের মাত্রাটা বেশি পরিমাণেই লক্ষ্য করা যায়। সাত’শ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে তিন হাজার টাকা দামের হাজার হাজার আতশবাজি ফোঁটানো দেখে কারও বুঝতে বাকি থাকে না, দেশের মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। বেড়েছে আয়-উপার্জন। দেশ উন্নত হয়েছে।
ফায়ারক্রেকার বা আতশবাজি হলো বারুদ দিয়ে তৈরি বাজি বিশেষ। যা কোনো শব্দ না করে শুধু আকাশে দৃষ্টিনন্দন শোভা বর্ধন করে। সাধারণত বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী ও পদাতিক বাহিনী রাত্রিকালীন বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন হিসেবে এই ফায়ারক্রেকার কাজে লাগায়। তবে ওসব বিশেষ ধরণের আতশবাজি সাধারনতঃ ফ্লুয়াস পাউডারে তৈরি। তবে বেসামরিক আতশবাজির নিচের দিকে বন্ধুকের মতো বারূদ ঠেসে ভর্তি করা থাকে। এতে আরও থাকে নানারকম আতশবাজির মসলা। এসব কালো মশলায় থাকে ৭৫% পটাসিয়াম নাইট্রেট আর ১৫% কাঠকয়লা (কার্বন) এবং চিনি। বাকি ১০% সালফার। সলতেয় আগুন দেয়ার পর আগুনের যথেষ্ট তাপ উপকরণগুলোকে একে অপরের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফিউজিংয়ের আলোক বিস্ফোরণ বা ফায়ারকে আলোকিত করার জন্য তাপ সরবরাহ করে থাকে কাঠকয়লা বা চারকোল, (কার্বন) চিনি বা জ্বালানী। তবে রঙিন আলোর জন্য স্ট্রনশিয়াম, বেরিয়াম প্রভৃতি ধাতুর নাইট্রেট, ক্লোরেট লবণ ব্যবহৃত হয়। এক কথায়-রঙিন আলোর জন্য ক্লোরিন অবশ্যম্ভাবি। ক্লোরেট লবণ থেকেই ক্লোরিন পাওয়া যায়। কিন্তু নাইট্রেট লবন ব্যবহার করলে আলাদা ভাবে ক্লোরিন নিস্কাশক দ্রব্য যথা পি-ভি-সি বা পলি-ভিনাইল ক্লোরাইড মেশাতে হয়। এছাড়া নীল রঙ সৃষ্টির জন্য তুঁতে ও ক্লোরিন নিস্কাশক ব্যবহার করা হয়।
পটাসিয়াম নাইট্রোজেন অক্সিডাইজার, এবং সালফার প্রতিক্রিয়া মধ্যপন্থী। কার্বন (চারকোল বা চিনি থেকে) অক্সিজেন (বায়ু এবং পটাসিয়াম নাইট্রেট থেকে) কার্বন ডাই অক্সাইড এবং শক্তি গঠন করে। নাইট্রোজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস এবং পটাসিয়াম সালফাইড গঠনের জন্য পটাসিয়াম নাইট্রেট, সালফার এবং কার্বন প্রতিক্রিয়া করে। প্রসারিত নাইট্রোজেন এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে চাপের কারণে সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলেই তা প্রচÐ বেগে আকাশের দিকে ধেয়ে ছুঁটে চলে। বারূদ জ্বলে ওঠার জন্যেই জ্বলন্ত আগুন ফোয়ারার মতো ওপরে উঠে যায়। আর তখন চারিদিকে আলোর ফুলকি ছিটকে বেরোতে থাকে। এক পর্যায়ে ফায়ার ক্রেকারের সর্বশেষ ঠোঙ্গা বা শক্ত কাগজের মলাটটি শব্দ করে বিস্ফোরিত হয়ে ফেঁটে আকাশ থেকে নীচে পড়ে যায়।
এসবের কার্য্যকারণ, বিজ্ঞানী নিউটন অনেকদিন আগেই বলে গেছেন। ‘প্রতিটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী এবং সমপরিমাণে প্রতিক্রিয়া রয়েছে।’ বাজির সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে বারূদে আগুন ধরে যায়। উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপরদিকে অবস্থিত বাজির মসলায় যখনই পুরোপুরি আগুন ধরে যায়, তখনই তা পটকার মতো, সশব্দে ফেঁটে যায়। সেই সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আলোর রোশনাই। এ সময় আতশবাজির তলা দিয়ে প্রবল বেগে গ্যাস বেরুতে থাকে। এই গ্যাস বেরুনোটা হলো ক্রিয়া। কাজেই এর সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া হলো- ঐ গ্যাস যতো জোরে তলা দিয়ে বেরুতে থাকে, প্রতিক্রিয়া ঠিক ততোটা জোরে বাজিটিকে উপরের দিকে ঠেলে তুলে দেয়। যে ফায়ারক্রেকারের বারূদ যতো ভালো মানের এবং বেশি পরিমাণে বারূদ থাকে, তা ওপর দিকে আকাশে ততো বেশিদূর পর্যন্ত উঠে যেতে সক্ষম।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, আতশবাজি বা ফায়ারক্রেকারের নিচের দিকে একটি কাঠি লেজের মতো লাগানো থাকে। এটি অনেকটা নৌকার হালের মতো কাজ করে। আতশবাজির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। আতশবাজিকে উপরের দিকে ঠিক পথে চালনা করে। আর রঙিন আতশবাজি বা তারাবাতিতে বা রং-মশালে থাকে প্রধানত ম্যাগনেসিয়ামের গুঁড়া। বাতাসের সংস্পর্শে ম্যাগনেসিয়াম যখন জ্বলে, তখন খুব উজ্জ্বল আলোক উৎপন্ন করে। চারিদিকে আলোয় ছেয়ে যায়। ফুলঝুরি বা তারাবাতিতে স্ফুলিঙ্গ বা আলোর ফুলকি সৃষ্টি করার জন্য সীসার যৌগ, লোহার গুঁড়া বা অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়া ইত্যাদি মিশিয়ে দেয়া হয়।
প্রতিবছর থার্টি ফার্ষ্ট নাইট এলেই বাজি-পটকা নিয়ে সর্ব সাধারণের মনে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে সবসময় কিছুটা ভীতি-উৎকণ্ঠা কাজ করে। পটকা ও আতশবাজির শব্দ কারও জন্য যেমন আনন্দের ব্যাপার। অন্যদিকে অনেককে মানসিকভাবে প্রচÐ সন্ত্রস্ত করে তোলে। থার্টি ফার্স্টের আগের রাত থেকে পটকা আতশবাজি ফোঁটা শুরু হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইটে প্রায় সারা রাত ধরে একটানা পটকা ও আতশবাজি ফুঁটতে থাকে। এমনকি তারপরও কয়েকদিন পটকা আতশবাজির শব্দ শোনা যায়। তরুণ প্রজন্ম আর বয়স্করা না হয় ব্যাপারটি বুঝেন, আসলে কী হচ্ছে! আনন্দ উপভোগের জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু শিশু, রোগী কিংবা বৃদ্ধদের বেলায়? চারিদিক থেকে যখন পটকা-আতশবাজির শব্দ আসতে থাকে, তখন তাদের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে যায়। ক্ষতির পরিমাণ কতটা তা কেবল ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারেন। ছোট্ট শিশুর জন্য এটি ভয়াবহ বিষয় হয়ে যায়। যাদের হার্টে সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এটি অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে। এমনকি টানা আতশবাজির শব্দ কারও কারও জন্য প্রাণহানি বা মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
গবেষকরা আতশবাজি বা পটকাকে নিরুৎসাহিত করে থাকেন। কারণ শুধু শব্দ দূষণ নয়। আতশবাজি, বাজি-পটকা থেকে উৎপন্ন লেড বা সিসার অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় রক্তশূন্যতা, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসাড়তা প্রভৃতি রোগ হতে পারে। অ্যান্টিমনি দূষণের ফলেও অনেকটা এরকম হয়ে থাকে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আতশবাজিতে জ্বালানী হিসেবে কার্বন ও সালফার রয়েছে। এগুলো পুড়ে গেলে, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন করে। সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসের ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া এই গ্যাস বাতাসে থাকলে, তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে তৈরি করে সালফিউরাস ও সালফিউরিক অ্যাসিড। এজন্যে আকাশ থেকে পড়তে পারে এসিড বৃষ্টি। অ্যাসিড বৃষ্টি ত্বকের মারাত্বক ক্ষতি সাধন করে, এ কথা কে না জানে।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, আতশবাজি-পটকা থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে বিষাক্ত পদার্থ প্রথমে ফুসফুসে যায়। তারপর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। এর ফলে দেহে নানা রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। বিশেষ করে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস ফুসফুসের মাধ্যমে রক্তের সঙ্গে মিশে সুস্থিত কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে। এর ফলে রক্তের অক্সিজেন পরিবহন করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। এজন্য মাথাধরা, ক্লান্তিভাব এবং আরও নানারকম উপসর্গ দেখা দেয়। মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীরে দেখা দেয় আরও নানান রকম বিপত্তি।
তবুও থার্টি ফার্স্ট নাইট। আনন্দ উৎসবের সময় কে মনে রাখে কার কথা? এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?