ধুমপান রোধে পট্টি
ধুমপান রোধে পট্টি
ধুমপায়ীদের করোনা বেশি কাবু করে বলে সম্প্রতি করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে জনসম্মুখে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে তুরস্কসহ কিছু দেশ। ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কথাটা সকলেই জানেন। তবুও ধুমপান চালিয়ে যান। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বে ৪ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করে ধুমপানের ফলে। এই কু-অভ্যাস তাড়াতে গিয়ে নানান প্রচেষ্টা চালানোর পরেও ব্যর্থ হন কেউ কেউ। যেমন, ধুমপানের টান উঠলেই অন্যকিছুতে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখা, গান শোনা, ব্যায়াম করা, স্মার্টফোনে গেম খেলা, বাগানে নতুন কোনও গাছ লাগানো, লজেন্স, চুইংগাম ইত্যাদি খাওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক তথ্যে প্রকাশ, ধুমপায়ীদের শরীরে এক ধরণের বিশেষ জিন তৈরি হয় এবং তা শরীরে অবস্থান করে। এমনিতেই ধুমপানে হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু অপরিমিত ধুমপায়ীর শরীরে তৈরি হওয়া এ জিনটি হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি আরও তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত প্রিন্স হেনরি বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক ডেভিড উইলকেন ও তাঁর সহযোগীরা ধুমপায়ীর দেহে এমন এক জিনের সন্ধান পেয়েছেন, যা সামগ্রিক জনসংখ্যার শতকরা প্রায় সাত ভাগের শরীরে অবস্থান করছে। ধুমপায়ীদের শরীরের সাত নম্বর ক্রোমোজোমের লম্বা বাহুতে জিনটি পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা এই ধরণের বিশটি জিনকে সনাক্ত করতে পেরেছেন। যেসব জিন শরীরের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি ও রক্ত জমাট বাঁধার কাজে ভূমিকা রাখে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ক্ষতিকর জিনটি কোন কোন ক্ষেত্রে অধুমপায়ীর শরীরেও বাসা বাঁধে পরোক্ষ ধুমপানের আক্রান্ত হবার কারণে। তবে তাদের শরীরে এ জিনটির প্রভাবে রক্ত নালীর সঙ্কোচনশীল অবস্থা সৃষ্টি হলেও খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু জিনটি অপরিমিত ধুমপায়ীর শরীরে অবস্থান করে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা মন্তব্য করেন, এমনিতেই ধুমপানের ফলে নিকোটিনের প্রভাবে রক্তনালী সঙ্কোচিত হয়ে হৃদরোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়। তার ওপর নতুন আবিষ্কৃত জিনটি অবস্থান করলে আরও বেশি দ্রুত হৃদরোগে আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে। এই ক্ষতিকর জিন যাদের শরীরে থাকে তাদের কেউ কেউ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ধূমপান ত্যাগ করে আবার ধুমপানে আসক্ত হয়েছেন। কেউবা সাত থেকে আটদিন পর আবার ফিরে এসেছেন ধুমপানে। কিন্তু কেন? এদের এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কী কোন পথ নেই?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, ধুমপান ত্যাগের নতুন এক বৈজ্ঞানিক চমক। যার নাম ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’। এটি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পট্টির নাম। যার মধ্যে রয়েছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টি নিকোটিন পদার্থ। এই পট্টি দেখতে অনেকটা বাজারে বহুল প্রচলিত জ্বরের ব্যথা নিবারক তালি, পট্টি বা গজ ব্যান্ডেজের মতো। যার প্রতিটিতে রয়েছে একুশ মিলিগ্রাম ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যান্টি নিকোটিনের রাসায়নিক প্রলেপ। জিএসকে প্রোডাকশনের ব্যানারে বাজারজাতকৃত ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’ এর প্রতি প্যাকেটে রয়েছে মোট সাতটি পট্টি বা প্যাচ। পরপর সাতদিন এই পট্টি ব্যবহার করতে হয়। শরীর থেকে নিকোটিন শুষে নেয়ার কাজ করার কারণেই বিশেষ মুহুর্তে ধুমপায়ীর ধুমপানের মানসিকতা বা ইচ্ছা তাৎক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ব্রিটেনে লাখ লাখ মানুষ অ্যান্টি নিকোটিন সমৃদ্ধ এই পট্রি ব্যবহারের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ধুমপান ত্যাগে সফল হয়েছেন। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ধূমপান প্রতিরোধের ব্যাপক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্বীকৃত এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ধুমপান নিবারণে একটি কার্যকর রাসায়নিক প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। প্রস্তুতকারক কোম্পানির পরিচালক ড. লুই রুসেল বলেন, “ধুমপান করা বা না করার মাঝখানে মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদন্ধের বিরুদ্ধে ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’ জাদুর কাঠির মতো কাজ করে থাকে।” তিনি আরও জানান, সাধারণত হঠাৎ করে ধুমপান ত্যাগ করলে বা শরীর থেকে নিকোটিন আকস্মিক প্রত্যাহার করা হলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিষন্নতা, উত্তেজনা এবং শরীরে খিঁচুনি দেখা দেয়। এ কারণে বেশিরভাগ ধুমপায়ী মানুষ তিনদিনের বেশি ধুমপান বাদ দিয়ে থাকতে পারেন না। কিন্তু ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’ এ সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
কোন এক ভোরে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ থেকে আপনি ধুমপান ছেড়ে দেবেন। ব্যাস। প্রথম দিনে হাতের কব্জিতে সেটে নিতে হবে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম পট্টি ‘নিকোডার্ম সিকিউ প্যাচ’। এরপর ক্রমান্বয়ে প্যাকেটে থাকা নিম্ন ক্ষমতাসম্পন্ন পট্রি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে যারা দৈনিক দশটির কম সিগারেট খান তাদের জন্য মধ্যম শক্তি সম্পন্ন পট্রি ব্যবহার করাই যুক্তিযুক্ত। পট্রি লাগানোর মাত্র ক’সেকেন্ডের মধ্যেই শরীর থেকে চুম্বকের মতো নিকোটিন শুষে নেয়ার কাজ শুরু করে। চব্বিশ ঘন্টা পর ঠিক একই সময়ে পুরনো পট্রি খুলে ফেলে দিয়ে আরেকটি নতুন পট্টি বেঁধে নিতে হয়। দিনের বেলা এবং যতক্ষণ আপনি সজাগ থাকবেন আপনার মনে একবারও ধুমপানের আসক্তি তৈরি হবে না। ধুমপান ত্যাগে ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যাবে। নিয়ন্ত্রিত হবে ধুমপান। শান্ত এবং ধীর হবে আপনার মন। শরীর হবে চাঙ্গা। ফিরে পাবেন চনমনে নতুন জীবন।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?