বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
আমরা সবাই যেনো ডিজিটাল প্রযুক্তি যন্ত্রের দাস হয়ে গেছি। কর্মব্যস্ত শহুরে জীবনে প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ইট, কাঠ আর পাথরের নাগরিক জীবনের ছোট পরিসরেই আমাদের জীবনটা কেটে যায়। মনের সাধ ও ঘরের আভিজাত্য বাড়ানোর জন্য অনেকে ঘরের ভেতর দামি আর সৌখিন জিনিস দিয়ে ভরিয়ে তোলেন। প্রকৃতিপ্রেমীদের অনেকেই একটু সবুজের সান্নিধ্য পেতে অন্দর সাজাতে ব্যবহার করেন নানান ধরনের গাছ।
ভুলে গেলে চলবে না, জীবনকে সজীব রাখতে সবুজের সংস্পর্শে থাকতে হয়। ঘরের ভেতর বিশুদ্ধ অক্সিজেন, নির্মল বায়ু ও বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা দেয় ইনডোর প্ল্যান্ট। যেগুলো আমাদের বাড়ি ঘরের বায়ুতে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু উপাদানমুক্ত করে নিঃশ্বাস নেবার উপযোগী অক্সিজেনের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয় ও পরিষ্কার করে তুলে। তাই ঘরে গাছ থাকা জরুরি। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, শোবার ঘরে রাখা গাছ, ঘুমকে গভীর ও আরামদায়ক করে তোলে। ইনসোমনিয়া থেকেও বাঁচাতে পারে ঘরোয়া উদ্ভিদ। এসব গাছ সৌখিন মানুষের জন্য নান্দনিকতা আর শোভাবর্ধনকারী পাতাবাহার হলেও সুস্থ্য জীবনের জন্য অপরিহার্য্য।
সচেতন মানুষ আজকাল অনেকে নিজের নান্দনিক রুচির প্রকাশ ঘটাতে ঘরের কোনে, ব্যালকনিতে, ড্রয়িং রূমে পাতাবাহার ও মানিপ্লান্ট গাছ রাখছেন। অফিস আদালতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বারান্দা বা করিডোরে, এমনকি ফ্ল্যাটের বারান্দাতেও পাতাবাহার গাছ দেখা যায়। গ্রামেও অনেকেই বাড়ির বারান্দায়, বসার ঘরে সাজিয়ে রাখেন পাতাবাহার। বহুতল আবাসনগুলোর সিঁড়ির ধাপে ধাপে বা ছাদের সৌন্দর্যায়নের জন্য টবে পাতাবাহার গাছ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব সুন্দর পাতাবাহার গাছ যে আসলে আমাদের ক্ষতি করতেও সক্ষম তা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাড়ি ঘরের সৌন্দর্যবর্ধক একটি পাতাবাহার গাছ। এর ভয়াবহতা অনেকেই কল্পনা করতে পারবেন না।
ডাইফেনবাকিয়া তেমনি একটি ভয়ংকর বিষাক্ত ইনডোর গাছ। নামটি অপরিচিত নাম মনে হলেও গাছটি সবার খুবই পরিচিত। এর আরেক নাম হচ্ছে ডাম্ব ক্যান। বিশাল বিশাল সবুজ পাতার উপর বড় ছোট সাদা ফোঁটা বা ছোপ। খুবই রাজকীয় মনে হয়। কান্ড সবুজ রঙের। মনে হয় যেনো অনেকগুলো কাণ্ড এক সাথে যোগ করে। এই গাছ বিভিন্ন রঙের হয়। তবে সবুজ, ক্রীম, সাদা রঙের বেশি দেখা যায়। একটি পূর্ন বয়স্ক পাতাবাহার বড় গাছ দশ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতা বিশ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে ঘরে রাখলে গাছ ৬ ফুট লম্বা হয়। এই গাছ খুব দ্রুত বড় হয়। এক বছরে প্রায় দু’ফুট লম্বা হয়। শিকড় কাণ্ড কেটে লাগালেই গাছ গজায়। দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবিয়ান অঞ্চল হলো এই গাছের আদী নিবাস। গাছগুলো ছায়ায় মধ্যেই বেড়ে উঠে। শীতের সময় এর পাতাগুলো দেখতে বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এই গাছের তেমন পরিচর্যা করতে হয় না। সপ্তাহে দু’দিন করে পানি দিলেই চলে।
প্ল্যানটেরিনা ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডাইফেনবাকিয়া একটি সহজ সাধারণ ঘরের রাখার গাছ। এই পাতাবাহার গাছটির জুড়ি মেলা ভার। পাতাবাহার গাছটি আপাত নিরীহ হলেও আদতে অত্যন্ত ভয়ংকর! এই গাছ সম্পর্কে এখনো সাধারণ মানুষের কিছু ব্যাপার জানা বাকি রয়েছে। যা শুনলে শিহড়িত হতে হয়। এর কমন নাম ডাম্ব ক্যান। পাতাবাহার গাছটির পোশাকি নাম ডাম্ব কেন হলো? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মত- এই গাছের নামের মানেই বোবা। যারা কথা বলতে পারেন না। মানে মিউট হয়ে যাওয়া। এই গাছের পাতা চিবিয়ে জিহবায় দিলে কথা বলা অসম্ভব হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় জেলখানার দাগী কয়েদীদের জিহবায় এটি শাস্তি স্বরূপ ঘষে দেয়া হতো। পাতার রসে বাচন শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপাদান রয়েছে। এই গাছের পাতা জীব-জন্তর জন্যও প্রচন্ড বিষাক্ত। যে কারণে গ্রামে প্রচলিত রয়েছে এই গাছ ঘরে থাকলে সাপ আসে না। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, এই গাছের পাতায় রয়েছে ক্যালসিয়াম অক্সালেট। যা ত্বক বা মুখের সংস্পর্শে এলে তীব্র ব্যথা এবং ফোলাভাব ঘটায়। চোখের সংস্পর্শে এলেও চোখ জ্বলার মতো অনুভূতি হতে পারে। যা মানুষ কিংবা পোষা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ ফার্মাকোলজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পিটসবার্গ পয়জন সেন্টারের প্রাক্তন পরিচালক অ্যাড ক্রেনজেলেক দীর্ঘদিন ধরে ডাইফেনবাকিয়া’র বিষক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, এই পাতাবাহারের পাতা শরীরের কোথাও লাগলে জ্বলার মতো অনুভূতি হয়। শিশুদের বেলায় এটি ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বাড়িতে ছোট শিশু থাকলে অবশ্যই সাবধান হওয়া প্রয়োজন।
গাছটি সম্পর্কে দক্ষিণ আমেরিকার উদ্ভিদবিদরা জানিয়েছেন এর পাতায় রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী বিষ। দীর্ঘদিন এই গাছের সংস্পর্শে থাকলে এক ধরনের স্থায়ী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটে। যার ফলে মুখ, জিহ্বা ও ঠোঁটে জ্বালাপোড়া, গলা ব্যথা, গিলতে সমস্যা এবং শ্বাস নিতে সমস্যা, জিহব্বা আড়ষ্টতা হতে পারে। হাফিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী- এই গাছের একটি পাতা আপনাকে অসুস্থ করে তুলতে পারে। তাঁর পরামর্শ: এই গাছ দেখলে শিশুদের কাছাকাছি যেতে দেবেন না। আর হ্যাঁ, পাতাবাহার গাছ নির্বাচনে সচেতন হোন।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?