একজন বাবার দূরদর্শীতার গল্প
একজন বাবার দূরদর্শীতার গল্প
সেটা ১৯৮৪ সাল। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। বর্ষা শুরু হয়েছে মাত্র। তারই এক দুপুর বেলা। ঝর ঝর বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টি শুরু সেই ভোররাতে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। দুপুর নাগাদ বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে মাঠ। বাড়ির পাশে ধানক্ষেতের আল ধরে বইছে বৃষ্টির স্রোত। তাতে কিলবিল করছে ছোট ছোট মাছ - চেলা (মলা), পুঁটি, খয়রা (খলসে)। বর্ষার নতুন পানি মানেই মাছের আনাগোনা। এসময় মাছগুলোর গা রঙ্গিন হয়। আমরা একে বলতাম, শাড়ি পড়া মাছ।
চোখের সামনে দিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে মাছগুলো। কী এক দারুণ উত্তেজনা। নিজেদের আর নিবৃত্ত রাখা গেলনা। বাড়ি থেকে ঘুনি (চিকন বাঁশের শলায় তৈরি মাছ ধরায় ফাঁদ বিশেষ) এনে আমরা দু’ভাই তা বসিয়ে দিলাম ধানক্ষেতের আলে। আমাদের সাথে যোগ দিল আমারই এক ঘনিষ্ট বাল্য বন্ধু।
যে বাড়িতে আমাদের বসবাস, তা দুই শরিকের বাড়ি। সীমানা, ও জায়গা-জমিসহ নানা বিষয় নিয়ে দুই-শরিকের মধ্যে প্রায়শঃই বিরোধ হতো। আমার বাবা খুবই সহনশীলতার সাথে এসকল ঝঞ্ঝাট মোকাবিলা করতেন। প্রয়োজনে কিছুটা ছাড় দিয়েও প্রতিবেশিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। সহনশীল থেকে কিভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তোলা যায় সে শিক্ষা বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি শৈশবে।
মুল বিষয়ে ফিরে আসি। নতুন পানির মাছ ধরার জন্য ঘুনি পেতেছি মাত্র। এ নিয়ে কিছুক্ষণ পরেই প্রতিবেশির সাথে বিরোধ বেঁধে গেলো। কথা-কাটাকাটি হলো। প্রতিবেশিটি আমাদের আপনজনও বটে। আমাদের থেকে বয়স ও শক্তিতে ছিলেন বড়। তাকে আমরা সমীহ করেই চলতাম। কিন্তু সেদিন ছাড় দেইনি।এটি ছিল আমাদের জন্য ন্যায্যতা রক্ষার বিষয়। ঝগড়া শুধু ধানক্ষেতেই সীমাবদ্ধ রইল না; বাড়ি অবধি গড়ালো এবং কিছুটা মারামারিও হয়ে গেলো। ওই যে বললাম ছাড় দেই নি। ফলে সেটি ছিল প্রতিবেশী কারো সঙ্গে আমাদের দুভাইয়ের প্রথম মারামারির ঘটনা।
এসময় সময় বাবা বাড়িতে ছিলেন না। ঘন্টা দুয়েক পরে বাড়ি ফিরে সব শুনে তিনি আমাদের দুভাইয়ের উপর রেগে অগ্নিশর্মা। আমরা ন্যায্যতার যুক্তি দেখালেও শেষ রক্ষা হলোনা, বাবার হাতে মার খেতে হলো। মা এগিয়ে এলেন ঠেকাতে। বাবা বললেন, ন্যায় বা অধিকার রক্ষা যা-ই হোক না কেন, আমরা মারামারি করতে পারি না, বয়সে বড় এমন কারুর সাথে ঝগড়া করতে পারিনা।
আমাদের দুভাইয়ের অনেকক্ষণ পর্যন্ত মন খারাপ থাকলো এই ভেবে যে বাবা অকারণে মারলেন, আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি, শুধু নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে চেয়েছি মাত্র।
আমাদের ভর্ৎসনা করার পর বাবারও খুব মন খারাপ হল। দেখলাম, বাবা চিন্তামগ্ন। মায়ের সাথে নানা পরামর্শ করছেন। আমরা অন্য ঘরে থাকায় গোটা কথোপকথন শুনতে পেলাম না, তবে আঁচ করতে পারলাম, আলোচনার বিষয়বস্তু আজকের এই ঘটনা।
সেদিন কি ভেবেছিলেন বাবা? কেনই বা আমাদের মেরেছিলেন? অনেকদিন পরে, পরিণত বয়সে সেই অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর আমরা খুব স্পস্টভাবে নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম।
সেদিনের সেই ঘটনার পর দূরদর্শী বাবা দুটি কাজ করলেন। এক. বিলে আমাদের খুব বড় একটি ধানী জমি ছিল, যা থেকে প্রায় ছ’মাসের খাবার চাল ঘরে আসতো, তা একটি অকৃষি ভিটে জমির সাথে বদল করে নিলেন। ভিটে জমির মালিক অত্যন্ত উৎসাহে বাবাকে জমিটি রেজিস্ট্রি করে দিলেন, বাবাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিলের উর্বর জমিটি ঐ মালিককে রেজিস্ট্রি করে দিলেন। বলাই বাহুল্য, আয়তন, দাম ও ফসল উৎপাদন বিবেচনায় বিলের জমিটি ছিল এক সোনার খনি। আর এই ভিটে জমিটি সেই তুলনায় ছিল অনেকটাই অকেজো। যেখানে শুধু একটি বাড়ি করে বসবাস করা যায় মাত্র। তবে নতুন ভিটে জমিটি একটি আলাদা একক জমি, যেখানে ঘনবসতি নেই, নিরিবিলি, নির্ভেজাল। এর অবস্থান আমাদের বাড়ির কাছেই, একই পাড়ায়, বড় রাস্তার পাশে।
বাবার এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবেশি সকলে বিস্মিত হলো; বললো, কি করলেন, মাস্টার সাহেব, এটা নিখাদ বোকামী।
দুই. ভিটে বাড়িটি কেনার পর তা থেকে জঙ্গল পরিস্কার করে কয়েক মাসের মধ্যেই, অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে এখানে আমাদের নতুন বাড়ি তৈরি করলেন বাবা। আমরা অনেকটা নিরিবিলি, একক, পরিচ্ছন্ন এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রতিবেশীবেষ্টিত একটি বাড়ি পেলাম।
নতুন বাড়িটির দিকে তাকিয়ে গ্রামের প্রতিবেশীরা সব ভুলে বললেন, খুব ভালো হয়েছে। এক কথায় লা জবাব।
নতুন বাড়িতে ওঠার পর, বেশ কিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটল। পূরাতন বাড়ির শরিকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও শান্তিপূর্ণ ও ঘনিষ্ট হলো। বাবা আমাদের পড়ালেখার প্রতি নিজেকে আরও নিবেদিত করলেন। বাবার উৎসাহে নতুন বাড়িতে আমরা বিভিন্ন মৌসুমী সবজি ও ফল ফলাতে শুরু করলাম (একাজে আমার ছোট-ভাইবোনগুলো বিশেষ করে ইমিডিয়েট ছোটভাইটি ছিল সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। আমি ছিলাম কাজ না করার ক্ষেত্রে সুযোগ সন্ধানী, যে জন্য বাবার ভৎর্সনা খেয়েছি ঢের)। একপর্যায়ে আমরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি ও ফল হাটে নিয়ে বিক্রি করতাম, যে অর্থ পরিবারের কাজে লাগতো।
আমরা ভাইবোনেরা এই বাড়ি থেকেই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি, এসএসসি পাশ করছি সাফল্যের সাথে। বাবা, এসএসসির পরে আমাদের সবাইকেই একে একে শহরে পাঠাতে শুরু করলেন। শুরু হল নতুন জীবন। ধাপে ধাপে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম।
কী ভেবে বাবা সেদিন বাড়ি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? বাবা, দেখতে পেয়েছিলেন যে সন্তানেরা বড় হয়ে উঠছে যেখানে এই বাড়ি ও এর পারপার্শ্বিক পরিবেশ এদের মানুষ হওয়ার পথে অন্তরায়। তিনি বুঝেছিলেন প্রতিবেশির সাথে অমিশাংশিত এই বিরোধ তার সন্তানদেরকে ভবিষ্যতে আরও বচসার জড়াতে উদ্বুদ্ধ করবে, তা হোক সে যতই ন্যায্য কারণ। বাবা শুধু বাড়িই পরিবর্তন করেননি, বিবাদপূর্ণ বিশাল আমবাগানের আমগাছগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন, জমি ও সম্পত্তির যথাসম্ভব সীমানা নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন নিজে ঠকেও; যাতে সন্তানের মানুষ হওয়ার পথে এগুলো বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
সময় পেরিয়েছে ঢের। প্রতিবেশী সেই আপনজন যার সাথে সেদিন বচসা হয়েছিল, তিনিও আজ আর বেঁচে নেই। তবে পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সত্যিকারের আপনজন। বাবা-মায়ের মরদেহ যে কয়েকজন কবরে নামিয়েছিলেন, তারমধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তার মৃত্যু খবরে নিউইয়র্কে বসে চোখের জল ফেলেছি, একাকী, নিভৃতে। সবই হিরন্ময় শৈশব স্মৃতি। সেই মানুষ, সেই পরিবেশ-প্রকৃতি আজ পাল্টে গেছে ঢের। গ্রামের চেনা মেঠোপথে এখনো হাতড়ে বেড়াই ফেলে আসা দিন, একমুঠো শৈশব।
বাবা আজ নেই॥ গত হয়েছেন, ২০০৯ সালে। চিন্তায় ও মননে বাবা বাস করেন অহর্নিশ। প্রায়শঃই ভাবি বাবার সেদিনের দূরদর্শীতার কথা। তাঁর দেখানো পথে আজও চলি নিঃসংকোচে। মনে হয় পাশে আছেন বাবা, ভুল শুধরে দিচ্ছেন; ফিস্ ফিস্ করে বলছেন, ঐ পথ নয়, এই পথে চলো; এটাই সরল পথ, শান্তির পথ - জীবনের, জীবিকার।
বাবা দিবসে সকল বাবাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?