অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মিডিয়াবোদ্ধা!

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ০১:১০ পিএম, ২২ মে ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০৫:৩৬ পিএম, ২২ মে ২০২১ শনিবার

হ্যাঁ এই শিরোনামটিই যুৎসই মনে হলো। আরও মনে হলো একটা বিস্ময়বোধক চিহ্ন অবশ্যই ঠুকে দেওয়া যায় সামনে। কারণ, এখন যা কিছু হচ্ছে তাতে বিস্মিতই হচ্ছি বেশি। এখন দেখি সবাই মিডিয়া বোদ্ধা। তারা সাংবাদিকতার আগাপাশতলা সব বোঝেন। সাংবাদিকদের অহরহ জ্ঞান দিতে থাকেন। বলতে থাকেন- এটা নয়, ওটা করা উচিত। এখন সকলেই বোঝেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। গ্রামের জ্ঞাতি দিনমজুর চাচা, শহরে বাসার সামনের সবজিওয়ালা, প্রতিবেশি ব্যবসায়ী, আমলা বন্ধু আর রাজনীতিক ঘনিষ্ঠজন এরা সকলেই সাংবাদিকতা নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। একজন মন্ত্রী, তিনি তো দেবেনই। 

নব্বইয়ের দশকে বছর খানেক ধরে ডজন খানেক ক্লাস নিয়ে যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এটা ওটা শিখিয়েছিলেন আতাউস সামাদ নামে এক প্রয়াত সাংবাদিক, (প্রখ্যাত এখন আর বলছিনা কারণ যে সাংবাদিকতার পাঠ এখন সকলে আকছার দিচ্ছেন, তাদের সামনে আতাউস সামাদ কোন ছার) তার কোনো মূল্যই দেখি আর নেই। 

মন্ত্রী (উপ) লিখেছেন:
"তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ না করে, ন্যূনতম সাক্ষাৎকার চেয়ে, তথ্য না চেয়ে, বেআইনীভাবে সরকারী নথিপত্রের ছবি তুলে সংবাদ সৃষ্টি করা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নয়, পরিকল্পিতভাবে চমক সৃষ্টি করা।" 

প্রয়াত স্যারের কথাগুলোই বেশি করে মনে পড়ছে- আপনি যে পড়িয়েছিলেন, প্রয়োজনে ছদ্মবেশ ধরো, ভেক ধরো, তক্কে তক্কে থাকো, হঠাৎ ঢুকে পড়ো মানে অনুপ্রবেশ করো, প্রয়োজনে প্রচ্ছন্ন চাপ দাও, আর তাতেও যদি কাজ না হয় বোকা বানাও, মানে প্রথমে সম্পর্ক তৈরি করো, ভুলিয়ে ভালিয়ে তবেই পেটের ভেতর থেকে তথ্য বের করে আনো। সেসবের কি হবে? 

উপমন্ত্রী মহোদয় তার বক্তব্যটি লিখেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এবং সেই মিডিয়ার কল্যাণে তার বক্তব্য ভাইরালও হয়েছে। ধরেই নেওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়াকে তিনি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছেন এই ভাইরালিটির জন্যই। সে কথা তিনি নিজেই ওই পোস্টে লিখেছেন, বলেছেন গণমাধ্যমে তার আস্থা নেই। সোশ্যাল মিডিয়া তাদের মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হয়ে এসে অনেকটা ত্রাতার দায়িত্ব পালন করছে। তা না হলে তাদের মনের কথাগুলো বলাই হতো না। গণমাধ্যম বলতে অনেক কিছুই বুঝায়, নাটক সিনেমা এসবও। ধরেই নিচ্ছি গণমাধ্যম বলতে তিনি সংবাদমাধ্যমকেই বুঝিয়েছেন।

মন্ত্রী-এমপিদের একটা দায় অবশ্যই থাকে, যারা তাদের ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন তাদের কথা বলতেই হবে, এবং কোনো কারণে কোনো বিভ্রান্তি যদি তৈরি হয়, তাহলে সে ব্যাপারে ভোটারদের ধারনা স্বচ্ছ করে তোলাও তাদের দায়িত্ব। সে জন্য জাতীয় সংসদ রয়েছে। তার অধিবেশন হয়। সেখানে তারা যা বলেন তা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। একটি চ্যানেল রয়েছে সংসদ টিভি নামেই। যা থেকে সব কথা প্রচার হয়। অবশ্য মন্ত্রীমহোদয় তো নিজেই বলেছেন এই গণমাধ্যমে আর তার আস্থা নেই, বরং সোশ্যাল মিডিয়াকেই ভরসা মনে করেন। 

হ্যাঁ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার অধিকার তারও রয়েছে। এবং অবশ্যই করবেন। কিন্তু যেখানে এখন এই মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে, এই মিডিয়ার যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া পর্যন্ত হয়েছে, সেখানে একজন উপমন্ত্রীর কাছে আমরা এই মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহারটুকু আশা করতেই পারি। 

একটি ভিডিওচিত্রের খণ্ডিত অংশ যা তথ্য ডিসটোর্টেরই নামান্তর তা একজন মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যের পক্ষে যে দায়িত্বশীল আচরণ হয়নি, তা আমার আনপড় জ্ঞাতি চাচাটিও বোঝেন এবং মানেন। 

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে হেনস্তা করার পর তার পুরো অংশটুকু বাদ দিয়ে ভয়ার্তমুখে তার বলা দুটি কথা- 'আমি তো দোষ করেছি, আমি মুচলেকা দেবো' কথাটি প্রকাশ করে মন্ত্রী মহোদয় কি বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। 

এখানে আমি বলে রাখি, রোজিনা ইসলাম যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকে, যা সাংবাদিকতার নর্মসের বাইরে এবং আইন ও বিধির লঙ্ঘন, তার শাস্তি সে পাক তাতে কোনো বাধা নেই। তবে রোজিনা ইসলামের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দক্ষতা যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্নটি তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ না করে বেআইনীভাবে সরকারি নথিপত্রের ছবি তুলে সংবাদ সৃষ্টি করা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নয়, সে বক্তব্যে আপত্তি রয়েছে। 

আর এই যে বললেন তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ। তা করলেই কি হয়ে যাবে? 
 
তিনি শিক্ষা উপমন্ত্রী, তার কথায় শিক্ষা আছে এটাই ধরে নেবো- ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে লব্ধ শিক্ষাজ্ঞানকে তুচ্ছ করে মন্ত্রীর দেওয়া জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি হবে তার দুই-একটি উদাহরণ তুলে ধরলেও পারতেন। এখনতো বিশ্বজোড়া পাঠশালা। শেখালে গোটা বিশ্বই শিখে নিতে পারতো। আর সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদেরও জেনেথ ম্যাকম, হুগো ডি বার্গ বা ডেভিড স্পার্ককে পড়া লাগতো না। 

অনুসন্ধান তখনই সংবাদকর্মী করে, যখন কোনো কিছু গোপণ করা হয়। আর সে জন্য তাকে নানা পন্থাই নিতে হয়। আপনার বাতলে দেওয়া পথে অনুসন্ধান করলে, নথি যোগাড় না করা গেলে, সাক্ষাৎকার চেয়ে আর তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে আর যাই হোক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হবে না। 

এই উপ-মন্ত্রীর পোস্টে সাংবাদিকদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের একটা স্পষ্ট প্রকাশ আমরা দেখি।  

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি নেতৃত্ব দিয়ে দেশটি স্বাধীন করেছেন, ইতিহাস বলে, তিনি সাংবাদিকদের যথেষ্টই গুরুত্ব দিতেন। তার নিজের ঘনিষ্ঠতম সহচরদের মধ্যে দু-চারজন সাংবাদিক অবধারিতভাবেই থাকতেন। সাংবাদিকদের, সাংবাদিকতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো নজির তো কোথাও নেই। যতটুকু গল্প সে সময়ের সাংবাদিকদের কাছে শোনা যায়, তাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে একজন উদারমনা বঙ্গবন্ধুর কথাই শুনি।

অথচ এখন রাজনীতিতে অনেকেই সাংবাদিকতাকে গুরুত্ব দিতে চান না। তবে তাদের শেখাতে চান, আর শিক্ষা দিতে চান। এবং নানা পথে তা দিয়েও থাকেন। ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্যও সাংবাদিককে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এবং দেখেও নেন। 

"বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, সবই গৌন হয়ে যায় যখন বড়সড় মিডিয়া হাউসের নাম সামনে আসে। অন্ধের মতো অনেকে মনে করে উনারা যাই বলবেন, তাই সত্য।" মন্ত্রীর এই কথাও এসেছে ঢালাও মন্তব্য হিসেবে। বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা গৌণ হলে তা সাংবাদিকতা হয় না। তবে এই নিরপেক্ষতার মানেই হচ্ছে, অন্যায়ের ক্ষেত্র যিনি অন্যায়টি করেন তার বিপক্ষে যাওয়া। এ অবস্থায় অন্যায়কবারী নিজেই যদি নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তোলেন তাহলে বুঝেই নিতে হবে সমস্যাটি তিনি ঢাকার চেষ্টা করছেন, কিংবা ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করছেন। আর মিডিয়াকে তো মানুষ বিশ্বাস করবেই। কারণ মিডিয়া সত্যটি তুলে আনার চেষ্টা করে। 

মন্ত্রী মহোদয় শুধু সরকারকে না ধরে কর্পোরেটকে ধরার জন্যও সাংবাদিকদের উৎসাহ দিয়েছেন, এটি ভালো। কিন্তু এখন এই আলোচনা তুলে ধরাকে ফোকাস শিফটের চেষ্টা বলে ভাবা যায় না কী? আমার মনে হয় আমরা রোজিনাতে থাকি। পেশাগত দায়িত্বপালনরত অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাকে দ্রুত জামিনের মাধ্যমে মুক্তকরা হোক। তার বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা দ্রুত খারিজ করা হোক।

তবে এসব কারণে আবেগ বা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কাউকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা বা কাউকে বর্জন করা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে কোনো কাজের কথা নয়। এটা সাংবাদিকদের, সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের ভাবতে হবে এবং বুঝতে হবে। এই ঘটনায় আমরা অন্তত এটা বুঝেছি- সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। তবে তাত্বিক সাংবাদিকতা এও বলে, সাংবাদিকের কোনো শত্রু থাকারও সুযোগ নেই। 

আজ যদি উপমন্ত্রী মহোদয় যদি এমন কিছু কাজ করেন, যা দেশের শিক্ষাখাতের জন্য বড় কিছু ইতিবাচক, তার সংবাদ অবশ্যই সংবাদমাধ্যম কাভার করবে। কারণ সংবাদ মাধ্যমের কাজই হচ্ছে জানানো। নির্মোহ, নির্লিপ্তভাবে খবরটি তুলে ধরা। আর কোথাও যদি অন্যায় কিছু হয়- তা যদি মাটির গভীরেও পুঁতে রাখা হয়, তা গভীর থেকে খুঁড়ে বের করে এনে প্রকাশ করা। 

মনে রাখতে হবে- কাশির পান্ডা, বেশ্যার দালাল আর পত্রিকার রিপোর্টার এরা নাছোড়বান্দা।