রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ব্রেইনের সংকেতে কি যন্ত্রপাতি চলবে?

শেখ আনোয়ার

১২:২১, ৬ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১২:২৩, ৬ নভেম্বর ২০২০

৩৭০

ব্রেইনের সংকেতে কি যন্ত্রপাতি চলবে?

নির্বোধ কম্পিউটারকে আমরা যতো গালিই দেই না কেন একথা কিন্তু সত্যি, কম্পিউটারের ‘মেমোরি’ নিখুঁত। আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতি সে তুলনায় ততটাই ভঙ্গুর। যেমন ধরা যাক, আমরা অনেকেই অফিস যাবার সময় গাড়ির চাবি খুঁজে পাইনা। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ খুঁজে পাইনা। চশমাটাও হারিয়ে ফেলি প্রায়শই। কাজের সময় বন্ধুর ফোন নম্বর মনে করতে পারিনা। প্রিয়জনের জন্মদিন বেমালুম ভুলে বসে থাকি। 
নিউজউইকে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, মানুষ দিনে গড়পরতা প্রায় ৫৫ মিনিট সময় ব্যয় করে জানা জিনিস খুঁজে পেতে। আরেক গবেষণায় প্রকাশ, শতকরা ৬ ভাগ ক্ষেত্রে স্কাইডাইভারেরা মৃত্যুবরণ করে প্যারাসুটের রিপকর্ড খুলতে ভুলে গিয়ে।

তো, ভুলে যাওয়া বিষয় মনে করিয়ে দিতেই মানুষ আজ ডিজিটাল সেবার আশ্রয় নিচ্ছে। ডিজিটাল হচ্ছে মানুষ। তাই পিসি, স্মার্ট অ্যান্ড্রয়েড গেজেটের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে গেছে ফোর’জি প্রজন্মের মানুষ। ফোর’জির কারণে আজকাল বিনা তারের অ্যান্ড্রয়েড গেজেট, ওয়াইফাই, জিপিআরএস, নেভিগেশন, ব্লুটুথ ইত্যাদি প্রযুক্তির সাহায্যে হাজার ক্রোশ দুরের মানুষের সঙ্গে সরাসরি লাইভে কথা বলছে। এজন্যে রয়েছে বিনে পয়সার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানান ডিজিটাল মাধ্যম। মানুষ আজ স্মার্টফোন, অ্যান্ড্রয়েড গ্যাজেট, পিসিতে যাবতীয় দরকারি কাজ সারছে। দূরে বসে, ঘরে বসেই অ্যান্ডয়েড টিভিতে হলিউডের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র দেখার সুবিধা পাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এসবের জন্য এখনো মুখ বা হাতের দরকার হয়। নির্দেশ দিতে হয়। বোতাম চাপতে হয়। 
কিন্তু এমন যদি হতো। আমরা শুধু আমাদের ব্রেইন থেকেই সরাসরি স্মার্ট গেজেট, পিসি, রোবোট বা অন্যান্য মেশিনকে কমান্ড করতে বা নির্দেশ দিতে পারছি! অর্থাৎ মস্তিষ্কই যদি রিমোট কন্ট্রোল হয়!! তাহলে ভারী মজা হয়, আরও স্মার্ট হয় মানব জীবন। তাই না?
ঠিক তাই।

এটা আর কোনো কাল্পনিক কথা নয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, আর বেশিদিন নেই। মানুষের মস্তিষ্কই হতে চলেছে পরম রিমোট কন্ট্রোল। কারণ মস্তিষ্ক হলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ। যা করোটির অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং দেহের প্রধান নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। মানব মস্তিষ্কের মূল গঠন উপাদান- নিউরন। পরিমাণে থাকে প্রায় ১০ বিলিয়ন। মানব মস্তিষ্ক কম্পিউটারের তুলনায় অনেক নমনীয়। এই নমনীয়তা মানুষকে অনেক বেশী সৃজনশীল করে গড়ে তুলেছে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, পিসির মতো মানব  মস্তিষ্কও ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য তারের মাধ্যমে সংযুক্ত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটের সমন্বয়ে কাজ করে। কম্পিউটার যেখানে ডাটা প্রসেসের জন্য ‘শূন্য’ ও ‘এক’ ব্যবহার করে থাকে। সেখানে মানব মস্তিষ্ক ‘সব’ অথবা ‘কিছু নেই’ এই দু’টো বৈদ্যুতিক ইমপালসের মাধ্যমে ডাটা প্রসেস করে থাকে। এখন দু’টোকেই যদি একই ভাষা, মানে একটা কমন ভাষা রপ্ত করানো যায় তবে দু’জনের মধ্যে অনায়াসেই ভাব বিনিময় করানো সম্ভব হবে। এমনই সহজ হিসাব বিজ্ঞানীদের। 
গবেষকদের প্রত্যাশা, মস্তিষ্কের ডিজিটাল শব্দগুলোকে ধারণ করে একটা পিসিতে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব হবে এবং পিসিটা সে অনুযায়ী মেশিন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এবার ভাবুন তো! একজন মানুষ হুইল চেয়ারের উপর বসানো একটা রোবোটিক বাহু নাড়াচাড়া করছেন শুধুমাত্র চিন্তার সাহায্যে! চিন্তা করুন, মাইক্রোফোন থেকে ডিজিটাল একটা স্রোত বয়ে গিয়ে ঢুকছে বধির ব্যক্তির কর্ণকুহরে এবং সেখানে তা ওই ব্যক্তির জন্যে শব্দের ধারণা হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে। 

এখনো অনেকটা স্বপ্নের মত মনে হলেও এই প্রজেক্টের একটা অফিসিয়াল নাম রয়েছে! ‘ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস’। মাত্র এক দশক আগেও এটা স্বপ্নেরও অতীত ছিলো। কিন্তু আজ এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এক্ষেত্রে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকরা এগিয়ে রয়েছেন। তারা গবেষণাগারে বানরের ব্রেইনে সার্জারির মাধ্যমে ইলেকট্রোড ঢুকিয়ে দেয়। সেই বানরগুলো তাদের মস্তিষ্কের সাহায্যে রোবটিক বাহুর নাড়াচাড়া করেছে। ইলেকট্রোডগুলো হাত নাড়ার জন্য ব্রেইনের নিউরোন থেকে প্রয়োজনীয় সিগন্যাল সংগ্রহ করে এবং একটা পিসি সেই সিগন্যালকে রোবটিক বাহু চালানোর জন্য নির্দেশে রূপান্তরিত করে। আর এই নির্দেশের বিষয়টা ঘটে থাকে মূহুর্তের মধ্যে। শুধুমাত্র হাত নাড়ানোর মধ্যেই এটা সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি এখন হাত মুষ্টিবদ্ধ করানোও সম্ভব হচ্ছে। 
শুধু কি তাই? ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো ইঞ্জিনিয়াররা এখন বানর থেকে মানুষের দিকে এগুচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাঁরা কতিপয় স্বেচ্ছাসেবকের মাথায় অস্থায়ী ইলেকট্রোড স্থাপনে সাফল্য লাভও করেছেন। তাদের ঐ স্বেচ্ছোসেবকগণ পারকিনসন বা এ ধরণের অন্যান্য কম্পন জাতীয় অসুস্থতার জন্য সার্জারীর অপেক্ষায় ছিলেন। ইলেকট্রোড স্থাপনের পরে তারা ইলেকট্রোডের মাধ্যমে ব্রেইন থেকে পাওয়া সিগন্যালের সাহায্যে ভিডিও গেম খেলতে সক্ষম হয়েছেন। বিজ্ঞানীরা এজন্যে একটা পিসিকে গেম খেলতে দরকারি জয়স্টিকের বিভিন্ন নাড়াচাড়া করতে ব্রেইনের যে কার্যক্রম, সেগুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন এবং এর মাধ্যমে পিসির ইলেকট্রোডের সিগন্যালগুলোকে নির্দেশে পরিণত করার পাঠ নেয়। 

এই সাফল্যের পর বিজ্ঞানীরা এ সংক্রান্ত দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণায় আগ্রহী হয়েছেন। গবেষকদের মতে, ‘এ ব্যাপারে আরো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে এ ধরণের ইলেকট্রোড স্থাপিত ব্যক্তিদের দেখতে অনেকটা সাইবর্গ স্টাইলের দেখাচ্ছে। কারণ পেছন দিয়ে তার ঝুলে থাকছে। এটা দেখতে কুৎসিৎই শুধু লাগছে না বরং এটা অস্বাস্থ্যকরও বটে। কারণ এ অবস্থায় ইনফেকশন হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।’ 
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাদের এই ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেসকে ওয়াইফাই, ব্লুটুথ বা তারবিহীন- ওয়্যারলেস করার জন্য এখন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রেইনের মধ্যে সুপ্ত ইলেকট্রোড থাকবে এবং ব্রেইন সেখানে সিগন্যাল রিলে করবে। ব্যস। সেখান থেকে মাথার খুলির বাইরে সংযোজিত একটা রিসিভারে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেবে। রিসিভার আবার সেখান থেকে ব্যক্তির হাতের কব্জিতে বাঁধা স্মার্ট ঘড়িতে বা পকেটে গোঁজা অ্যান্ড্রয়েড গ্যাজেটে পাঠাবে। তখন সেই তারবিহীন স্মার্ট গেজেট প্রযুক্তিতে রোবোটিক বাহু বা কোনো মেশিনে নির্দেশনা পাঠাবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় তারবিহীন ‘ওয়াইফাই’ ‘ব্লুটুথ’ প্রযুক্তি সংযোজিত হলে সম্ভাবনা অপার হয়ে যাবে। আর তখন সিগন্যালের সাহায্যে মানুষ ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে সহস্র কিলোমিটার দূরের মেশিনকে নির্দেশ দিতে সক্ষম হবে। কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইলেকট্রোড ট্রান্সপ্লান্টেড অন্য আরেকজন মানুষকে নির্দেশ দিতে সক্ষম হবে। যা সত্যিকার অর্থেই টেলিপ্যাথি বৈকি! 

ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের এ পর্যন্ত সাফল্য হাত নড়াচড়া করানো বা মুঠো করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এটা অন্তর্গামী স্পর্শ বা বহির্গামী কথা প্রেরণের মত সাফল্যে উন্নীত হবে কীনা সে বিষয়ে এখনো বিস্তর গবেষণার অবকাশ রয়েছে। তা সত্বেও ওয়াইফাই প্রযুক্তির শনৈ শনৈ উন্নতিতে এর বিরুদ্ধে বাজী ধরতে যাওয়াটা বোকামী হবে বলেই গবেষকদের ধারণা। তো অপেক্ষা করা যাক, ওয়াইফাই সমৃদ্ধ মানব রিমোট কন্ট্রোলের জন্য।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
সাই-টেক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত