মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সেকেন্ড আসলে কি!

শেখ আনোয়ার

১১:৪৯, ১১ জুন ২০২১

আপডেট: ১১:৫০, ১১ জুন ২০২১

১৭৫৯

সেকেন্ড আসলে কি!

প্রয়াত জনপ্রিয় শিল্পী ফিরোজ সাঁই গেয়েছেন- এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইবে রঙ তামাশা, চক্ষু মুদিলে, হায়রে দম ফুরাইলে..। শিল্পকলা একাডেমীর এক অনুষ্ঠানে এই গান গাইতে গাইতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন শিল্পী ফিরোজ সাঁই। এ যেনো গানের বাণীকে সত্য প্রমাণ করেই আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিলো তাঁর। সত্যিই তাই! সেকেন্ডের ভগ্নাংশেই জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। এক সেকেণ্ডের ভুলে স্যাটেলাইটের তথ্য প্রেরণ ও সম্প্রচারে গোলমাল বেঁধে যেতে পারে। মহাবিস্ফোরণে বিশ্ব সৃষ্টির কালে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভগ্নাংশ সময়ও ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এক সেকেন্ডের কি? 
এক সেকেন্ড! সে আর এমন কী? জীবনের পরমায়ুতে এক সেকেণ্ড কিছুই না। এক বলতেই যে এক সেকেন্ডকে বোঝায়, সময়ের মাপে সে বড় তুচ্ছ নয়। এক সেকেন্ডে কতো কিছ্ইু তো ঘটে যেতে পারে। পরমশূণ্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় একটা সিজিয়াম-১৩৩ পরমাণুর ৯১৯,২৬,৩১,৭৭০ বার কম্পনে যতোটা সময় লাগে তাই হলো এক সেকেন্ড। এ হলো পদার্থবিদ্যায় সেকেণ্ডের হিসাবের সংজ্ঞা। এমন সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে সূ² পরিমাপের সুবিধার্থে। তবে দৈনন্দিন জীবনে এক সেকেন্ড সময়টা কতোটা? কাজের বেলায় এক সেকেন্ড তো দূরে থাক। এক মিনিটও ঠিক মতো ঠাহর করা কঠিন। অন্তত ১৫-১৬ মিনিট পার হবার পর ঠিকঠাক মতো বোঝা যায়। এ সময়ে প্রায় এক হাজার সেকেন্ড পার হয়ে যায় (১০০০সে. = ১৬মি. ৪০সে.)। সুতরাং এক সেকেন্ড আসলে খুবই অল্প খানিকটা সময়। হিসাব করলে দেখা যায় পুরো একটা দিনে, এক বছরে এমনকি মানুষের পুরো জীবনকালেও এক সেকেন্ড খুব একটা বেশি সময় নয়। এতো ক্ষুদ্র সেকেন্ডেরে মাত্র ছিয়াশি হাজারের কিছু বেশি যোগ করলেই সারাদিন পার হয়ে যায়। আবার গড়পড়তা মানুষের সারা জীবন মিলিয়ে আড়াই’শ কোটি সেকেন্ডও হয় না। 

এক সেকেন্ডে কি হয়?
প্রকৃতপক্ষে, কম্পিউটার নেটওয়ার্কিংয়ের জটিল সময় হিসাবের বেড়াজালে না আটকালে হয়তো সত্যিই এই এক সেকেন্ডের কোনো বিশেষ তাৎপর্য থাকতো না। তবে এক সেকেন্ডে কত কিছু হয় তার ইয়ত্তা নেই। খুবই অল্প সময় হলেও এর দশভাগের এক ভাগের মধ্যেই চোখের পাতা ফেলা যায়। এক একটা হার্টবিট সম্পন্ন হয় পুরো সেকেন্ড পেরোবার আগেই। আবার অন্যদিকে সারা জীবন মিলিয়েও সেকেন্ডের সংখ্যা খুব একটা বেশি হয়ে ওঠে না। সেকেন্ড এতো ক্ষুদ্র হলে কি হবে। আমাদের মস্তিস্কের সংবেদনশীলতার মাত্রা আরও সূ²। মস্তিষ্ক প্রায় সেকেন্ডের ১/১০ অংশ পর্যন্ত কোন কিছু ঠাহর করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘দু’টো ছবির মাঝে সময়ের ব্যবধান ০.১ সেকেন্ড বা তার বেশি হলে ছবি দু’টোকে আলাদা ছবি হিসেবে আমরা বুঝতে পারি। আর তা না হলে দু’টোকে একই ছবি মনে হয়।’ এই মূলনীতি অনুসরণ করেই ভিডিও চিত্র বানানো হয়। এজন্যে ভিডিওতে ফ্রেমরেট বলে একটা কথা রয়েছে। ফ্রেমরেট ৩০ মানে ক্যামেরাটা আসলে ৩০ টা আলাদা ছবি প্রতি সেকেণ্ডে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটা ছবির মাঝে সময়ের ব্যাবধান ০.১ সেকেন্ড থেকে কম (০.০৩৩ সে.) হওয়ায় সব মিলিয়ে একটা চলমান চিত্র মনে হয় আমাদের কাছে। একই কথা খাটে কতোটা দ্রুত আমরা শুনতে পারি তার ক্ষেত্রেও। ধরা যাক, একে- ৪৭ বন্দুক পুরো অটোমেটিক অবস্থায় সেকেন্ডে ১০টা গুলি ছুঁড়তে পারে। তাই একে- ৪৭ এর শব্দ শুনে আপনি আলাদাভাবে প্রতিটা গুলির শব্দ বুঝতে পারবেন। কিন্তু এর চেয়ে দ্রুত গুলি করা যায় জিএইউ-৮ অ্যাভেঞ্জার নামে আধুনিক বন্দুক দিয়ে। এই বন্দুকের গুলির শব্দ শুনলে মনে হবে করাতের শব্দ হচ্ছে। আবার ধরা যাক, কোন গাড়ির চালক যদি হঠাৎ গাড়ির সামনে কোন কিছু দেখতে পান তাহলে ব্যপারটা দেখে ব্রেক কষতে তার ০.২ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে। তাই গাড়ির গতি বেশি হলে ব্রেকের আগেই সামনের জিনিসটায় গিয়ে ধাক্কা দেয়। তখন অ্যাক্সিডেন্ট এড়ানোর কোন উপায় থাকে না। এজন্যেই বেশি জোরে গাড়ি চালালে এক সেকেন্ডের ভুলে অ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এক সেকেন্ডের বাড়তি কথা
বিজ্ঞান বলছে, ‘পৃথিবী-চাঁদ আর সূর্যের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের দড়ি টানাটানি অবস্থার মধ্যেও পৃথিবী নিজের অক্ষের চারপাশে ঘুরতে সময় লাগে ২৪ ঘণ্টা বা ৮৬৪০০ সেকেন্ড।’ কিন্তু বর্তমানে ৮৬৪০০ সেকেন্ডের পরিবর্তে নিজের অক্ষ পরিক্রমণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৮৬৪০০.০০২ সেকেন্ড। আর এই অতিরিক্ত দু’মিলি সেকেন্ড বা এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের দুই ভাগকে হিসাবে মিলাতেই হয়। সময়ের এই গোলমাল নতুন নয়। গোলমাল নিরসন করতে দেখা দেয় লিপ সেকেন্ডের বিষয়। লিপইয়ারের মতোই এর নাম লিপ সেকেন্ড। তাই কোনো কোনো বছরে যোগ করা হয় এক লিপ সেকেন্ড। 

এক সেকেন্ড সময় যোগ
এক্ষেত্রে ওই পার্থক্য পূরণের জন্য ১১:৫৯:৬০ এর বদলে ১১:৫৯:৫৯ করে দেওয়া হয়। সেকেন্ডের এই সময়ের যোগ দেড় বছর অন্তর-অন্তরই করা হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে পরমাণু ঘড়ির সাহায্যে সময়ের হিসাব নিখুঁত রাখতে ব্যবহার করা হয় প্রায় ২৭০টি পরমাণু ঘড়ি। বিশ্ব জুড়ে ইন্টারনেট এবং ওয়েবভিত্তিক কার্যক্রম চলে এই সময় অনুযায়ীই। এই লিপ সেকেন্ডের সময়টা পার হলে সেন্ট্রাল সার্ভার নতুন করে সিনক্রোনাইজ করা হয়। গুগল এই অতিরিক্ত সময়টুকু অদৃশ্য করে দিতে বাধ্য হয়। সার্ভারের ঘড়ি সামান্য পিছিয়ে দেওয়া হয়।  

এক সেকেন্ডের গোলমাল 
এই লিপ সেকেন্ডের হিসাবটা বাদ দিলে আমরা সবাই একদিন ঝামেলায় পড়ে যাবো। ইন্টারনেট সংযোগ এবং ওয়েবভিত্তিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই। সময় মেলানো নিয়ে ঝামেলায় পড়বেন প্রফেশনাল চাকুরীজীবী থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরাও। আমাদের চোখে দেখা ঘড়ির কাটা ধরে কাজ-কর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সূর্যের উদয়াস্তের সময় এমন ভাবে বদলে যাবে যে, ঘড়ির সময় অনুযায়ী যখন দুপুর বেলা তখন একেবারে ঘুঁটঘুটে অন্ধকার। 

এক সেকেন্ডের ভরসা নাই 
সেকেন্ডের সঙ্গে সমুদ্র জাহাজ চলাচলেরও একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আকাশে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে অনেক সময়ই জাহাজের ক্যাপ্টেন সমুদ্রে কোন অঞ্চলে রয়েছেন তা বুঝে নিতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির সময়টাও দেখে নিতে হয়। কিন্তু যদি তার ঘড়ি এক সেকেণ্ডের হেরফের থাকে তাহলে সমুদ্রে অবস্থান নির্ণয়ে প্রায় এক মাইলের তফাৎ ঘটে যায়। তাই ঘড়ির কাঁটার সময়ের হিসাবে কয়েক সেকেণ্ডের গোলমাল হলে ক্যাপ্টেন পথ হারাতে পারেন। মহাকাশের স্যাটেলাইটের তথ্য প্রেরণ ও সম্প্রচারে গোলমাল বেঁধে যেতে পারে। এক সেকেন্ডের ভরসা নাই। তবে কি নিয়ে এতো বড়াই?

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank