মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বাড়ি-ঘরের জীবাণু কেন ভয়ংকর?

শেখ আনোয়ার

১২:০৮, ২০ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১২:১২, ২০ আগস্ট ২০২১

১৩৪৩

বাড়ি-ঘরের জীবাণু কেন ভয়ংকর?

গোটা বিশ্বের মানুষ ভালোভাবে জেনে গেছে করোনাসহ নানান জীবাণু থাকে বাইরের বাতাসে। তাই করোনা থেকে নিজেকে ও পরিবারের সবাইকে জীবাণুমুক্ত রাখতে প্রায় সবাই সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। করোনা থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে মানুষ ৯০ শতাংশ সময় কাটাচ্ছেন। আপনি কি জানেন? ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে থাকলেও জীবাণু থেকে কোন রেহাই নেই? আপনার বাড়ি-ঘর, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব ঘর-বাড়িতে জীবাণুতে ভরপুর?

বাড়ি-ঘরের জীবাণু কেন ভয়ংকর?
গবেষকদের মতে, যে কোন পরিচ্ছন্ন ঘরের ধুলোর মধ্যে থাকা জীবাণুর কারণে করোনার মত অবিকল অনুরূপ শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নাক থেকে পানি ঝড়া, গলাব্যাথা, কাঁশি ও অ্যালার্জি হতে পারে। বছর ব্যাপি মানুষ ভোগে বাড়ি-ঘরের জীবাণুর কারণে। এই জীবাণু করোনার মতো দ্রুত ও সংক্রামক না হলেও মৃত্যু ঘটায় নীরবে। বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বে প্রতিবছর ১.৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয় শুধু বাড়ি-ঘরের অদৃশ্য জীবাণুর কারণে। বাড়ি-ঘরের এসব জীবাণু নিশ্বাসের সঙ্গে ঢোকার ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। চোখ চুলকায়, চোখ থেকে পানি ঝড়ে, মাথা ব্যথা করে, হাঁচি-কাঁশি, গলাব্যাথা ও ফ্লু হয়। আর তাই বাইরের বাতাসের জীবাণুর চেয়ে বাড়ি-ঘরের জীবাণু অনেক বেশি ভয়ংকর।

 

বাড়ি-ঘরের জীবাণুর উৎস কি?
ক্লিন এয়ার ইন্ডিয়া মুভমেন্টের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রকাশ, ‘বায়ুবাহিত রোগের জন্য ঘরের পরিবেশ ৩১ শতাংশ দায়ী।’ এক ঘর থেকে আরেক ঘরের ফার্নিচারের প্রকারভেদ, ঘরের আর্দ্রতা, পোষা প্রাণীর উপস্থিতি ইত্যাদির কারণে বাড়ি-ঘরের জীবাণু উপাদানগুলো কম-বেশি হয়ে থাকে। বাড়ি-ঘরের জীবাণু বেশি থাকে- টাকা, পোশাক, স্পঞ্জ, ডাস্টার, ট্রে, কাপ, টেবিল, দরজার হ্যান্ডেল, ময়লার ক্যান, ফুলের পরাগ ইত্যাদিতে। বাড়ি-ঘরে থাকা জীবাণুর মূল উপাদান বা উৎস হতে পারে সুতোর আঁশ, মানব দেহের ত্বকের মৃত কোষ, খাদ্যকণা, প্রাণীর লোম, আনুবীক্ষণিক জীবাণু, তেলাপোকার প্রতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়া। এসব জীবাণুতে রয়েছে অনেকগুলো ক্ষতিকর জিনিসের মিশ্রণ। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবাণু হলো প্রাণীর লোম, তেলাপোকা এবং ধুলোর মধ্যে থাকা অন্যান্য জীবাণু। এগুলো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। তবে এসবের যে কোন একটির কারণে যে কোন ব্যক্তি জটিল ফুসফুসের রোগসহ নানা রকম অসুখে ভুগতে পারেন।

বাড়ি-ঘরের ভয়ংকর জীবাণু কি কি?
গবেষকরা বলেন- ‘যে ঘরে মানুষের বাস, সে ঘরে জীবাণুর বসবাস।’ কথাটি একদম সত্যি। অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীবাণুগুলো আটপায়ের অ্যারাকনাইড পরিবারের অন্তর্গত। আঁটুলি পোকা এবং চিগার একই পরিবারভুক্ত। এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বালিশে, মাদুরে, কার্পেটের ভাঁজে এবং আসবাব পত্রের তলায়। এগুলো শক্ত দেহের অধিকারী। এরা ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তারচেয়ে বেশি উচ্চ তাপমাত্রায়ও ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সক্ষম। ৭৫-৮০ শতাংশ আর্দ্রতাই এদের পছন্দ। আর্দ্রতা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের কম হলে এদের বংশ বৃদ্ধি হয় না। শুষ্ক আবহাওয়ায় এদের দেখা মেলে না। হাঁপানি রোগীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই এসব জীবাণুর সংস্পর্শে এলে হাঁপানি প্রতিক্রিয়া বেড়ে যায়। আর এসব জীবাণু দেহ ও মুখমন্ডলের সংস্পর্শে এলে অ্যালার্জি হয়। অ্যালার্জি রোগীদের শ্বাসের সঙ্গে বাড়ি-ঘরের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে এবং উপসর্গ বাড়িয়ে দেয়। যদি কোন ব্যক্তি আট ঘন্টা ঘুমান তবে তার নাক, মুখসহ জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় প্রকৃতপক্ষে বালিশে বাসা বেঁধে থাকা জীবাণুগুলোর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থাকেন। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘একটি বালিশে সর্বোচ্চ ১৯০০০ পর্যন্ত জীবাণু থাকতে পারে। প্রত্যেক জীবাণু দিনে ১০টি নতুন জীবাণু সৃষ্টি করে। এদের বেঁচে থাকার মেয়াদ ত্রিশ দিন। এদের খাদ্য মূলত পশুর লোম এবং ত্বকের মৃত কোষ।’ 

বাড়ি-ঘরে ব্যাকটেরিয়ার কলোনি
গবেষকদের মতে, দু’টো জিনিস ঘরের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার কলোনি গড়তে বিশেষ ভ‚মিকা রাখে। প্রথমত: বেশি আর্দ্রতা। যা শতকরা ৫০ এর বেশি থাকে। পানির পাইপের ক্ষুদ্র ফুটো বা ছিদ্র বা যে কোনো পানির প্রবাহ এতে ভ‚মিকা রাখে। দ্বিতীয়ত: দেয়ালে কোন বোর্ড থাকলে বা স্যাঁতস্যাঁতে আসবাব থাকলে সেখানে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া জন্মায়। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর কাপড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। এই স্পোর থেকে অনুক‚ল পরিবেশে সুনির্দিষ্ট জীবনচক্রের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। যেসব মানুষের ব্যাকটেরিয়ায় অ্যালার্জি রয়েছে, এমন ব্যাকটেরিয়া অধ্যুষিত ঘরে থাকলে নিশ্চিতভাবে নিঃশ্বাসের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে বলে শরীর বিজ্ঞানীরা বলেন। 

বাড়ি-ঘরের জীবাণু কি মৌসুমী?
বাড়ি-ঘরের ধুলোতে মিশে থাকে তেলাপোকার বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ। বিশেষ করে পুরোনো বাড়ি ঘর ও ফ্ল্যাটবাড়িতে এসব বেশি থাকে। আধুনিক নগর জীবনে অ্যাপার্টমেন্টের বিভিন্ন ফ্লাটে বিভিন্ন পরিবার বসবাস করেন। বিশেষ করে অ্যালার্জি আক্রান্ত, হাঁপানি রোগী এ ধরনের বাড়িতে গেলে রোগের উপসর্গ বেড়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, বাড়ি-ঘরের ধুলোর জীবাণু কি মৌসুমী? গবেষকরা উত্তরে জানান, ‘যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়, ঘরের জীবাণুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয় জুলাই-আগষ্ট মাসে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই উচ্চ সংখ্যা বজায় থাকে। বছর শেষের দিকে ধুলোর জীবাণু ঘটিত অ্যালার্জির সংখ্যা সবচেয়ে কম থাকে। আবার বিভিন্ন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণও কমবেশি ঘটে। দেখা যায় গ্রীষ্মের সময় তেলাপোকার পরিমাণ বেশি হয় আর গ্রীষ্মকালে মানুষ ঘরে সচারচর বেশি সময় কাটায় বলে এই সময়ে অ্যালার্জির উপর্সগও বেড়ে যায়।’

বাড়ি-ঘরের জীবাণু তাড়াতে কি করবেন?
সাধারণত ঘর-বাড়িতে যেসব জীবাণুরোধক ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ঘরের জীবাণু থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি  ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে যত চেষ্টাই করুন না কেন, কার্পেট, মাদুর এবং বালিশ থেকে জীবাণু পরিপূর্ণভাবে অপসারণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। ঝাড়– দিলে বা ভ্যাকুয়াম ক্লিনার প্রয়োগ করলে সাময়িক সরে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়তে পারে। ফলে ঘরের জীবাণুর পরিমাণ কমানো সম্ভব হয় না। সমীক্ষায় প্রকাশ, মানুষ তার জীবনের গড়পড়তা এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটায় বেডরুমে। তাই অ্যালার্জিতে আক্রান্ত ব্যক্তির শোবার ঘরের দিকেই বেশি মনযোগ দিতে হবে। এজন্য বেছে নিতে হবে এমন শোবার জিনিসপত্র, যেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় এবং যাতে অ্যালার্জির পরিমাণ কম থাকে। বালিশে ফোম বা তুলো ব্যবহার না করে সিনথেটিক ব্যবহার করা দরকার। সপ্তাহে অন্তত: একবার বিছানাপত্র ধুয়ে রোদে আধঘন্টা রেখে শুকিয়ে নিতে হবে। যেসব জিনিস ও আসবাবপত্র নিয়মিত পরিষ্কার করা সম্ভব নয়, সেগুলো বেডরুমে না রেখে অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে বেডরুমের এসির ফিল্টার নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। এমন ধরনের এসি ব্যবহার করতে হবে যার দ্বারা ঘরের আর্দ্রতা শতকরা ৫০ ভাগের নিচে রাখা সম্ভব। বাইরে থেকে আসার পর জুতা-স্যান্ডেল জীবাণুমুক্ত করতে হবে। শোবার ঘরে কখনও পোশা প্রাণী ঢুকতে দেয়া যাবে না। ঘরে কোনো মৃত প্রাণী বা প্রাণীর অংশ থাকলে অবিলম্বে বাইরে ফেলে দিতে হবে। নিয়মিত বিরতিতে ঘর পরিষ্কার করতে হবে। মেঝে মোছার সময় স্যাঁতস্যাতে ও তৈলাক্ত কাপড় ব্যবহার করা যাবে না। ঘর পরিষ্কারের সময় অবশ্যই মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

আর হ্যাঁ, আজকাল বাজারে ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ করণের যন্ত্র, আর্দ্রতারোধক যন্ত্র ইত্যাদি গেজেট সুলভ মূল্যে অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ঘরে আর্দ্রতা কম থাকলে জীবাণুর বংশবিস্তার রোধ হয়।

শেখ আনোয়ার: লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank