অবাক করা গাছের কথা
অবাক করা গাছের কথা
করোনাকালে নিঃশ্বাসের বড় আকাল। মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে অক্সিজেনের অভাব কি জিনিস! নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় আমরা যে অক্সিজেন পাই তা গাছপালা বা অরণ্যের অবদান। আবার প্রশ্বাসের সঙ্গে যে কার্বন ডাই অক্সাইডের বিষবাস্প বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেই, পরম বন্ধুর মতো তা গ্রহণ করে পরিবেশকে নির্মল করে গাছ। গাছ এভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন শোষণ করে তা মজুদ রাখাসহ বাস্তুতান্ত্রিক অনেক সেবা দান করে আসছে।
তাই বলা হয়, গাছপালার মতো বন্ধু মানুষের দ্বিতীয়টি নেই। এ বছর ২০২১ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিপাদ্য বিষয় ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন বা বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার। সহজ মানে- জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ। গাছপালার বাস্তুতান্ত্রিক সেবা কম মূল্যবান নয়। সম্প্রতি গাছ সম্পর্কে চমকপ্রদ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা তথ্য উপস্থাপন করেছেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী। তারা জানান, ‘গাছপালা আমাদের রোগ ব্যাধির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করে।’ বিজ্ঞানীরা নিউইয়র্ক শহরের ওপর সমীক্ষা করে জানান, ‘গাছপালা শোভিত রাস্তার পাশে শহরের জীবনে অভ্যস্তদের হাঁপানী ও শ্বাসকষ্ট আক্রান্ত হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় কম।’
অভিনেতা আবুল খায়েরের একটা বিজ্ঞাপনের কথা হয়তো অনেকেরই মনে রয়েছে। এক সময় বিটিভিতে প্রচারিত হতো। অতি-জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনটা এরকম! -সব গাছ কাইটা ফালাইতাসে। আমি ওষুধ বানামু কি দিয়া? : কি গো কবিরাজ, কি খোঁজতাছেন? -আইচ্চা, এইখানে একটা অর্জুন গাছ আছিলো না? : আছিলো, কাইট্টা ফালাইছি। -এইখানে একটা শিশু গাছ আর ঐ মাথায় একটা হরতকী গাছ? : আছিলো, কাইট্টা ফালাইছি। -আপনের গাছ? : হ। টেকার দরকার পড়ছে তাই বিক্রি করছি। -গাছ লাগাইছিলো কে? : আমার বাবায়। -আপনি কী লাগাইছেন? : আমি কী লাগাইছি? -হ, ভবিষ্যতে আপনার পোলারও টেকার দরকার হইতে পারে..। আবুল খায়েরের শেষ কথাটা ছিলো: ‘এক-একটা গাছ, এক-একটা অক্সিজেনের ফ্যাক্টরী।’ জী হ্যাঁ, প্রাকৃতিক অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি হচ্ছে এই গাছ।
সারাবিশ্বে কত যে গাছপালা রয়েছে তার হিসাব নেই। লতা, গুল্ম ওষুধী গাছ থেকে শুরু করে বিরাট বিরাট বনষ্পতি। পৃথিবীর জন্মের প্রায় দেড়’শ কোটি বছর পর প্রথম জন্মলাভ করে গাছ। সেই থেকে আজ অবধি চার লাখের মতো প্রজাতি গাছের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা। যদিও এর সংখ্যা চার’শ কোটির সীমাও ছাড়িয়ে যাবে। তবে এই চার লাখ গাছের মধ্যে কত অদ্ভূত ব্যাপার রয়েছে। নানান গাছের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রীতিমতো অবাক করে দেয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘকায় গাছ হচ্ছে উত্তর আমেরিকার জায়ান্ট রেড উড। লম্বায় প্রায় পৌনে চার’শ থেকে চার’শ ফুট পর্যন্ত হয় এগুলো। এই গাছের বেড়ও কম নয়। এক’শ থেকে এক’শ বিশ ফুটের মতো হয়। তিন হাজার থেকে সাত হাজার বছর পর্যন্ত জায়ান্ট রেড উড বেঁচে থাকতে পারে। পৃথিবীর মাত্র তিন চারটি স্থানে এরা টিকে রয়েছে। উত্তর আমেরিকায় আরও এক ধরনের গাছ রয়েছে। এ গাছের পাতাগুলো বরাবরই উত্তর দক্ষিণ দিকে মুখ করে থাকে কাঁটা কম্পাসের মতো। এজন্য এদের কম্পাস গাছ বলে। বৈজ্ঞিানিক নাম সিলফিয়াম ল্যাসিনিয়েটম। তবে স্থানীয়ভাবে লোকগাঁথা রয়েছে, সৃষ্টিকর্তা নাকি নিজের হাতে এই গাছ লাগিয়েছেন। মাদাগাস্কারে ট্রাভেলার্স ট্রি নামে এক প্রকার গাছ রয়েছে। তালগাছের মতো লম্বা লম্বা। এই গাছের পাতাগুলো দেখতে কলাপাতার মতো। এই গাছের পাতার বোটার গোড়া দেখতে একটা বড় সড় চামচের মতো। যেখানে পানি রাখা যায়। প্রায় এক লিটার পানি ধরে। বৃষ্টির পর পাতার বোটার গোড়ায় জমা বৃষ্টির পানি পশুপাখি এমনকি পথিকদের তৃষ্ণা মেটায়। পেরুতে রেইনট্রি গাছ প্রখর রোদের তাপে যখন চারিদিকে খাঁ খাঁ করে তখনই গাছ বাতাস থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে। শেষে এই জলীয় বাষ্প থেকে ঝরঝর করে বৃষ্টির মতো পানি ঝরতে থাকে। সময়ে সময়ে এই গাছের ডালপালা এবং পাতা বেয়ে ঝরে পড়া পানির পরিমাণ এতো বেশি হয় যে, গাছের নিচে যেনো ছোটখাটো একটা জলাশয় হয়ে যায়। মাংকিব্রেড বা বানর রুটি হচ্ছে আফ্রিকার একটা গাছ। এই গাছের ফল দেখতে অনেকটা লাউ কুমড়োর মতো। বানরের প্রিয় খাদ্য বলে আফ্র্রিকার জঙ্গলে এর নাম হয়েছে বানর রুটি গাছ।
অস্ট্রেলিয়ায় কান্ট্রি ট্রি নামে এক প্রকার চারাগাছ রয়েছে। যে গাছ সব সময় পোকা-মাকড়ে ঢাকা থাকে। পোকার কামড়ে গাছ থেকে এক প্রকার লাল রঙের তরল বের হয় টুপটুপ করে। যা চিনির মতো মিষ্টি স্বাদযুক্ত ও ঘন পদার্থ। সেটা খাবার হিসেবে ব্যবহার করে স্থানীয় অধিবাসীরা। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত গাছ হচ্ছে স্টেলারিয়া ডেকামরেন্স। এটা হিমালয় পাহাড়ের সর্বোাচ্চ চূড়া এভারেস্টে জন্মে। জেনারেল শেরম্যান নামের গাছটা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ওজনের গাছ। দু’হাজার টনের কাছাকছি। পাহাড়ের মতো এই গাছ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন আমেরিকার ক্যলিফোর্নিয়া অঞ্চলে। অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় আরেক অদ্ভূত গাছ। এই গাছের পাতাগুলো অবিকল চুলের মতো। তাই এই গাছের স্থানীয় নাম চুলগাছ। এছাড়াও পূর্বাঞ্চলে পাওয়া যায় বারবার প্লান্ট বা নাপিত গাছ। এর পাতা মুখমন্ডলে ঘষলে নাকি দাঁড়ি বাড়ে না। ফ্রান্সের রয়েছে আরেক ধরনের গাছ। যার নাম সেলফ হিল বা স্বেচ্ছা নিরাময়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা- এই গাছ ক্ষতস্থানে ছোঁয়ালে ক্ষতস্থান সেড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর জন্মে লাইকেন নামক গাছ। এটি সবচেয়ে কম বাড়ে। পঞ্চাশ বছরে মাত্র এক হাত। অবশ্য এসব গাছের আয়ু প্রায় দু’শ বছর। গাছের আরও কত যে বিচিত্র সংবাদ রয়েছে যার কোন শেষ নেই।
সবুজ-শ্যামল আমাদের সোনার বাংলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। সবুজায়নের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার মানব সভ্যতার টেকসই উন্নয়নে জোর দিয়েছে। পরিবেশ সুশাসনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গত ৫ জুন ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১’ উদ্বোধনের সময় সরকারি বাসভবন, গণভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমি নিজে বৃক্ষরোপণ করলাম। সেই সঙ্গে আমি দেশবাসীকে আহŸান জানাব, যার যেখানে যতটুকু জায়গা আছে গাছ লাগান। তিনটা করে গাছ লাগাতে পারলে সব থেকে ভালো হয়। আর সেটা যদি না পারেন একটা করে হলেও লাগাবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই যে একটা ফলজ, একটা বনজ, একটা ভেষজ এ ধরনের গাছ লাগাবেন। পরিবেশ রক্ষায়, নিজের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগী সেটা হলো ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা।’ সরকার প্রধান বলেন, ‘আপনারা সবাই গাছ লাগাবেন এবং গাছের যতœ নেবেন। শুধু গাছ লাগালে হবে না, গাছ যাতে টিকে থাকে সেজন্য যতœ নিতে হবে। এ গাছ ফল দেবে, কাঠ দেবে অথবা ওষুধ দেবে; নানাভাবে উপকৃত হবেন।’ রাষ্ট্রনায়কের এমন আহবান বৃক্ষরোপণে বাংলার মানুষকে সত্যিই অনুপ্রেরণা জোগায়। তাই তো, পৃথিবীকে সুন্দর করতে হলে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়মুক্ত হতে চাইলে অবশ্যই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গাছ লাগাতে হবে।
ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞান বইতে পড়ে আসছি গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়। কিন্তু তা শুধুই বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেলো! নিজেদের জীবনে আমরা তার কোন প্রয়োগ করলাম না। আমাদেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। এই বিশ্বকে সবুজায়নের মাধ্যমে বাসযোগ্য করে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব। এখন চলছে বর্ষাকাল। এই বর্ষা হচ্ছে গাছ লাগানোর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময় গাছ লাগালে খুব বেশি পরিচর্যা করা লাগে না। প্রকৃতিই সকাল-বিকাল বৃষ্টি ঝরিয়ে গাছের পরিচর্যা করে। তাই আসুন। আমরা সবাই এদেশকে, এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে জীবন রক্ষাকারী পরম বন্ধু গাছ লাগাই।
শেখ আনোয়ার: লেখক, গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?