মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মাছ শিকারে ওস্তাদ পাফিন

শেখ আনোয়ার

১৩:৩৮, ৬ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৩:৪৭, ৬ আগস্ট ২০২১

১২৩৭

মাছ শিকারে ওস্তাদ পাফিন

ছোট্ট ডানাওয়ালা সামুদ্রিক পাখি পাফিন। অনেকেরই ধারণা, এই পাফিন পৃথিবীর সুন্দর পাখিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদের ঠোঁট দেখতে অবিকল শিমুল-পলাশ ফুলের মত। ঠোঁটের আকার অনেক বড় হয়। ঠোঁটের গড়ন এতো বিচিত্র যে, মাছ শিকারে দারুণ ওস্তাদ পাফিন। সচরাচর এই পাখি একসঙ্গে এক ডজনের বেশি মাছ শিকার করলেও, একসঙ্গে সত্তরটি পর্যন্ত মাছ ঠোঁটে ধরে রাখার রেকর্ড রয়েছে পাফিনদের। ঠোঁটের এই আকৃতির কারণে এদের সামুদ্রিক তোতা পাখিও বলা হয়। আবার কেউ কেউ আদর করে এই পাখিকে সমুদ্রের কৌতুককারী ভাঁড় পাখিও বলেন। 

পাফিন পাখিটা দেখতে কেমন?
এই পাখি গাঁট্টাগোট্টা, স্বল্প পাখনাযুক্ত ও ছোটো লেজ যুক্ত। পাফিন পাখি প্রায় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। পুরুষ ও স্ত্রী পাফিন দেখতে একই রকম। তবে পুরুষটি আকারে একটু বড় হয়। ওজন আধা কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের উপরের অংশ কালো এবং নিচের অংশ সাদা বা ধূসর রঙের। মাথায় একটি কালো টুপির মতো অংশ রয়েছে। ঠোঁটের রঙ লাল, নীল ও হলদে হয়। তবে প্রজনন কালে ঠোঁট দেখতে অতি উজ্জ্বল হয়। পায়ের রঙ কমলা। পায়ের পাতা ঠিক হাঁসের মত। গায়ের রঙ পেঙ্গুইনের মত। তবে পেঙ্গুইন বাস করে দক্ষিণ গোলার্ধে আর পাফিন বাস করে উত্তর গোলার্ধ্বে। পেঙ্গুইন উড়তে না জানলেও পাফিন জানে। প্রচন্ড শীতল আবহাওয়ায় নিজেদের সহজে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম পাফিন। 

কোথায় দেখা যায় পাফিন?
সাধারণত তিন প্রজাতির পাফিন রয়েছে। যেমন- আটলান্টিক, হর্নড ও টাফটেড পাফিন। এদের মধ্যে টাফটেড পাফিন এবং হর্নড পাফিন প্রজাতি দু’টোর দেখা মেলে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে। ব্রিটেনের আইল্যান্ড অব মে হচ্ছে আটলান্টিক পাফিনদের সর্ববৃহৎ আস্তানা। এরা প্রধানত বড় হয় আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, নিউফাউন্ডল্যান্ড এবং উত্তর আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জে। উত্তর নরওয়ের রোস্ট ও কারো দ্বীপপুঞ্জেও অনেক পাফিন দেখা যায়। শীতকালে মরোক্কো ও নিউইয়র্কেও দেখা মেলে পাফিন। আটলান্টিক পাফিন দেখা যায় সাধারণত উত্তর আটলান্টিক, উত্তর ইউরোপের উপকূলীয় ফ্রান্স, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ, ফারো দ্বীপপুঞ্জ এবং কানাডা অঞ্চলে।

 

কোথায় থাকে পাফিন?
আটলান্টিক পাফিন সারাদিন বেশিরভাগ সময় আটলান্টিক সাগরে আরাম করে ভেসে বেড়ায়। রাত হলে ঠাঁই নেয় সাগর পাড়ে ঘাসে মোড়া ঢালের গর্তে। খরগোশ বা কাঠ বিড়ালীর গর্তের মত অসংখ্য গর্ত রয়েছে দ্বীপের মাঠে। এগুলো পাফিনদের ঘরবাড়ি। বেশিরভাগ সময় এসব গর্তের মধ্যে ঢুকে থাকে বলে ওদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সাগরের ঢালে মৌচাকের মত অসংখ্য ক্ষুদে আস্তানাগুলো ওরাই গড়ে তুলেছে। ওদের ঠোঁট খুবই শক্ত ও ধাঁরালো। ফলে মাটি খুঁড়ে গর্ত করতে কোন সমস্যা হয় না। মাঝে মাঝে পাফিনরা পাথরের নিচেও বাসা বাঁধে। ছেলে এবং মেয়ে উভয় পাখি মিলে বাসা তৈরি করে। সেখানে ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোঁটায়। পাফিন নিয়ে সম্প্রতি অবাক করা তথ্য দিয়েছেন গবেষকরা। ‘এক সঙ্গীকে নিয়েই জীবন পার করে ছোট্ট এই অপরূপ পাখি!’ মেয়ে পাফিন বছরে শুধু একটি ডিম পাড়ে। ছেলে ও মেয়ে পাখি, পালা করে ওই ডিমে তা দেয়। বাচ্চা ফুঁটলে বাচ্চা পাফিনকে দু’জনে মিলে নিয়ম করে খাওয়ায়। পাফিন পাখি সাধারণত মাছ এবং সামুদ্রিক পোকা-মাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে ছোট বাচ্চা পাফিনকে খাবার খেতে দেয়া হয় ছোট ছোট মাছ। একটি বাচ্চা পাফিনের দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার খাবার প্রয়োজন হয়। সাগরের ধারে আটলান্টিক পাফিন মুক্ত পরিবেশে প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

উভচর পাখি পাফিন
পাফিনরা সংঘবদ্ধ হয়ে বাস করে। ছোট ছোট দল নিয়ে উড়ে চলে ওরা। সমুদ্রের আকাশে উড়তে পাফিন দক্ষ। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘পাফিনের ডানাগুলো ছোট হলেও পাখনার পরিচালন সাধ্যতা খুব বেশি। তাই উড়ার ক্ষেত্রে বেশ পারদর্শী। প্রতি মিনিটে প্রায় ৪০০ বার ডানা ঝাপটায় এবং ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে।’ বসন্ত আর গ্রীষ্মে লাখ লাখ পাফিন দল বেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে যখন উড়ে বেড়ায় তখন ঢেকে যায় নীল আকাশ। শুধু তাই নয়। পানিতে ডুব-সাঁতারেও সমান পটু পাফিন। পানির উপর থেকে মাছ দেখলেই হয়েছে। পানির মধ্যে ডাইভ মেরে ঠোঁটের সাহায্যে দক্ষভাবে মাছ শিকার ধরতে ওস্তাদ পাফিন। শিকার ধরতে কখনো এরা ডুব দিয়ে দু’শ ফুট পানির নিচেও চলে যেতে পারে। সাঁতার কাটার সময় শুধু পা ব্যবহার করে না। ডানাকে বৈঠার মতো ব্যবহার করে পানিতে চলতে পারে। ডানা ব্যবহার করার কারণেই সম্ভবত এদের এই ধরনের চলনকে উড়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়। সাঁতার কাটার সময় ছোটো ছোটো মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। 

কোথায় যায় পাফিন?
গবেষকরা বলেন, ‘শীতের সময় পাফিনের টিকিটাও দেখা মেলে না। ওই সময় কোথায় যায় পাফিন?’ বিজ্ঞানীরা জানান, ‘সাধারণত সাগরের যে অংশে মাছ বেশি থাকে পাফিনরা সেখানেই বসতি গড়ে। কারণ মাছ ওদের অতি প্রিয় খাবার। যদিও পাফিন শিকার নিষিদ্ধ। পাফিনের মাংস বেশ সুস্বাদু হওয়ায় চোরা শিকারীরা বিশেষ ধরণের জাল দিয়ে শূন্য থেকে পাফিন শিকার করছে।’ জোনাসন নামের এক পাফিন শিকারী সম্প্রতি আট ঘন্টায় বার’শ চারটি পাফিন জাল দিয়ে ধরে রেকর্ড গড়েছেন। উত্তর আমেরিকার অভিবাসীরা খাবার ও পালকের জন্য আটলান্টিক পাফিনকে শিকার করে। দু’ লাখেরও বেশি পাফিন ধরা পড়ে এই মৌসুমে। আমেরিকায় পাফিনের পালক দিয়ে সৌখিন টুপি, বালিশ, তোষক ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এভাবেই জুলাই থেকে মধ্য আগষ্ট পর্যন্ত আইসল্যান্ডে চলে পাফিন শিকার।

পাফিনের বাচ্চা কম হওয়া, মাংস ও পালকের লোভে গণহারে শিকার করার কারণে বিলুপ্ত হতে চলেছে পাফিন। শংকিত বিজ্ঞানীরা পাফিন বাঁচাতে গঠন করেছেন পাফিন রক্ষা সমিতি।  

লেখক: লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank