নেশার নরক সুইপার্ক
নেশার নরক সুইপার্ক
নেশার নরক সুইপার্ক |
সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত শহর জুরিখ। জুরিখের একটি নামকরা এলাকা প্লাটজপিটজ। তবে জায়গাটা এ নামে কেউ চেনে না। নিডল পার্ক বা সুই উদ্যান নামেই বেশি পরিচিত।
জি না। এখানে সুই তৈরির কোন কারখানা নেই। তবে ১৯৮০ সাল থেকে ব্যাপকভাবে সুইয়ের বিশেষ ধরনের ব্যবহার এখানে হয়ে আসছে। লোকে বলে, নিডল পার্ক মানে নেশা করার এক অবারিত ভূমি। গোটা সুইজারল্যান্ডে মাদক ব্যবসায়ের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলেও এখানে নেই। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, সরকার এখানকার নেশাকারীদের সারাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে।
সরকারের ভাষ্য অবশ্য অন্যরকম। ‘মাদকাসক্তদের কেউ আসলে প্রকৃত অর্থে অপরাধী নয়। বরং তারা সবাই অসুস্থ এবং অসহায়। সুতরাং তাদের সাহায্য করা সরকারের নৈতিক কর্তব্য। নেশা করার জন্য একটা মুক্ত স্থান তাদের থাকা দরকার। নতুবা তারা এক সময় ছড়িয়ে পড়বে গোটা সভ্য দেশে। সৃষ্টি করবে ভয়ানক পরিস্থিতি।’
অথচ আগে সুই পার্ক ছিল চমৎকার বিনোদন স্পট। হরেক রকম গাছপালার সবুজ সজ্জিত বিস্তৃত এ মাঠে যে কেউ দু’দন্ড শান্তি খুঁজে পেতো। শিশুরা খেলতো। পিকনিক হতো। এখন মাঝখানে বদলে গেছে সব পরিবেশ। দু’একজন করে মাদকাসক্তের আড্ডা জমতো ক’দিন আগেও। কোন ধরণের বাঁধা না পেয়ে ভারি হয় এদের দল। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যেই পুরো পার্কটা নেশাখোরদের দখলে চলে যায়। মাদক সেবনের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন অপর্কমও চলে। খুন, জখম, মারমারি, ধর্ষণ এসব নিত্যকার ঘটনা।
জুরিখের সেন্ট্রাাল রেলওয়ে স্টেশন থেকে সামান্য এগুলেই পড়ে এই পার্ক। এলাকাটি সরকার স্বীকৃত সুবিশাল উন্মুক্ত মাদক বাজার ছিল। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা প্রকাশ্যে হেরোইন, কোকেন, হাশিশ বেচাকেনা হয়ে থাকে। উঁচু গলায় চিৎকার করে চলে মাদক বেচাকেনা। গড়ে প্রতিদিন তিন’শ চড়া মাদকসেবী এখানে মাদক নেয়। ঝড়, বৃষ্টি, রাত-দিন, গ্রীষ্ম-শীত কোনটাই গা করেনা ওরা। সারাক্ষণ পড়ে থাকে পার্কে। সঙ্গে অনিয়মিত মাদকসেবীরা তো রয়েছেই। তবে সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে প্রায় সাড়ে চার হাজার মাদক সেবীর মেলা বসে এখানে। প্রচন্ড ভিড়ে গমগম করে সুই পার্ক। পরিত্যক্ত হাজার হাজার সিরিঞ্জ সুইয়ের স্তুপ জমে পরদিন। অনেক মাদকাসক্ত মাটিতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে।
এক শীতের সকালে শিশুসহ বাবা মাকে আবিষ্কার করে পুলিশ। আবর্জনার স্তুপের পাশে কম্বল জড়িয়ে পড়েছিলো ওরা। কম্বলের ওপর জমে রয়েছে বরফ তুষার। মা জেগে ওঠেই নিজের এক পায়ে ঢুকিয়ে দেয় সুই।
যেহেতেু সরকারিভাবে সমর্থিত, সেহেতু নামমাত্র মূল্যে প্রয়োজনীয় মাদকদ্রব্য এবং সুই, সিরিঞ্জ, চা, কফি জাতীয় হালকা খাবার বিনামুল্যে সরবারাহ করছে সরকার। সিরিঞ্জ ব্যবহারের নিয়ম কানুন আরামদায়কভাবে ড্রাগ নেয়ার কৌশল, ব্যবহৃত সিরিঞ্জ অন্যজনের ব্যবহার না করা ইত্যাদি পরামর্শ দেয় এখানে নিয়োজিত বেতনভোগী পর্যাপ্ত সংখ্যক সরকারি প্রতিনিধি। নেশাকারীরা তাদের উপদেশ ভালোভাবেই মেনে চলে।
মাদকসেবীদের স্বর্গ ভূমি নিডল পার্ক এখনো ইউরোপসহ গোটা বিশ্বে মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা টাকা-কড়ি নিয়ে এই পার্কে পা রেখে হয়েছে সর্বশ্বান্ত। এখানে প্রতিদিন আসে বিদেশী মাদক পর্যটক। স্কুলে লেখাপড়ার প্রচন্ড চাপ, পরীক্ষায় খারাপ করা, বাবা-মার বকুনি খাওয়া হতাশাগ্রস্থ অসংখ্য তরুণ-তরুণী এখানে নিয়মিত হাজিরা দিতে আসে। এখানকার মাদকদ্রব্যের ব্যাপারে বিস্তার গোটা জুরিখে রীতিমতো ত্রাসের সঞ্চার করে। সুই পার্কের আশেপাশে বসবাসকারী পরিবারের অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছে।
জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা সুই পার্ককে আইনবিহীন এলাকা বলে অভিহিত করেন। সুই পার্কের অবস্থা নিয়ে জুরিখবাসীদের ভেতর উত্তরোত্তর বেড়ে চলছে ক্ষোভ আর আতংক। তাদের অভিমত, ‘সমাজটা নেশাখোরদের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মাকাসক্তদের প্রতি সহানূভূতিশীল হওয়ার নামে সরকার এরকম ভয়াবহ অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না। সাধারণ নাগরিকরাই শুধু নয়, পুলিশ কর্মকর্তারাও মাদকসেবীদের বিষয়ে কঠোর হতে সরকারকে পারমার্শ দিচ্ছেন। জুরিখের অভিভাবক ও শিক্ষক মহল এ নিয়ে ভয়ানক চিন্তিত। তাদের ছেলে-মেয়ে ও ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত কি হবে? কতদিন তাদের সুই পার্কে অদৃশ্য আকর্ষণ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হবে? স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির মুখে সরকার অবশ্য অতিদ্রুত মাদককে নিরুৎসাহিত করতে ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব নীতি কতোটা কার্যকর হয় তা এখন দেখার বিষয়।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এমফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?