মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

চামড়ায় লুকানো গোয়েন্দা যন্ত্র

শেখ আনোয়ার

১১:৪৯, ২ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৪:২২, ২ নভেম্বর ২০২০

৯৭৯

চামড়ায় লুকানো গোয়েন্দা যন্ত্র

ডিজিটাল এসময়ে হাতের মুঠোয় স্মার্ট অ্যান্ড্রয়েড গেজেট, সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। বিশ্ব শহরে এটা ছাড়া কে, কার, কতদূর, খোঁজ রাখতে পারে? এমন যদি হতো- দু’ তিনটে কাজ এক সঙ্গে করা যাচ্ছে। অফিসে বসে স্মার্ট গেজেট ছাড়াই জেনে নেয়া যাচ্ছে বাড়ির অসুস্থ প্রিয় মানুষের ভালো মন্দ খোঁজ-খবর। দরকার মতো প্রতিবিধানও দেয়া যাচ্ছে। তাহলে সত্যিই টেনশন মুক্ত হতো মন। আরও বেশি স্মার্ট হতো মানবজীবন। দ্রুত পরিবর্তন ঘটা ডিজিটাল প্রযুক্তির এ সময়ে এমনটা অদ্ভূত শোনালেও আজগুবী ব্যাপার নয়। 

এবার ঠিক আপনার যেমন দরকার, তেমনটা সত্যি-সত্যিই এসে গেলো আঙ্গুলের ডগায়। প্রিয় সন্তান যেখানেই থাকুক। টেনশন নেই। তার অবস্থান এবং কর্মতৎপরতা যখন-তখন আঙ্গুলের ডগায় দেখে নেয়া, জেনে নেয়া এখন কোন ব্যাপার না। শরীরে লুকানো ক্ষুদ্রাকার সেলুলার স্ক্রীনযুক্ত মাইক্রোচিপ থাকলে আর কী লাগে? এর সাহায্যে নিখোঁজ বা অস্বাভাবিক দূর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিকেও সহজে তাৎক্ষণিক খুঁজে বের করা সম্ভব। ছিনতাইকারীর হাতে নগদ টাকা, ক্রেডিট কার্ড হারানোর ভয় নেই। এনআইডি, অফিসের আইডি,এমআরপি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্টুডেন্ট কার্ড নামক প্রচলিত ডিজিটাল জঞ্জাল পকেটে আলাদা ভাবে রাখার কোন দরকার নেই। কেনাকাটাসহ তাবৎ দুনিয়ার সবকিছু সম্পন্ন করবে আঙ্গুলের ডগায় লুকানো অতিক্ষুদ্র এই যন্ত্র।
শুধু কি তাই? রোগীকে যেতে হবেনা আর ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকেও আসতে হবেনা রোগীর কাছে। বাসায় বিছানায় রোগী শুয়ে থাকবেন। চেম্বারে বসে ডাক্তার জেনে নেবেন রোগীর নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ-খবর। ওষুধপত্র বা প্রতিবিধানও দেয়া যাবে দূর থেকেই। সত্যিই ক’দিন বাদে উন্নত দেশের মত আমাদের দেশেও, মানুষের শরীর আর নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। 

ইলেকট্রনিক মাইক্রোচিপ নামক যন্ত্রটা দেখতে ছোট্ট একটা সরিষার দানার মতো। শরীরের ভেতরে স্থাপন করতে কোন প্রকার সার্জারির দরকার নেই। সিরিঞ্জের সাহায্যে হাত বা পায়ের চামড়ার নীচে সহজে স্থায়ীভাবে বসানো যায়। আঙ্গুলের চামড়ায় এই যন্ত্র ঢোকাতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ড। এতে থাকা বারকোডে রয়েছে অ্যান্ড্রয়েডে উদ্ধারযোগ্য যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, ছবি, ভিডিও এবং অডিও। আছে বেতার ট্রান্সমিশনের দরকারী সিগন্যাল। এসব তথ্য সেলুলার স্ক্রীন স্ক্যানারের সাহায্যে দেখা যায় এবং পড়া যায়। নতুন এই মাইক্রোচিপ গোটাবিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রীয়ভাবে গরিকদের আগামীদিনে কি এই চিপ বাধ্যতামূলক সরবরাহ করা হবে? মাইক্রোচিপের প্রস্তুতকারক কোম্পানির মতে, ‘আপাতত: এটা ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের ব্যবহৃত ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তদারকীর কাজে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনী, রক্ত, হাঁপানি, অ্যালার্জি বা হৃদপিন্ড সমস্যা রয়েছে তাদের জীবন বাঁচাতে চামড়ার নীচে বসানো এই চিপ স্বাস্থ্য সহায়কের ভূমিকা পালন করছে। উল্লেখ্য, এই প্রযুক্তি গ্রহণে এতদিন মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের নীতিগত নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বলা হয়েছে ‘এই মাইক্রোচিপ ব্যবহার নিরাপদ বলে পরীক্ষিত হওয়ায় ব্যাপকভিত্তিতে এখন ব্যবহার করা যেতে পারে।’ তাই এমন একটা প্রযুক্তি গ্রহণ করার বাঁধা আর নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ নানান দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে মাইক্রোচিপ। পাশাপাশি মাইক্রোচিপের আপডেট ক্লোন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ-তরুণীরা চামড়ার নীচে, আঙ্গুলের ডগায় মুড়ি-মুড়কির মতো শখের বশে লাগিয়ে নিচ্ছে। এই ক্ষুদ্র চিপের সুবিধা অনেক। এটা ব্যাংকের এটিএম কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ঘরে ঢোকার চাবি, গাড়ির চাবি, অফিসের আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মেডিক্যাল রিপোর্ট এমন কি পরিবহনের টিকেট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বারবার। ব্যবহারকারীদের মতে, ‘আগামী দিনে এভাবেই দৈনন্দিন সব কাজে ব্যবহৃত হবে ন্যানো প্রযুক্তির এই মাইক্রোচিপ।’

আর তাই, এই চিপ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সুইডেনে। সেদেশে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী চামড়ার নীচে মাইক্রোচিপ ঢোকাচ্ছে। কারণ-সুইডেন প্রযুক্তিবান্ধব আধুনিক উন্নত দেশ। দেশটাতে লেনদেনে নগদ অর্থের ব্যবহার ইতিমধ্যে একেবারে শূণ্যের কোঠায়। সুইডেনের নাগরিক এরিকের কথাই ধরা যাক। এই তরুণের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের ডগায় চামড়ার নীচে একটা ক্লোন মাইক্রোচিপ ঢোকানো। যেটা ব্যবহার করে সে তার ঘরের দরোজা ও আলমারির ড্রয়ার খোলে। গাড়ি স্টার্ট দেয় ও পিসি চালায়। যেভাবে আপনি গ্যারেজের দরজা খোলেন, অফিসে ঢোকেন, অনেকটা সেরকম। যন্ত্রটা বাসা-অফিস, গাড়ি, আলমারি, সিন্দুকের চাবির ট্যাগের মতই কাজ করছে। এরিকের স্ত্রী সিলভিয়ার আঙ্গুলেও লাগানো রয়েছে অনুরূপ ক্লোন মাইক্রোচিপ। তার মতে, ‘হাতে মাইক্রোচিপ লাগানো রয়েছে। কথাটা শুনতে কেমন বিশ্রী ও ভয়ংকর মনে হতে পারে বৈকি! কিন্তু বাস্তবে মোটেও ভয়ংকর বিশ্রী কোন ব্যাপার নয়। এটা হাতের আঙ্গুলের টিপসই বা ডিজিটাল সিগনেচার। মন চাইলে সহজেই যখন-তখন শরীর থেকে খুলে ফেলা যায়।’

শুধু কি তাই? এই চিপের সাহায্যে যে কোন স্থানে, কঠিন ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব। বিশেষ সংরক্ষিত স্থান পরিদর্শনে মাইক্রোচিপ ট্যাগের সাহায্যে অনুপ্রবেশকারীর মন-দৈহিক ক্রিয়াকলাপ সহজে মনিটরিং করা যায়। ব্লু টুথ স্ক্যানারের সাহায্যে অনুপ্রবেশ কারীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা যায়। যাবতীয় তথ্য উপাত্ত, ছবি ও ভিডিও স্ক্যানারে সরবরাহ করে অদৃশ্য এই চিপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে সাধারণত: কড়া নিরাপত্তা বজায় রাখার নিয়ম। এই মাইক্রোচিপ বহনকারী কাউকে শনাক্ত করা বা নজরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যুৎসই জায়গা হতে পারে বলে মার্কিন প্রশাসন মনে করে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রাথমিক প্রস্তাব করেছে, সেগুলো হচ্ছে: ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, হোয়াইটহাউস, নির্বাচন কমিশন, সশস্ত্র বাহিনীর ঘাটি, জনপ্রশাসন, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, পাবলিক পরিবহন সার্ভিস, কারাগার, কল-কারখানা ও পারমাণবিক স্থাপনা। উল্লেখ্য, মেক্সিকোতে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তার জন্য রক্ষিত অপরাধ সংক্রান্ত ডাটাবেইসে সীমিত সংখ্যক কর্মচারী ঢুকতে পারে। কর্মচারীদের ক্রিয়া-কলাপ নজরদারীর জন্য চামড়ার নিচে এই মাইক্রোচিপ ঢোকানো হয়েছে। জাপানের কতিপয় স্কুলে এই চিপ পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছে। শিশু অপহরণ রোধে শিশুদের পোশাক ও স্কুলব্যাগের লগো ডিজাইনে মাইক্রোচিপ স্থাপন করে কর্তৃপক্ষ শিশুদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তাতে এই মাইক্রোচিপের কার্যকারিতা ষোলআনা দক্ষতাপূর্ণ হিসেবে মূল্যায়িত হয়।

যদিও আর্থিক লেনদেন মনিটরিং, দুর্নীতি দমন, অপরাধী শনাক্তকরণ, গোয়েন্দা নজরদারী ও জরুরি রাস্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে এই মাইক্রোচিপের জুড়ি মেলা ভার। তবুও মাইক্রোচিপের অপব্যবহার মানুষের জীবনে আগামী দিনে কেমন বিরূপ প্রভাব ফেলবে? এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষ্য, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বা নৈতিকতার প্রতিবন্ধক হতে পারে এই মাইক্রোচিপ।’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক স্বাধীনতা সমিতির জিজ্ঞাসা, ‘এই ক্ষুদ্র চিপ মানুষের শরীরে বসে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারী করে মানুষের নিরাপত্তা বাড়াবে নাকি আরও কমাবে? এই চিপ ব্যবহারকারী কারও কি মনে হতে পারেনা যে, তাকে অপরাধীর মতো সার্বক্ষণিক নজরদারী করা হচ্ছে? আমি কোথায় রয়েছি? কোথায় কখন যাচ্ছি? কখন কি করছি? কাকে কখন কি বলছি এবং কখন কোথায় কি খাচ্ছি? এসব বিষয় প্রকাশ হওয়া মানে তো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস হওয়া। তার মানে কী? মৌলিক স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও নৈতিকতা বলতে কিছু কি আর থাকবেনা?’ এ ব্যাপারে ব্রিটেনের রাজ্য প্রশাসন ও তথ্য কমিশন সাফ জানায়, ‘কেউ যদি এ ধরণের মাইক্রোচিপ পদ্ধতি শুরু করতে চায়, সেটা তার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। শর্ত একটাই, তাকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, এ পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তথ্য সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে না।’

মাইক্রোচিপ তৈরি হয়েছে মুলত: মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়ক যন্ত্র হিসেবে অর্থাৎ মানুষের মৌলিক কল্যাণে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সার্বক্ষণিক অনুসরণকারী এই মাইক্রোচিপ দুষ্টু লোকেরা অপব্যবহার করতে কসুর করবে না। গোপনে এখানে-ওখানে ভিন্ন কৌশলে মাইক্রোচিপ ছড়িয়ে রেখে তথ্য সংগ্রহের কাজে অপব্যবহার করবে। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে নিরাপত্তা প্রশাসনের উপর পাল্টা নজরদারীও খাটাতে পারবে দুষ্কৃতিকারীরা। তাই সাধু সাবধান!
 
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
 
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank