অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আছে-নাই`র ঈদ

কিযী তাহনিন

প্রকাশিত: ১২:৫১ পিএম, ১৩ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০২:১৪ পিএম, ১৩ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার

কিযী তাহনিন

কিযী তাহনিন

না, আমার তো আর 'নাই' এর সাথে দেখা হয়নি। সেই যে কৃষ্ণচূড়া গাছের ওপাশে আমি অপেক্ষায় ছিলাম। ওখানেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কেমন ঈদের সুঘ্রাণ। যে যেমন করে ঘ্রাণ নেয়, কিসমিস, পেস্তা বাদাম, গোলাপজল, নতুন গজ কাপড়ের খসখসে পাঞ্জাবি, লাল সিঁদুর শাড়িতে তামা সুতোর কাজ। ঈদ আসলে এমন কত কী যে মনে পড়ে। আর মনে পড়ে একটা গাছের কথা। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ঈদ।  

সেই কথাই বলছিলাম সেই কবে একদিন 'নাই'কে। চারপাশে ঈদ গুনগুন করছে, আর ক্যাম্পাসের চত্বরে, সেদিন আমরা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসেছি। ঈদ আসন্ন বলেই হয়তো, শহরের ভিড়ের জট খুলছে। জটপাকানো বেণী ছেড়ে শহর খোলা চুলে কেমন শান্তিতে এলোমেলো। ক্যাম্পাস বন্ধ ঈদের ছুটিতে। নইলে আমরা কি আর কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অমন পা ছড়িয়ে বসতে পারি! 

বললাম, "ঈদ এর প্ল্যান কী রে?"
-"প্ল্যান?" 
ব্যাস ঐটুকু বলেই ছেড়ে দেয় 'নাই', আর বাকিটুকু বলেনা। 'নাই'কে যারা একটু আধটু চেনে, তারা তো জানে, সে এমনই। আমিও জানি। সে কথা বলে কম, ভেবে ভেবে আকুল। কী ভাবে কে জানে? এই মুহূর্তে বালুর পা দুটো নাচাচ্ছে। বাম হাতের তর্জনী নামক ভাবগভীর আঙুলখানা মুখে ঢুকিয়ে কিছু একটা মুখ থেকে বের করার চেষ্টা করছে। উল্টো দিকে মুখ ফিরে আস্তে করে থু ছুড়লো।  
আমি বললাম, "ছি"
'নাই' সেই ছি কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায়, "আমরা এবার দেশে যাই নাই। গতমাসে আমার চাচা মরে গেলো সেবার গেলাম, এখন আর যাওয়া হবেনা।"
আমি বলি, "আমিও যাই নাই।"
-"ক্যান" 
"দেশে দেশে মোর দেশ আছে, বুঝলি। কোন দেশে যাবো বল?"
নাই নির্বিকার। এই তো হলো 'নাই'। যা জানে তা জানায়না, যা জানতে চায়, তা তো মুখ ফুটে বলে না। হ্যাঁ না কিছু উত্তর নেই। এক কোণে কাগজের খালি ঠোঙা পরে আছে, সেটা ডান হাতে নিয়ে বাম হাত ঠোঙায় ঢুকিয়ে কী এক খেলা খেলছে।  

চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ক্যাম্পাসে দুই একজন ঘুরঘুর করছে, হাতে শপিং ব্যাগ। ঈদের কেনাকাটা করে নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসে এসেছে, আড্ডা দিতে। আমি সেদিকে তাকিয়ে বলি, 
"এই নাই, তুই ঈদ এর কাপড় কিনলি?"
-"হ আম্মার সাথে গেসিলাম মার্কেট, হাফ শার্ট চয়েস করে কিনছি।"
"হাফ শার্ট কি, হাফ হাতা শার্ট?"
উত্তর দেয়না। 
"কালার কী রে?"
-"হলুদ এর মইধ্যে কমলা প্রিন্ট।"
"ক্যাটক্যাটা কালারের কাপড় তোর দেখি বেশ পছন্দ। মাঝেও একদিন দেখলাম নীল হলুদ ফুলওয়ালা শার্ট পরে ঘুরছিস।"
-"আপনি কিনসেন ঈদের কাপড়?" আমার দিকে না তাকিয়ে ওই ঠোঙাকে ফুটো করে, তা টুকরো করবার খেলা খেলতে খেলতে প্রশ্ন করে।  
"হুম সবুজ একটা কিনলাম। একটা গিফটও পেলাম।"

'নাই' ওই টুকরো কাগজের ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে হাত থেকে। খেলা শেষ, আর মায়াও। আমার দিকেও তাকায়না।  

আমিই বলি আবার, যেমন সবসময় বলি, " ঈদের দিন রান্নাবান্নার ব্যবস্থা কী? কী খাবি?"
-"আম্মায় জানে। সেমাই, মুরগির তরকারি।" 

আমাকে সে পাল্টা জিজ্ঞেস করেনা। ভালোই হয়েছে, একই প্রশ্ন আমাকে করলে আমি তো বলতে যেয়ে হোঁচট খেতাম। সেমাই মুরগির তরকারির চেয়েও অনেক বেশি কিছুতে টেবিল ভরবে তো নিশ্চিত। কী দরকার সেই কথা তুলে। নাই টুপ করে চিৎ হয়ে ঘাসে শুয়ে পড়ে। হা করে কৃষ্ণচূড়া গাছের বাতাসে দোলা তিরতিরে পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।  

'নাই' এর সে গাছ দেখবার সময়টুকু দেখতে দেখতে আমার মনে হলো ঈদের কথা, তাই বললাম, 
"জানিস আমাদের একটা গাছ ছিল, তার নাম ঈদ।"
-"গাছের নাম ঈদ!!"
"হুম" 
-"কোন জাইতের গাছ?"
"গাছের জাত পাতের খবর আমি রাখি নাকি তোর মতন? গাছ এইটা জানি, ইয়া বড়, চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা পাতা।"
-"সেই গাছের নাম ঈদ কে রাখসে?"
"কে আর রাখবে, সবাই ঈদ গাছ ডাকে, ঈদ ট্রি, সেই ডাকতে ডাকতে... "

নাই চিৎ হয়ে শুয়ে সমানে বালুর পা নাচাচ্ছে, আর মুখ ভর্তি বাতাস নিয়ে মুখ গোল করে ফুলিয়ে রেখেছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। এ কেমন খেলা কে জানে। তবে সে আমার কথা যে মন দিয়ে শুনছে, তার প্রশ্ন শুনে বুঝলাম। মুখের বাতাস ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, 

-"হেই গাছে ফল ধরে?"
"ফুল ফল কিছু তো দেখিনাই, তোর খালি ফলের চিন্তা, সেই গাছের নাম ঈদ এইটা হলো মূল বিষয়।"
-"সেই গাছ এখন আছে?"
"নাহ ছোটবেলায় ছিল। মরে গেছে কবে যেন।"
-"গাছের নাম ঈদ ক্যান?:
"এইটা হলো আসল প্রশ্ন, তুই লাইনে আসছিস এতক্ষণে। ঘটনা হলো, আমার মা ছোটবেলায় একটা খেলা শুরু করলো আমাদের নিয়ে, ঈদ ট্রি খেলা। ঈদ এর আগের দিন, রঙিন কাগজ দিয়ে নানারকম বল, পাখি, তারা, ফুল এগুলা বানিয়ে সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিতাম। অনেক বেলুন আর লজেন্স। পাড়ার দোকান থেকে আম্মা আর আমরা মুঠো করে চকোলেট কিনে এনে গাছে ঝুলিয়ে দিতাম।  ঠিক যেন চকোলেটের গাছ। "

-"ক্যান?"

নাই শোয়া থেকে উঠে বসেছে। শুধু বসেছে যে তাইনা, পুরা মজলিশী কায়দায় বসে, আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।  

"ঈদের আনন্দ হতো, ওই যে সকালে আমাদের বন্ধুরা আসতো, সব্বাই গাছ থেকে চকোলেটে ছিড়ে ছিড়ে খেতো। আর পুরো বাগানে  হৈ চৈ, যে ফুর্তি হতো,কী বলবো তোকে। "
-"ঝড় বাদল আসলে?"
"ঝড় বাদল আসলে পুরো গাছ ভিজতো, আমরা সেই ভেজা গাছ থেকে ছিড়ে ভেজা চকোলেট খেতাম। শোন, ঝড় বৃষ্টি যাই আসুক, প্রতি ঈদে আমরা সেই গাছ সাজাতাম।"

নাই পুরো তব্দা খেয়ে বসে আছে। 
" কী মজার গল্প না?" 
সে মাথা নাড়ে। তার চোখ ডুবে আছে বিস্ময়ে।  আমার কী যে ভালো লাগে।  

আমরা কোনো কথা বলিনা আর। আমরা প্রতিদিনের মতন সব শেষে, চুপ হয়ে দেখি, এদিক সেদিক, সময়, কৃষ্ণচূড়া গাছের তিরতিরে, অস্থিরতা। 'নাই' নীরবতার এ নিয়ম ভেঙে বলে, 

- "ঈদ গাছ আর বানাবেন না?"
"অনেকদিন তো বানাইনা।"

একটু থামি। 'নাই'য়ের খড়ের মতন চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলি, 

"আচ্ছা শোন, একবার ঈদে তুই আর আমি মিলে ঈদ গাছ বানাবো। এই আস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছকে ঈদ বানিয়ে ফেলবো? আচ্ছা। ঝড় বৃষ্টি আসলেও বানাবো কিন্তু।"

"নাই' ফিক করে অল্প হাসে। যেমন করে হাসে সবসময়। আমিও নিয়ম ভেঙে, আজ তার খড়ের মতন চুলগুলোতে হাত রাখি। আহা,

 "এমনি সবুজ আভা মুখে
মনে হয়েছিল এত অনাদরে তবুও সজল"

আমি বলি, "এবার ঈদে বৃষ্টি হবে নাকি রে?"
'নাই' কোনো উত্তর দেয়না। আমিও প্রশ্ন করিনা আর।  

বাতাসে ঈদের ঘ্রাণ, চোখ ঠোঁট নাক ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাতাসে এলোমেলো চুলের  মতন উৎসব খেলছে, এ শহরে। আমি 'আছে' হয়ে বসে আছি, আর আমার পাশে বালুর পাওয়ালা 'নাই'। সব শেষে, আমরা এমন করেই চুপ থাকি, বসে দেখি, যতটুকু দেখার সাধ্যি। আমরা 'আছে' এবং 'নাই' মিলে উৎসবের অপেক্ষায়। আমরা অপেক্ষায়, একদিন এ কৃষ্ণচূড়া গাছ সাজাবো রং দিয়ে। তার নাম রাখবো ঈদ।