ব্লাড প্রেসারের ওষুধি গাছ
ব্লাড প্রেসারের ওষুধি গাছ
বিশ্বজুড়ে ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্লাড প্রেসারে ভুগে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, ব্লাড প্রেসারে ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর সারা বিশ্বে প্রতিবছর ব্লাড প্রেসারে মারা যায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। সংখ্যাটা মহামারী করোনাভাইরাসের চেয়ে কম নয়।
ব্লাড প্রেসার কি?
হৃৎপিণ্ড যেহেতু সারা শরীরেই রক্ত পৌঁছে দেয় তাই সে একইসঙ্গে অক্সিজেন এবং শক্তিরও যোগান দেয়। আমাদের শরীরে রক্ত প্রবাহের দেওয়ালে যে চাপ রক্ত ঠেলে দেয়, তাকেই বলে ব্লাড প্রেসার। হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে হাই ব্লাড প্রেশার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ বা এর আশেপাশে থাকে, তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসেবে ধরা হয়। কারও ব্লাড প্রেশার রিডিং যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। যদিও বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ খানিকটা বেশি বা কম হতে পারে। শরীর বিজ্ঞানীদের মতে, ব্লাড প্রেসারের উৎস হাইলিপিড কনটেন্ট বা হাইপারলিপিডিমিয়া। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি জীবনের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন, কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা, মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণও হয়ে অনেক সময় মৃত্যু ঘটে।’
ব্লাড প্রেসার থেকে বাঁচায় গাছ
ব্লাড প্রেসার থেকে মুক্তি পেতে রয়েছে প্রকৃতির দান গাছ। গাছের পাতা, শিকড়, বাকড় চিবিয়ে খেলে ব্লাড প্রেসার কমে যায়। জঙ্গলে অযতœ অবহেলায় বাড়ে গাছটি। এই গাছের শিকড়ে রয়েছে রাশি রাশি সোনা, ডলার আর টাকা। পাশ্চাত্যে এই গাছের ব্যাপক চাষাবাদ হয়। এর শিকড়ের নির্যাস ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। ধান চাষ না করেও ভিয়েতনাম এই গাছের চাষ করে এখন আয় করছে কোটি কোটি ডলার।
গাছ থাকলে সাপ আসে না
বিখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী রাউলকিয়া প্রথম এই গাছের ওষুধি গুণ আবিষ্কার করেন। তাই তার নামের সঙ্গে মিল রেখে এই গাছের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে ‘রাউলকিয়া সার্পেনটিনা।’ বাংলাদেশে এই গাছের পরিচিত নাম চন্দ্রা। শ্রীলংকায় বলে চাভান্দা, গুজরাটে বলে হারকোইয়া আর সংস্কৃতি ভাষায় এর নাম সর্পগন্ধা চন্দ্রিকা। এছাড়াও আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে- সুগন্ধা, রক্তপত্রিকা, ঈশ্বরী, অহিভুক, সর্পদনী নামেও ডাকা হয়। সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ চরকা সংহতিতে এই গাছের নানান গুণের কথা বলা হয়েছে। আদিকাল থেকে এই গাছ উন্মত্ততার মহৌষধ হিসেবে এতোটাই সমাদৃত যে প্রতিবেশি দেশ ভারতের উত্তর প্রদেশে এই গাছের নাম হয়ে গেছে- ‘পাগল কি দাওয়াই’ মানে পাগলের ওষুধ। লোককাহিনী রয়েছে, যে বাড়িতে এই গাছ থাকে সে বাড়িতে সাপ আসে না। প্রাচীন কাল থেকে সর্পদংশন, কীটপতঙ্গের হুল ফোটানো, জ্বালা পোড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই গাছ। কথিত রয়েছে বেজি সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করার আগে এই গাছের মূল ও পাতা চিবিয়ে খায়, যাতে বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আদীম কালে মানুষ সর্পসংকুল বনে জঙ্গলে চলার সময় পায়ের পাতা ও আংগুলে এই গাছের শিকড় ও পাতার নির্যাসের প্রলেপ নিতো। যাতে ক্ষতিকারক প্রাণী ও কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মালয়েশিয়ার পাম বাগানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় এখনো এই গাছের শিকড় ব্যবহার করে আদী লোকজন। এখনো বাংলাদেশের গ্রামের বউ-ঝিরা দুস্ট, দস্যি শিশুকে ঘুম পাড়ানোর জন্য দুধের সঙ্গে অল্প পরিমাণ এই গাছের পাতার রস খাইয়ে দেয়। এতে গা ঠান্ডা থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে শিশু।
কি আছে এই টেনশনখেকো গাছে?
গাছটির এতো গুণের কারণ কি? এর বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ উদ্ঘাটিত হয়েছে। গবেষকরা বলেন, ‘এই গাছের শিকড় ও পাতা খেলে তন্দ্রাভাব আসে। তাই রক্তচাপ ও টেনশন কমে যায়।’ গবেষণায় দেখা যায়, এই গাছের শিকড়ের নির্যাসে রয়েছে রিসারপিন নামে ২০ ধরনের অ্যালকালয়েড বা প্রচুর ক্ষারজাতীয় উপাদান। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রিসারপিন ব্যবহার করা হয়। রিসারপিন পানিতে অদ্রবণীয় কিন্তু ক্লোরোফর্ম, ক্লোরাইড গালিকেল এসিটিক এসিড মিথাইল, বেনজিনে দ্রবণীয়। রিসারপিনের গলনাঙ্ক ২৬৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রিসারপিন হালকা হলুদ বর্ণের গন্ধহীন ক্রিস্টালাইন পাউডার। রিসারপিনের রাসায়নিক নাম মিথাইল ১৮বি-হাইড্রোকি-১১, ১৭ আলফা-ডাইমিথোক্সি ৩বি। রিসারপিন ভাসকুলার মনোঅ্যামিন ট্রান্সপোটারের কার্যকারিতা বন্ধ করে দেয়। এটা ব্রেইনে নোরইপিনিফিরিন, সেরোটনিন ও ডোপামিন সরবরাহ ঠিক রাখে এবং পরবর্তী সময়ে সিনাপটিক ক্লাসমুক্ত করে। স্নায়ুকোষ সাইট্রোপ্লাজম ও প্রোস্ট সাইনাপ্টিক সেলে মেটাবোলাইজড হয়। এতে রক্তবহনকারী সূ² শিরাগুলোয় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে। আর এতেই হাই বøাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে এই গাছ।
কি কি ওষুধ বানানো হয়?
গবেষকরা জানান, যে কোনো বিষাক্ত পদার্থ কিংবা যে কোনো ধরনের বিষক্রিয়া থেকে রক্ষায় এই গাছের নির্যাসের জুড়ি মেলা ভার। গাছের নির্যাসের অ্যালকালয়েডস কাজ করে অ্যান্টিডোট হিসেবে। এই গাছে স্টেরল, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, অলিক এসিড, ফিউমারিক এসিড, গুকোজ, রেজিন, খনিজ লবণ, স্টার্চ ইত্যাদি রয়েছে। সাধারণ জ্বর এবং পেটের গোলমালেও উপকারী। বাতজ্বর এবং ব্যথা বেদনায় সেরা ফলপ্রদ ওষুধ এটি। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার চর্মরোগ নিরাময়েও এর কার্যকর। বার্ধক্যজনিত রোগও এটি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি আধুনিক কালের সিজোফ্রেনিয়া নামের রোগের ক্ষেত্রেও এটি যথাযথ কার্যকরী।
কিভাবে ওষুধ বানানো হয়?
চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী গাছের শিকড়, কান্ড, পাতা সংগ্রহ করে ওষুধ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। শিকড়-বাকড়সহ গাছ কেটে কড়া রোদে শুকানোর পর গুঁড়ো করে পাউডার বানানো হয়। প্রতিকেজি পাউডারের দাম বিদেশে ২০০ ডলার। যা বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৬ হাজার টাকা। পাউডারগুলো কিনে নেয় ওষুধ প্রস্তকারক প্রতিষ্ঠান বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। এক একর জমি থেকে আট কুইন্টাল পরিমাণ পাউডার ওষুধ পাওয়া যায়। এ কারণেই বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে এই গাছ।
কোথায় পাওয়া যায় এই গাছ?
বন জঙ্গলে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠে চিরহরিৎ গুন্ম জাতীয় এই গাছ। এশিয়া উপমহাদেশে বাংলাদেশ, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সমতল ভূমির জঙ্গল এবং পার্বত্য অববাহিকায় এমনিতেই আগাছা হিসেবে প্রচুর পরিমাণে জন্মে এই গাছ। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ক্ষেতের বেড়া হিসেবে অযত্নে বেড়ে উঠে এই গাছ। তবে বাংলাদেশের সব জায়গায় দেখা যায় না। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্যাপক পরিমানে গাছটি চোখে পড়ে। এছাড়াও দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায়।
গাছটি দেখতে কেমন?
এটি চিরহরিৎ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। সাধারণত বীজ থেকেই গাছ জন্মায়। কান্ড কেটে ফেলে রাখলেও আখের মতো এই গাছ জন্মায়। আমাদের দেশের আখ গাছের মতো প্রচন্ড রোদে সোজা খাড়াভাবে বেড়ে ওঠে এই গাছ। লম্বায় ত্রিশ থেকে নব্বই সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। বিশেষ শাখা-প্রশাখা হয় না। পাতাগুলো দেখতে অনেকটা আমগাছের পাতার মতো। পাতার ডগা সরু। মাঝখানে নৌকার মতো ঢেউ খেলানো থাকে। পাতাগুলো লম্বায় সাত দশমিক পাঁচ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। মালতী ফুল গাছের মতো পাতাগুলো কান্ডের চারিদিকে গজায়। গাছ বড় হলে থোকায় থোকায় ফুল ধরে। কান্ডশীর্ষে পুষ্পদন্ডে হাল্কা গন্ধময়, হালকা গোলাপি রং এর গুচ্ছাকারে ফুল ফোঁটে। তখন দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। মনে হয় এগুলো শুধ্ইু ফুল গাছ। ফুলের নাম নাকফুলি আবার কেউ কেউ বলে ছোটচাঁদ। গ্রীষ্মকাল ফুল ফোঁটার প্রধাণ মৌসুম। ছোট ছোট এই ফুলের ওপরের অংশ সাদা। বর্ষার শেষ দিকে ফুল থেকে ডিম্বাকৃতির ছোট ছোট ফল হয়। কাঁচা ফলের রং সবুজ। পাকলে কালো জামের মতো বেগুনী, গাঢ় খয়েরি, কালো রঙের হয়ে যায়। ফলের মধ্যে জোড়ায় জোড়ায় বিচি থাকে। এর শিকড় দেখতে মোটা। যার ব্যাস ২-৪ সে.মি. পর্যন্ত হয়। তবে ভঙ্গুর এবং রং ধূসর ও পীত বর্ণেও হয়। ফল ও কাঁচা শিকড়ের গন্ধ কাঁচা তেঁতুলের মতো।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভুমির উর্বরতা এই ওষুধি গাছ চাষের উপযোগী হলেও এ বিষয়ে দেশের মানুষের তেমন সচেতনতা লক্ষ্য করা যায় না।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- বিড়াল ভয়ংকর!
- আপনি কি একজন এমবিভার্ট?
- মাটি খাওয়া মানুষ
- বিষাক্ত পাতাবাহার গাছ
- বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি
- নাগলিঙ্গম ফুলের সৌরভে...
- বিশ্বব্যাপী গাছে গাছে জুতা ঝুলানো হয় কেন?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিকদের শেষ চিহ্ন [ভিডিও স্টোরি]
- টাইটানিক ডোবার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী!
- পটকা মাছ কেন বিষাক্ত?