করোনার তাবিজ কবচ
করোনার তাবিজ কবচ
বেপরোয়া বাড়ছে করোনা। অতি উন্নত, উন্নত, মধ্যম, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশই করোনা মোকাবেলায় নাস্তানাবুদ। সভ্যতার ইতিহাসে খুব কম উদাহরণ রয়েছে যেখানে একটি রোগ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার মেয়াদ কতদিন, সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত নন। কোথায় গিয়ে থামবে, তা এখনও বলতে পারছেন না কেউ। বলবেন কিভাবে? করোনা এক অদৃশ্য শত্রু। একে মারার ওষুধ মানুষের অজানা। বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানী যেনো অন্ধকারে কালো বিড়াল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোনো পূর্বাভাস, কোনো বিশ্লেষণেই আশার বাণী নেই।
ভ্যাকসিন সোনার হরিণ
করোনাকে কেয়ার না করে আমাদের দেশে কিছুদিন আগে মাস্ক ছাড়া, সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঢিলেঢালা চলাফেরা করায় এখন ডেল্টা করোনার দাপাদাপিতে অস্থির গোটা দেশ। ভ্যাকসিন সোনার হরিণ। তার মধ্যেও শেখ হাসিনা সরকার ছয় মাস আগে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করে। ভ্যাকসিন সঙ্কটের কারণে সাময়িক ভ্যাকসিন কর্মসূচি ব্যাহত হলেও আবারও শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়া। তবে ভ্যাকসিন দিলেও যে করোনা হবে না, এমন নয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট করোনায় ভ্যাকসিনেও ভরসা নেই। তাই একে মোকাবিলা করার একমাত্র জানা পদ্ধতি হলো- লকডাউনে ঘরে থাকা। ব্যাপক আকারে করোনা টেস্ট করা। সামাজিক, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা।’
জীবাণুর খোঁজে চীন
করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনে। আর চীনই প্রথম করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনেছে। তখন ভ্যাকসিন বের হয়নি। চীন কি শুধু লকডাউন করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফল হয়েছে? জি না। জীবাণুর খোঁজে চীন সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে করোনা নির্মূল করে দ্রæত চমক সৃষ্টি করেছে। নাগরিকের আঙ্গুলের তাপমাত্রা কত? ত্বকের নিচে রক্তের চাপ কত? প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা হার্টবিট আর শরীরের তাপমাত্রা মনিটর করেছে। স্মার্টফোনের অ্যাপের মাধ্যমে সব মানুষকে খুব নিবিড়ভাবে মনিটর করেছে। ফেস-রিকগনাইজিং বা চেহারা চিনতে পারে এরকম লাখ লাখ ক্যামেরা দিয়ে চীনের স্বাস্থ্য দফতর সর্বক্ষণ নজর রেখেছে মানুষের ওপর। চীনের সবখানে ছড়িয়ে থাকা ব্লুটুথ, ওয়াইফাই সেন্সর আর শক্তিশালী অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজটা হয় খুব সহজে। সংগৃহীত ডাটা চলে যায় সরকারের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্যভান্ডারে। বিশ্লেষণ হয় বিশেষ অ্যালগরিদম দিয়ে। ব্যক্তি মানুষ নিজে জানার আগে সরকার জেনে যায় কে সংক্রমিত আর কে সংক্রমিত নয়। সরকার খুব দ্রুত শনাক্ত করতে পারে- কার সাহায্য প্রয়োজন, কে আক্রান্ত নয়। সেই বাহকের চলাফেরা ট্র্যাক থেকে শুরু করে কাদের সংস্পর্শে ভাইরাস বাহক ছিল তাও বের করে ফেলে অসম্ভব দ্রæতগতিতে। কে না জানে, ওহানে করোনার মত খতরনাক সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এভাবেই দমন করা খুব সহজ হয়।
স্মার্টফোনে করোনা টেস্ট
চীনের দেখাদেখি ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশের সরকার নানারকম ন্যানো সারভেইল্যান্স টুলস নামে ডিজিটাল তাবিজ-কবচ ব্যবহার করছে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানী করোনাভাইরাস সংক্রমণ সনাক্ত করতে তৈরি করেছে বিশ্বের সর্বসেরা ও কার্যকর স্মার্টফোন অ্যাপ। এছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস সনাক্তকরণে স্মার্ট রিং, ব্রেসলেট বাজারে এসে গেছে। যা হাতের কব্জিতে ব্যবহার করলেই চলে। এই গেজেট থার্মোমিটারের চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। এটি সার্বক্ষনিক সঠিকভাবে ফুসফুস ও হৃদপিন্ডের খোঁজ খবর জানাতে সক্ষম। করোনা সনাক্তের জন্য নাক থেকে সর্দি, শ্লেম্মা সংগ্রহ করার অস্বস্তি আর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ বিশ^বিদ্যালয়ের জৈব প্রকৌশলী মাসুদ তাবিব আজহার আবিষ্কার করেছেন এমন এক সহজ যন্ত্র, যেটি শরীরে লাগিয়ে আইফোন সেন্সর দিয়ে নিজেই নিজের স্মার্টফোনে মাত্র ৬০ সেকেন্ডে করোনা টেস্ট করা যায়। করোনা টেস্ট করে আপন মনে স্বেচ্ছায় কোয়ারান্টিনে যাওয়া যায়। যন্ত্রটি এখন সরকারী অনুদানে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে।
চামড়ার নীচে কবচ
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন সম্প্রতি করোনা রোধে বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ তৈরি করেছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. ম্যাট হেপবার্ন তৈরি করেছেন এই বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ‘ডিফেন্স অ্যাডভান্স রিসার্স প্রজেক্ট এজেন্সী’র (ডারপা) নামক সংস্থার এই বিজ্ঞানী জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। তার উদ্ভাবিত বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ চাউলের দানার মত। এই মাইক্রোচিপ জেলির মত নরম। এটি চামড়ার টিস্যুতে লাগিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। শরীরে প্রবেশ করালে করোনাভাইরাস সনাক্ত ও প্রতিরোধ করে। করোনা সংক্রমিত ব্যক্তি এটির সংস্পর্শে এলে শরীরে জীবাণুর কোন রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কীনা বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ যন্ত্রটি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ইঞ্জিন চেকের সংকেতের মতো জানান দেয়। এমন সংকেত দেয়া মানে হলো, আপনি করোনা সংক্রমিত হতে যাচ্ছেন। শুধু কি তাই? এই বায়োচিপে ব্যবহৃত ন্যানো মেশিন শরীরে বসে রক্ত পরিবহনের সময় রক্তে থাকা করোনার জীবাণু, যন্ত্রের মধ্যে থাকা ন্যানো ফিল্টারে তিন থেকে পাঁচ মিনিটে করোনার বিষক্রিয়া ধ্বংস করে দেয়। তারপর রক্ত পরিশুদ্ধ করে শরীরে আবার ফেরত পাঠায়।’ বিজ্ঞানী হেপবার্ন আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এই বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপে এছাড়া আর কোন গোপনীয়তা নেই। শুধুমাত্র করোনা সংক্রমন ঠেকাতে এটি তৈরি করা হয়েছে।’ উল্লেখ্য, এটি এমন এক সময়ে তৈরি করা হয়েছে যখন গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চলছে যে, মানুষের শরীরের মধ্যে মাইক্রোচিপ ঢোকানোর জন্য ভ্যাকসিন বানিয়েছেন বিলগেটস্।
হাতে হাতে ডিজিটাল কবচ
বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান ডেল্টা করোনা মহামারির সময়ে আবিষ্কৃত এসব বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ আসলে স্বল্প মেয়াদী ন্যানো যন্ত্র। অচিরেই এগুলোর আপডেট ভার্সন বেরুবে। আগামীতে এসবের ব্যবহার পাকাপাকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারন জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দেশে দেশে সরকারগুলোর জানা থাকা দরকার হবে নাগরিকের শারীরিক অবস্থার সম্পূর্ণ তথ্য। তাই সংক্রামক রোগ থেকে জনগণকে বাঁচাতে নিজ নিজ শরীরের তাপমাত্রা মাপা, পরীক্ষা করা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য সরকারকে বাধ্যতামূলক ডিজিটাল উপায়ে জানাতে হবে। গবেষকদের ধারণা, করোনা থেকে বাঁচতে নাগরিকের বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ প্রযুক্তির এমন ব্যবহার সমাজতান্ত্রিক দেশে কোনরূপ প্রশ্নবিদ্ধ না হলেও গণতান্ত্রিক দেশসমূহে গোপনীয়তা ক্ষুন্নে অভিযুক্ত হতে পারে। তবে দিন শেষে এই বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ বেশি উপকারী, সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী হিসেবে প্রমাণিত হবে। করোনা থেকে বাঁচতে যুগের বাস্তবতা হিসেবে আগামী দিনে সকলেই সাদরে লুফে নেবে।
করোনায় চীনের মত দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে, জীবাণু মোকাবিলায় নাগরিক সুরক্ষা দিতে, হয়তো বাংলাদেশেও আগামী দিনে ব্রেসলেট, আংটি, ঘড়ির মত হরদম ব্যবহৃত হতে দেখা যাবে বায়োমেট্রিক মাইক্রোচিপ নামের বিজ্ঞানসম্মত এসব ডিজিটাল তাবিজ-কবচ, মাদুলি বা মন্ত্রৌষধ!
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?