হাটে আসছে ক্লোন পশু!
হাটে আসছে ক্লোন পশু!
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশব্যাপি বসেছে কোরবানি পশুর হাট। করোনার কারণে এ বছর অনলাইনেও পশুর হাট বসেছে। চাকরির পেছনে না দৌঁড়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ অনেকে শিক্ষিত তরুণ গরুর খামার সফলভাবে গড়ে তোলায় দেশে গরু ছাগলের উৎপাদন বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে কোরবানির গরু না এলেও এখন সমস্যা হয় না।
গরুর দাম নিয়ে চিন্তা কিসের?
তবুও বেড়েই চলেছে গরুর দাম। গরুর মাংসের দাম। কেন? কেউ জানেনা। এবার বিজ্ঞানীরা গরুর মাংসের দাম কমার আশার কথা শোনালেন। অচিরেই হাটে আসছে ক্লোন গরু। দোকানে দোকানে মিলবে হালাল জবাইকৃত ক্লোন গরুর মাংস। চাই কী, কোরবানির হাটেও কেনাবেচা হবে ক্লোন গরু। চীনের কারখানায় তৈরি করা এসব গরু দামেও হবে অতিশয় সস্তা। গরুর দাম নিয়ে তাই আর কোন চিন্তা থাকবে না।
দুধের জন্য ক্লোন গরু
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘গরু ক্লোনিং এখন সহজ ব্যাপার।’ সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, উন্নত প্রজাতি সৃষ্টির জন্য খুব সহজেই গরু থেকে বাছুর ক্লোন করা সম্ভব। এভাবে গরু ক্লোনের মাধ্যমে জন্ম দিয়ে দৈনন্দিন প্রোটিনের বাড়তি চাহিদা পুরণ করা যায়। জাপানের বিজ্ঞানীরা প্রাপ্তবয়স্ক গরু থেকে সফলভাবে অবিকল আরেকটি গরু ক্লোন করেছেন। কিনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ইয়াকো ক্যাটো ও তাঁর সহকর্মীরা এই জয়ের গৌরব অর্জনে সক্ষম হন। বেশ ক’জন বিজ্ঞানী এই সাফল্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘ক্লোনিং কোন অপ্রত্যাশিত বিষয় নয়। খুব শিগগিরই ব্যাপক আকারে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষসহ সব গবাদী পশু ক্লোন হয়ে মাংস প্রোটিনের চাহিদা মেটাবে।’ জাপানে প্রথম ক্লোন করা গরুর বাছুরের জন্মের ঠিক কয়েক সপ্তাহ পর নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা একই ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের একটি বিশেষ গো চারণভূমিতে একপাল ক্লোন গরু চড়ে বেড়াচ্ছে। তবে সেখানে এসব গরু মাংসের জন্য নয়। শুধুমাত্র শিশুখাদ্য দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য ক্লোন করা হয়েছে।
মাংসের জন্য ক্লোন গরু
এতদিন বলা হতো, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি পণ্যের বাজার চীনের একচেটিয়া দখলে। এবার আধুনিক বায়োটেকনোলজিতেও চীন বিখ্যাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন বানিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে চীন সরকার মাংসের চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাপক আকারে কারখানায় ক্লোন গরু উৎপাদন করছে । মাংসের জন্য বছরে ১০ লাখ গরু এভাবে কারখানায় উৎপাদন করবে চীন। চীনের কৃষকরা অনেক কষ্টে গরুর মাংসের জন্য পশুর খামার করেছেন। তাতেও বাজারের চাহিদা পুরণ করা সম্ভব হয় না। চীন তাই বছরে লাখ লাখ ক্লোন গরু উৎপাদন করে চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মানুষের জন্য গরুর মাংসের চাহিদা পুরণ করবে।
চীনের গরু কারখানা
উত্তরপূর্ব চীনের সাগর উপকূলের শহর তিয়াংজিনে বিশ্বের বৃহৎ ক্লোন কারখানা স্থাপন করেছে চীন। ইতোমধ্যে এই গরু কারখানায় গরু উৎপাদন শুরু হয়েছে। গরু ছাড়াও এখানে পুলিশের জন্য বিশেষ দরকারি ঘোড়া, স্নাইপার কুকুর উৎপাদন করা হচ্ছে। ৩১ মিলিয়ন ডলার ব্যায়ে গরু মাংসের জন্য নির্মিত ক্লোন গরু উৎপাদনের একমাত্র কারখানা এটি। কারখানাটি তত্বাবধান করছে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে মলিকিউলার মেডিসিন ইনস্টিটিউট। গরু কারখানার সঙ্গে রয়েছে চীনের বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান বয়ালাইফ ও দক্ষিণ কোরিয়ার সোয়াম বায়োটেক। এখানে অসংখ্য ক্লোন গরু ও বাছুর চড়ে বেড়ায়। প্রতিষ্ঠান দু’টো ইতোপূর্বে মানবভ্রুণ ক্লোন করে সমালোচিত হয়। চীনের বায়োটেকনোলজি প্রতিষ্ঠান বয়ালাইফ গ্রুপের চেয়ারম্যান ঝু ঝিয়াওচুন বলেন, ‘বায়োটেকনোলজি বা ক্লোন প্রযুক্তি ইতোমধ্যে আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করিনা। যেমন- চীনের স্ট্রবেরি, ছোট কমলা, কলা, ইত্যাদি এই প্রযুক্তিতেই উৎপাদন হয়ে চীনের সুপার মার্কেটে বিক্রয় হয়। এরপর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যায়।’
অন্য দেশে গরু কারখানা
চীনের দেখাদেখি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক এক কোম্পানি এরই মধ্যে ক্লোন পদ্ধতিতে উন্নত জাতের গরু উৎপাদন করে ফেলেছে। গরুগুলোকে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করা হবে। কোম্পানিটি ব্রিটেনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে সংগ্রহ করা উন্নতজাতের গরুর জিন সংশোধন পদ্ধতিতে ক্লোন করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। এর ফলে গরুর নানাবিধ রোগ যেমন, মেডকাউ ডিজিজ, খুরা এবং মুখের ঘায়ের মতো রোগ প্রতিরোধী গরু জন্ম দেয়া সম্ভব হবে। ক্লোন গরু উৎপাদনের সর্মথকরা বলেন, ‘এর ফলে বহু বিলিয়ন ডলারের গরুর মাংস এবং দুধের বাজারে বিপ্লব ঘটে যাবে।’ বিজ্ঞানের কল্যাণকর নতুন এই পদ্ধতিকে মানুষের কল্যাণে কার্যকরভাবে কাজে লাগানোর জন্য এগিয়ে এসেছে ‘ক্লোন ইন্টারন্যাশনাল’ নামে অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি। বিজ্ঞানভিত্তিক বাণিজ্যিক এই প্রতিষ্ঠান অতি সম্প্রতি গরুর ক্লোনিং এর বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক লাইসেন্স সম্পূর্ণ কিনে নিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে পৃথিবীর প্রথম ক্লোন করা ভেড়ি ডলিকে যে প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর আলোতে এনেছিলো, তার কাছ থেকেই তারা লাইসেন্সটি কিনে নেয়। ক্লোন ইন্টারন্যাশনালের উৎপাদন তালিকায় প্রথমেই যে প্রাণীটি রয়েছে তা হলো গরু। ক্লোন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান, ‘রিচার্ড ফ্রাই’ জানান, ‘গরু ক্লোন করার পদ্ধতি একদম সহজ। আর ক্লোনিং প্রযুক্তির ব্যয় নাটকীয়ভাবে দিনে দিনে কমে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণা- আগামীতে ক্লোন করা গরুর এক বিশাল বাজার তৈরি হবে।’
দামে সস্তা ক্লোন গরু
ক্লোন গরুর জন্য ক্লোন ইন্টারন্যাশনাল নিউজিল্যান্ডের অ্যাগরিসার্চ এর সহযোগিতায় একাধিক প্রকল্প পরিচালনা করছে। প্রতিবছর অন্তত পাঁচটি উন্নতজাতের গরু উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। প্রাথমিকভাবে এগুলোকে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য কাজে লাগানো হবে। নিজ দেশে ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়ে তারপর রপ্তানি বাজারের দিকে নজর দেয়ার জন্য তারা আরো প্রায় পাঁচ বছর সময় অপেক্ষা করবে। এক্ষেত্রে চাহিদা বিশাল। শুধুমাত্র চীনে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রচুর গরুর দুধের প্রয়োজন। সেজন্যে তাদের দরকার হলস্টেইন জাতের দুধের গরু। এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতে উন্নতজাতের হলস্টেইন গরুর বাজার বেশ দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। রিচার্ড ফ্রাই বলেন, ‘উন্নততর গরু উৎপাদনে আমাদের ক্ষমতা বেড়ে যাবে। যা দেশে দেশে গরুর দুধ ও মাংসের বাজারকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করবে।’ তার মতে, ‘ক্লোন করা গরুর মূল্য হবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সস্তা।’ ক্লোন পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিশুদ্ধ উন্নত জাতের হলস্টেইন গরুর সর্বোচ্চ দাম হবে একশ’ চার ডলার মাত্র। বর্তমান বাজারে উন্নত এবং বিশুদ্ধ হলস্টেইন জাতের গরুর দাম আড়াই থেকে দশ লাখ ডলার। রিচার্ড ফ্রাইয়ের বিশ্বাস, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উপমহাদেশের দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের উদ্যোগে আকৃষ্ট হবে।
তবুও আশংকা
ক্লোন করা বিশুদ্ধ এবং উন্নত জাতের গরু উৎপাদনের এই গবেষণার সাফল্যে এক শ্রেনীর বিজ্ঞানী আশংকা প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি- ‘ক্লোন করলে একটি প্রাণীরই অনুলিপি তৈরি হয়। এতে অন্য কোনও প্রাণীর মিশ্রণ থাকে না। একাধিক প্রাণীর প্রাকৃতিক মিশ্রণের প্রাকৃতিক উপায়ে যখন প্রাণীর জন্ম হয় তখন তাতে জেনেটিক ডাইভার্সিটি ঘটে। এক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়।’ তাই গরু ক্লোন করার বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কাও করছেন অনেকে। জিন এথিক্স নামে এক সংগঠনের মুখপাত্র ‘বব ফেলপস’ বলেন, ‘জীব-বৈচিত্র্য বা ডাইভার্সিটি একটি গুরুতর প্রশ্ন। ক্লোনিং করা গরুর প্রচলন বেশি হলে কৃষিকে আরও শিল্পকরণের দিকে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টা জোরদার হবে। যা পরিবেশগত ভাবে মারাত্মক অশুভ কাজ। তাছাড়া দীর্ঘ সময়ের জন্য এই কাজ সমর্থনযোগ্য নয়।’ তবে এই ধরনের আশংকা ক্লোন বিশেষজ্ঞদের তেমন প্রভাবিত করেনি। তাদের কাজ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাঁধাও সৃষ্টি করেনি।
শেষ কথা
বিজ্ঞানীরা জানান, ‘ক্লোন করা গরুর মাংস খেয়ে দেখা যায়, এই মাংস যথেষ্ট উপাদেয় ও চমৎকার স্বাদের। ক্লোন করা গরুর মাংস বা দুধের স্বাদ আপনিও নিতে পারবেন।’ আর তাই, গরুর মাংসের ভবিষ্যত এখন চীনের হাতের মুঠোয়। গরুর মাংসের দাম বাড়াবাড়ি নিয়ে আর টেনশন নেই। নিত্য বাজারে পানির দামে কেনা যাবে গরুর মাংস। চাই কী, আগামী দিনে পশুর হাট পুরোটাই দখলে নেবে চীনা কারখানার তৈরি এসব ক্লোন গরু। ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্লোন গরুর মাংস খাওয়া নিয়ে নানান কথা উঠে আসছে। কোরবানিতে ক্লোন পশু কতটা বৈধ কতটা অবৈধ? আগামীতে হয়তো সে প্রশ্নও উঠবে। তবে ক্লোন পশুর মাংস মানুষ খাবে, নাকি খাবে না, সময়ই সেকথা বলে দেবে।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?