বাবা হচ্ছেন বরিস, প্রসববেদনায় ব্রিটেনের পত্রিকা
বাবা হচ্ছেন বরিস, প্রসববেদনায় ব্রিটেনের পত্রিকা
বাবা হতে যাচ্ছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। বরিসের স্ত্রীর ইনস্টাগ্রামের একাউন্ট থেকে এই খবরটি লাফিয়ে লাফিয়ে ব্রিটেন মাত করেছে। কিন্তু ‘যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই’ দশা ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলোর। পহেলা আগস্ট (রবিবার) ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো দেখে তাই মনে হয়েছে। বাবা হচ্ছেন বরিস, ‘প্রসববেদনায়’ ভুগছে ব্রিটিশ পত্রিকাগুলো!
ব্রিটেনের সাংবাদিকতায় একটি রম্যকথন চালু আছে যে, প্রধানমন্ত্রী বরিস আদতে কত জন সন্তানের বাবা, এ প্রশ্ন সবসময় এড়িয়েই যান তিনি। হ্যাঁ, গত তিন বছর ধরে খেয়াল করেছি, জনসন আগাগোড়াই সাংবাদিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পারিবারিক জীবন একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, এ নিয়ে তিনি কোনও কথা বলতে চান না। কিন্তু পাপারাজ্জি তার পিছু নিয়েছে। গত ভোটের আগে সংবাদমাধ্যম তাঁকে বারবার পরিবার, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি উত্তর দেননি। পাল্টা হেসে মৃদু বিরক্তি নিয়ে বলেছেন, ‘‘আমার মনে হয় না, এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে আমার দেশের নাগরিকরা আগ্রহী। তার চাইতে ব্রেক্সিট কী ভাবে হবে, মানুষ বরং সেটা জানতে আগ্রহী।’’
খবরে প্রকাশ, যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে ২০০ বছরের মধ্যে বরিস জনসনই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি দায়িত্বরত অবস্থায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ৫৭ বছর বয়সী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় বিয়ের সংসার চলছে। ফলে এর আগেও দু’বার কবুল বলতে হয়েছে তাঁকে। দ্বিতীয় স্ত্রী আইনজীবী ম্যারিনা হুইলারের ঘরে আছে চার সন্তান। করোনা মহামারির মধ্যেই ২০২০ সালে ম্যারিনার সঙ্গে বরিসের বিচ্ছেদ ঘটে।
ব্রিটেনের রাজনীতির অন্দরের খবর রাখা সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক কামাল আহমেদের মতে, সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এভাবে ‘খোঁচা মেরে’ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সংবাদ পরিবেশন মত ও বাকস্বাধীনতার উদাহরণ। করোনাকালে রাষ্ট্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে বরিস জনসনের ধীরে চলো নীতির কারণে তাকে এভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এমনটি হতে পারে। ব্রিটিশ কালচারে তা আপত্তির কিছু নয়। রবিবার গড়িয়ে সোমবার হলেই মানুষ তা মনে রাখবে না। এখানকার সাংবাদিকতায় ব্যঙ্গ ও খোঁচা মারার প্র্যাকটিস দীর্ঘদিন ধরে চর্চিত।
পহেলা আগস্ট ২০২১ রবিবারের ব্রিটিশ সংবাদপত্রের বরিসের বাবা হওয়ার খবরে বিবিসি’র বিশেষ একটি নিবন্ধ (Newspaper headlines: 'Kebabs for jabs' and 'baby no 2' for PM and Carrie) প্রকাশিত হয়েছে। সেই সংবাদে কিছু বিশ্লেষণ রয়েছে। যেমন, The Sunday Telegraph-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম সংবাদে বলা হচ্ছে সরকারে তরুণদের বিনামূল্যে ট্যাক্সিতে ভ্রমণ, টেকওয়ে এবং সুপারমার্কেটে বিশেষ ছাড় দিবে, যদি তারা কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করে। এই লিড নিউজের পাশেই চারকলাম জুড়ে সস্ত্রীক হাস্যোজ্জ্বল বরিসের ছবিতে শিরোনাম করা হয়েছে অনেকটা এরকম- ‘কলিজা কাঁপানো খবর’। Sunday People শিরোনাম করেছে Kebabs for Jabs অর্থাৎ এ শিরোনামের মাধ্যমে তরুণদের ভ্যাক্সিন নেয়ার ফলে যে উপহারগুলো ভোগ করবে তারই একটি দৃশ্য বর্ণনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বরিস ও তার স্ত্রীর স্পেশাল লিড ছবিতে ক্যাপশন দিয়েছে ‘রেইনবো বেবি’ হিসেবে। The Sunday Mirror এর লিড নিউজ করা হয় বরিস জনসন এবং স্ত্রী ক্যারি তাদের দ্বিতীয় সন্তানের খবর। তারা লিখেছে মিস জনসন তার গর্ভধারণের খবর ইন্সটাগ্রামে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও আগের গর্ভপাতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। দম্পতি ইতিমধ্যে তাদের ১৫ মাসের ছেলে উইলফ্রেডের বাবা-মা। The Mail on Sunday-এরও লিড নিউজ হিসেবে জনসনের গর্ভাধানের সংবাদ শীর্ষে রাখা হয়েছে। শিরোনামে জনসনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়- “We are having a rainbow Xmas baby” - এই উক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে তাদের সন্তান আগামী খ্রিসমাসে প্রত্যাশা করছেন এবং rainbow baby-এর মানে হলো কোনো সন্তান যে গর্ভপাতের পরও জন্মগ্রহণ করে। এদিকে The Sunday Express পত্রিকায়ও এই খবরকে প্রধান সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করা হয়। শিরোনামে মিস. জনসনের উক্তি ব্যবহার করা হয় ‘অবিশ্বাস্য ভাবে ধন্য আবার গর্ভবতী হতে পেরে’। The Daily Star পত্রিকায় এই খবরটি লিড নিউজ হিসেবে এসেছে একেবারে আদি রসাত্মক শিরোনাম আকারে So THAT’s what he’s been doing in the lockdown অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন লকডাউনে কী কাজ করছিলো! এই সংবাদে হাস্যরসের সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। The Sunday TImes শিরোনাম করেছে, ‘বরিস এখন ৭ম বারের মতো বাবা হতে যাচ্ছে। এ সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে তার স্ত্রী ক্যারির সাথে এটি তার দ্বিতীয় সন্তান এবং সর্বমোট ৭টি সন্তান হবে।
আমরা জানি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সংবাদপত্র অফিসগুলোতে ‘ডাল ডে’ হিসেবে থাকে। তেমন কোন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর না থাকায় ছুটির দিন পত্রিকা ভরানো হয় আগের কোন খবর দিয়ে। এই প্রসঙ্গে যোগাযোগ করি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সাথে। হোয়াটসএপ কলে তিনি জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফ্রাইডে নিউজ ডাম্প’ বলে একটি ব্যাপার আছে। রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ‘খারাপ খবর’টি যেন শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের বলা হয়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুক্রবার থেকেই সপ্তাহান্তের ছুটির মেজাজে চলে যান। এরপর উইকএন্ড শনিবার ও রোববার। ফলে এসময় প্রশাসনের জন্য কোন ধরণের খবর পত্রিকার পাতায় আসছে, তা বেশ কৌতুহল জাগানিয়া। একে বলে ‘টেইক আউট দা ট্র্যাশ ডে’। আসল ঘটনাটি হলো, প্রশাসনের জন্য যে খবরটি খারাপ তা শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানানো।
হ্যাঁ, করোনা অতিমারীতে বরিস এবং তার দেশ যখন সত্যিই নাকানিচুবানি খাওয়ার দশায়, তখন নতুন করে সামনে এসেছে এই খবর। ব্রিটিশ পত্রিকাগুলোও আজ রবিবার সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে এইরকম মওকা বুঝে খবর ছাপাতে প্রথম পাতায় এনেছে। কাকতালীয় হলেও সত্যি, এর আগে করোনা মহামারির শুরুতে, তাও এক রবিবার ব্রিটেনের দুই সংবাদপত্র জানায়, ইংল্যন্ডে চলা লকডাউনের মধ্যেই দু’বছরের সঙ্গী ক্যারি সাইমন্ডসকে বিয়ে করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন!
ব্রিটেন থেকে চোখ ফেরাই বাংলাদেশে। বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১২ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের ঘটনাটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো। পদত্যাগের পরদিন কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর খবর ও পদত্যাগী মন্ত্রীর বিজ্ঞপ্তিতে ঠাসা ছিলো বাংলাদেশের সবগুলো প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা।
লেখা শেষ করার আগে আবার ফিরে যাই ব্রিটেনে। করোনা মহামারির শুরুতে, তাও এক রবিবার ব্রিটেনের দুই সংবাদপত্র জানায়, ইংল্যন্ডে চলা লকডাউনের মধ্যেই দু’বছরের সঙ্গী ক্যারি সাইমন্ডসকে বিয়ে করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন! সেই থেকে বরিসের ধীরে চলো নীতির কারণে অতিমারীতে চার লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় ব্রিটিশ সংবাদপত্র যেন চট্টগ্রামের ভাষায় খোঁচা মেরে বললো- ‘ওডা বরিস, করোনাত বেশি হাম ন গরিস’! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বছর দেড়েক আগে পার্লামেন্ট সাসপেন্ড করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘গণ-অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ব্রিটেনের বিরোধী নেতা তথা লেবার পার্টির প্রধান জেরেমি করবিন। চুক্তিহীন ব্রেক্সিট যাতে না হয়, তার বিরোধিতা করতেই এই পদক্ষেপ, জানিয়েছেন তিনি। পুরো করোনাকালে নানামুখি চাপে ছিলেন বরিস। ফলে বরিসের বিরুদ্ধে জ্বলতে থাকা উনুনে স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়ার খবর পরিবেশনায় মনে হলো, যেন গরম কড়াইতে তেল ঢেলে দিলো ব্রিটিশ সংবাদপত্র!
লেখক: রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]; এই নিবন্ধটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতার লে-আউট বিষয়ক একটি চলমান গবেষণা প্রকল্পের অংশ। তথ্য বিশ্লেষণে সহযোগিতা করেছেন চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ এহসান জাকারিয়া।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?