ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
ওমর, দ্য টেন্টমেকার। অনুবাদ: কবির চান্দ । মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-আট]
কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক
প্রকাশিত: ০৭:৩৩ পিএম, ১২ মে ২০২১ বুধবার আপডেট: ০৭:৫৩ পিএম, ৩০ মে ২০২১ রোববার
ওমর, দ্য টেন্ট মেকার
আট. কবির শিক্ষাজীবন
আগেই বলেছি যে নিশাপুরে কয়েকটা চমৎকার পাঠাগার ছিল। কয়েকবছর পর মঙ্গোলরা নিশাপুর আক্রমণ করে শহরটা আর এর পাঠাগারগুলোও ধ্বংস করে ফেলে। পাহাড়ি ঝর্ণা যেমন সোনার কণা বয়ে নিয়ে এসে পাথুরে সমতলের কোনো গোপন গর্তে জমা করে রাখে, সেরকমই এসকল পাঠাগারে অনেক গ্রিক পুস্তক সংরক্ষিত ছিল। ইরানিদের মধ্যে গ্রিক ভাষা জানা লোক ছিল না, কিন্তু কখনো কখনো গ্রিক সম্রাটের পাঠানো রাজদূত কিংবা বন্দী বা দাস হিসেবে আনা গ্রিকবাসীর দেখা পাওয়া যেত। এরকমই একজন দূতের বিবরণ থেকে জানা যায় যে সে বছর মালিকশাহ অত্যন্ত দুর্গম এক চূড়ায় তার রাজমুক্তো নামক প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। দুজনে ইস্পাহানের অদূরে শিকারে বের হয়েছিলেন, আর সুলতানের প্রিয় কুকুরটি অনেক উঁচু শিখরে উঠে গিয়েছিল। গ্রিক দূত এটা দেখে মন্তব্য করেন যে তার দেশে এরকম স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ করা হতো। মালিকশাহ তৎক্ষণাৎ সেই উঁচু চূড়ায় প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দেন।
সৌভাগ্যক্রমে ওমর তেমনি একজন শিক্ষিত গ্রিসবাসীর সাথে পরিচিত ছিলেন। তার সহায়তায় তিনি সেসব পুস্তক পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি পড়তে পেরেছিলেন জেনোফোনের চির মনোলোভা কাহিনী*, যাতে দশ হাজার গ্রিক সৈন্যের পারস্য অভিযানের বিবরণ আছে। সাইরাস**(কনিষ্ঠ) তার বড় ভাই দ্বিতীয় আরদেশিরের*** থেকে পারস্য সাম্রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি দশ হাজার গ্রিক সৈন্য ভাড়া করেন। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য ব্যর্থ হন, নইলে এশিয়ার ভবিষ্যৎ অন্যরকম হতো। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া অ্যারিস্তোফেনিসের নাটকগুলোর দুয়েকটি এবং ইউরিপিদিসের আলকামায়ন নাটকটিও তিনি পড়েছিলেন। অ্যারিস্তোতল আর প্লাতুনের রচনা তাকে চমৎকৃত করেছিল। কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল এপিকিউরাসের রচনার একটা অংশ দ্বারা, যাতে দাবি করা হয়েছে যে অণু দ্বারা গঠিত দেবতাগণ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন, মানুষেরা ভাগ্যের অন্ধ ও অসহায় সন্তান যাদের উপর দেবতারা কোনো প্রভাব বিস্তার করেন না, এবং যে মূহুর্তটি চলে যাচ্ছে সেটা থেকে যথাসম্ভব সুখ কুড়িয়ে নেয়াটাই মানুষদের জন্য সর্বোত্তম কাজ।
পাঠাগারে তিনি ইউক্লিডের অমর গণিত পুস্তকও পেয়েছিলেন। আপন মনের আনন্দে ওমর বীজগণিত রচনায় হাত দিলেন, যাতে তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার মহান গণিতবিদের সূত্রাবলি সহজ ভাষায় লিখলেন। অবাক ব্যাপার হলো, সেখানে বাইবেলের আদিপুস্তকের গ্রিক অনুবাদও ছিল। মোল্লারা নিশ্চয়ই এর মর্ম বুঝতো না। সেখানে ওমর এ ধরনের অনুচ্ছেদ পেলেন:
“সূর্যের নিচে মানুষেরা এত যে পরিশ্রম করে তাতে তাদের কী লাভ হয়?”
“এক প্রজন্ম চলে যায়, আরেক প্রজন্মের আগমন ঘটে; কিন্তু পৃথিবী সেরকমই থাকে।”
“যা ছিল তা হবে। যা করা হয়েছে তা করা হবে।”
“আগের কোনো কিছু স্মৃতিতে থাকবে না। যারা আসবে তাদেরকেও পরবর্তীরা ভুলে যাবে।”
“মানুষের জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্টতর কিছু নেই যে, তারা খাবে ও পান করবে, এবং নিজ পরিশ্রমের মধ্যে মঙ্গল অনুভব করতে শিখবে।”
“অতি ন্যায়পরায়ণ হয়ো না, অতি জ্ঞানীও না। নিজেকে ধ্বংস করে লাভ কি?”
“উত্তম যেমন, পাপীও তেমন; যে শপথ নিয়েছে সে যেমন, যে শপথ নিতে ভয় পায় সেও তেমন। এটা একটা খারাপ ব্যাপার যে, সূর্যের নিচে যা কিছু করা হয় সবকিছুর জন্য একই ঘটনা।”
“তোমার মত চল, আনন্দের সঙ্গে তোমার খাবার খাও, প্রসন্নচিত্তে তোমার মদ্য পান কর . . . তোমার পোষাক যেন সর্বদা সাদা থাকে, আর তোমার মাথায় যেন প্রসাধনীর ঘাটতি না থাকে . . . কেননা যে কবরে তুমি যাবে সেখানে কাজ বলে কিছু নেই, পরিকল্পনা বলে কিছু নেই, জ্ঞান বলেও কিছু নেই।”
হিব্রুতে প্রচলিত এই সংশয়বাদ ওমরের মনে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল, এবং তার অনেক চতুষ্পদী এরূপ ভাবনাকে ঘিরে রচিত হয়েছিল। গ্রিক দর্শনের নানা স্তরের সঙ্গে পরিচিত হবার ফলে নিজ সমাজে প্রচলিত অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ মতবাদে নিমগ্ন থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাইরে বাইরে তিনি ছেলেবেলায় শেখা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চললেও, একথা বলতে তার কার্পণ্য ছিল না যে কোনো ধর্মই অন্য কোনোটার চেয়ে ভালো বা খারাপ নয়। গির্জা ও মসজিদ, আলখাল্লা ও ক্রস, বৌদ্ধমন্দির এবং ইহুদিদের উপাসনালয়, সবই তার কাছে সমান ছিল।
তিনি বলতেন, “কাবার খোঁজ না করে হৃদয়ের খোঁজ নাও।”
ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও তিনি মদের প্রশংসা করতেন, পেয়ালায় ঢালা লাল শরাবের গুণ গাইতেন। প্রচলিত মতের বিরুদ্ধাচরণের কারণে তাঁর নিন্দা কম হয়নি, কিন্তু তার রসজ্ঞান তাঁকে সেসব থেকে রক্ষা করেছে। তাছাড়া, যদিও তিনি মাতলামীর আনন্দের কথা বলতেন, তাঁকে কখনোই মাতাল অবস্থায় দেখা যায়নি। এবং যদিও তিনি মদের প্রশংসায় চতুষ্পদী রচনা করেছেন, এবং রুবাইয়াতে এমন ধারণা দিয়েছেন যে পানোৎসবে মত্ত হুরতুল্য রমণীদের সঙ্গ ছিল তার জীবনের অন্যতম আনন্দের বিষয়, বাস্তবজীবনে তিনি সেরকম ছিলেন না।
আগের কিস্তিসমূহ:
[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ] [কিস্তি-৫: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী] [ছয়. প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ] [সাত. উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকারী]
একটা বিশেষ ঘটনা তাকে বুঝতে সহায়তা করেছিল। কোনো একজন হেকিম বা ধর্মশাস্ত্রীয় প-িত মনে করত যে ওমর বিপথগামী হয়েছেন এবং সে এ বিষয়ে সমালোচনায় সোচ্চার ছিল। তাঁর অনিয়মের কথা বলার কোনো সুযোগ পেলে সে তা হাতছাড়া করত না। ওমর বোধহয় সেটা শুনেছিলেন। এই মোল্লা প্রতিদিন ভোরে সূর্যোদয়ের আগে ওমরের কাছে এসে দর্শন শিখতেন। ওমর ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে দিলেন না যে তিনি তার বিদ্বান ছাত্রের এই দ্বিচারিতার কথা জানেন। একদিন তিনি তাকে একটু বেশি সময় কাছে রাখলেন। হঠাৎ রাস্তায় ঢাকঢোলের শব্দ পাওয়া গেল। সেই প-িত এবং ওমর দরোজায় এসে দাঁড়ালেন। একজন বিস্মিত, অন্যজন ঘটনার কারণ জানতেন। যখন অনেক লোক জমায়েত হলো, ওমর হাত তুললেন। আগেই ঠিক করে রাখা সঙ্কেত মোতাবেক বাদকদল বাজনা থামিয়ে দিল। ওমরের সুন্দর মুখাবয়বে তখন কৌতুক ঝরে পড়ছে। তিনি জমায়েতকে উঁচু গলায় বললেন,
“নিশাপুরবাসীগণ! আপনাদের এই বিজ্ঞব্যক্তিকে দেখুন। তিনি প্রতিদিন সকালে গোপনে আমার এখানে আসেন আর দর্শন ও বিজ্ঞান শিখেন। কিন্তু আড়ালে তিনি আমার সম্পর্কে কী বলেন আপনারাই তা ভালো জানেন। তিনি যা বলেন আমি যদি সত্যি সত্যিই সেরকম বিপথগামী আর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে থাকি, তাহলে তিনি আমার এখানে পড়তে আসেন কেন? আর যদি তিনি জানেন যে আমি বিপজ্জনক কেউ নই, তাহলে তিনি তার ওস্তাদকে অসম্মান করেন কেন?”
এরূপ খোলামেলাভাবে স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় হেকিম লজ্জা পেয়ে চলে গেলেন। এরপর থেকে ওমর সকালে অন্যদেরকে সময় দিতে পারলেন। যদি একটিও এমন জিনিস থাকে যা তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন সেটা হচ্ছে ভ-ামি। কপট ধার্মিকদের নিয়ে লেখা তাঁর তীর্যক চতুষ্পদী মাঝে মাঝেই নগরবাসীদের হাস্যরসে মাতিয়ে তুলত।
গ্রিকভাষা শেখার কল্যাণে তার কাছে আসা চিঠিটা তিনি পড়তে পেরেছিলেন। এটা ছিল এরকম-
“হে কবি -
আমি আপনার কবিতা শুনেছি। বহুবছর ইরানে থাকলেও আমি জাতিতে গ্রিক। সেকারণেই ইরানি তরুণীদের চেয়ে বেশি সাহসী। আরও কবিতা শোনার ইচ্ছেয় কাতর হয়ে আছি। আমি স্বদেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্ত কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। আমি জানি যে আপনাকে বিশ^াস করতে পারব, এও জানি যে আপনিও পত্রবাহক জালিমকে বিশ^াস করতে পারবেন। আপনি যদি দয়া করে আপনার উপদেশ প্রার্থনা করার জন্য আমাকে অনুমতি দেন, তাহলে পরেরবার আসার সময় হলুদ গোলাপ বা সিরাজের গোলাপী আভার বুনোফুল পরে আসবেন। বাকিটা আমি সামলে নেব। আমি যে বীজ বুনলাম তা যদি আপনার হৃদয়ের পাথুরে অংশে পড়ে গিয়ে থাকে, আমার আর্জি শোনার দরকার নেই, আর আমি যে এই পত্র লিখেছি সেটাও ভুলে যেতে অনুরোধ করছি।”
চিঠিটার নিচে ‘আগাপে’ নামের স্বাক্ষর।
ওমর অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। মেয়েটা কীভাবে জানল যে তিনি গ্রিক ভাষা পড়তে পারেন? রাজসভা থেকে পালিয়ে যাবার জন্যই বা সে কেন তাঁকেই বেছে নিল? এটা কি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র? তখন তার মনে পড়ল দ্বিতীয়বার দেখার সময় তরুণীর চোখে তিনি নীরব মিনতি দেখেছিলেন। তখন তা বুঝতে পারেননি। এখন তার চিঠি ওমরের কল্পনাবিলাসী মনকে নাড়া দিল। গত আটচল্লিশ ঘন্টা ধরে ওই দুটি বিষাদমাখা সুন্দর চোখ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। অথচ প্রথমবার যখন দেখেছিলেন তখন ওগুলো আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল। প্রথমবার যখন তার হাসি শুনেছিলেন তখন তা ছিল মুক্তোয় পরিপূর্ণ উপত্যকায় ঝর্ণার পানির চেয়েও টলমলে আর মিষ্টি। সে প্রাণপ্রাচুর্যের সঙ্গে আজকের এই চিঠিতে স্বদেশে ফিরে যাবার জন্য প্রচ- আকুতি যা তাকে চিঠি লেখার মত বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করেছে তা মেলানো কঠিন।
এ প্রশ্নগুলোর জবাব সহজ নয়, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি এ রোমাঞ্চে নামবেন এবং এর শেষ পর্যন্ত দেখবেন। বিপদের হাতছানিটা তাকে কম উদ্দীপ্ত করেনি। তাঁকে অস্থির দেখাল, এবং তাঁর মন গণিতের হিসেবি জগত থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। তিনি ঘুমোতে পারছিলেন না। রাতের অনেকখানি পার হয়ে গেলে তিনি বের হয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘহীন নির্মল আকাশ। হঠাৎ আকাশের মাঝখান থেকে একটা উল্কাপি- দীর্ঘ বাঁকা আলোর রেখা তৈরি করে ছুটে গেল আর পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল। একথা ভেবে তাঁর হাসি পেল যে, কুসংস্কারে বিশ^াসী মুয়াজ্জিন নিশ্চয়ই ঘটনাটাকে কারও জন্য অমঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করবে। এটা কি তাঁর নিজের দুর্যোগের চিহ্ন, নাকি দয়ালু সুলতানের? রাত ফুরিয়ে আসছিল। পূবের আকাশে অন্ধকারের বিপরীতে নেকড়ের লেজের মত সাদা আলোর বিচ্ছুরণ। ওমরের মনে সেই চমৎকার চতুষ্পদীটা এল, যেখানে তিনি প্রকৃত প্রেমের পরিচয় তুলে ধরেছেন:
“প্রেমিকের কোনো অবসর নেই, শান্তি নেই, আহার বা নিদ্রাও নেই
বছর, মাস, রাত্রি আর দিন কাটে তার এক ভাবেই।”
এবং এটা রচনা করার পর তিনি আরও একটা চতুষ্পদী রচনা করলেন, আর ভাবলেন এটা সেই সুন্দরী রমণীকে উপহার দেবেন।
“ বার চেহরেইয়ে গুল নাসিমে নওরুজ খোশ আস্ত
বার সাহনে চামান রুইয়ে দেল আফরুজ খুশাস্ত
অজ দি কে গুজাস্ত হার চে গুয়ি খুশ নিস্ত
খুশ বশ ও যে দি মাগু, কে এমরুজ খুশ আস্ত।”****
অর্থাৎ:
নতুন বছরে হাওয়াদল খুশিফুলের বদন চুমি,
মনে সুখ আনে প্রসারিত মাঠসবুজাভ মৌসুমী,
যা কিছু গিয়েছে অতীত উদরে নয় আর মধুরেণ,
সুখে থাকো আর ভুলে যাও গত, এই ক্ষণে বাঁচো তুমি।
রাত ফুরাবার অপেক্ষায় যেন ওমরের তর সইছিল না। যদিও তিনি জানতেন যে আরও অন্তত চব্বিশ ঘন্টা আগাপের সঙ্গে দেখা করা ঠিক হবে না। আগেই ঠিক করা ছিল যে তিনি এবং নিজাম-উল-মুলক নিশাপুরের অদূরে তার একটা প্রিয় বাগানে সকালটা একসঙ্গে কাটাবেন। বাগান ও প্রাসাদসমূহের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া ইস্ফাহানের বিখ্যাত এবং পারস্যের সুন্দরতম নদীটির অনুকরণে এ জায়গাটা তৈরি করা হয়েছে। অবশ্যি এখানে কোনো প্রাসাদ নেই। তবে বুলবুল, যে ভালোবাসে কিন্তু কখনোই তার মনের আকুতি পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না, তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে গানের মূর্চ্ছনায় জায়গাটাকে ভরিয়ে রাখে। এখানকার কোমল বাতাস সবসময়ই গোলাপের গন্ধে মাতোয়ারা, আর মরুর দিকে হারিয়ে যাওয়া নদী এখানটায় তার প্রবাহের ধ্বনি দিয়ে সবসময়ই মৃদু সঙ্গীত বাজাতে থাকে। গরমের সময় মাঝে মাঝে ওমর এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান। গ্রীষ্মকালীন ঘরটা থেকে নিচের ফুলের বাগান আর নদীটা চমৎকার দেখা যায়। এটা অনেকটা ছোট পানশালা বা ভোজন গৃহের মত। এর মালিক একজন পার্সি, যে গর্বভরে নিজেকে প্রাচীন অগ্নিউপাসকদের বংশধর বলে দাবি করে। সে জ্যোতির্বিদ-কবিকে ভালোবাসে, তাই ওমর এখানে এলে তার আনন্দের সর্ব্বোচ্চ ব্যবস্থা করে। নিজাম-উল-মুলক এখানে একটা দিন কাটাতে চান শুনে তিনি সরাইমালিককে খবর পাঠালেন যে, সেদিন সেখানে একটা পার্টি হবে। ঘরটা খালি রাখতে এবং সবচেয়ে দক্ষ মদ্য পরিবেশক আর বংশীবাদকদের দিয়ে আনন্দময় পরিবেশ তৈরির অনুরোধটাও করে রাখলেন।
------
* জেনোফোনের অ্যানাবাসিস নামক পুস্তককে বুঝানো হয়েছে।
** মূল উপন্যাসে গ্রিকদের অনুকরণে Kurush নাম দেয়া আছে । কিন্তু ইরানে এ নামটি সাইরাস হিসেবে পরিচিত। ইতিহাসে অন্তত তিনজন সাইরাসের খোঁজ পাওয়া যায়। সাইরাস দ্য গ্রেটের পূর্বে আরেকজন সাইরাস ছিলেন। আলোচ্য সাইরাস এদের মধ্যে কনিষ্ঠ, ইরানিরা বলে সাইরাস কুচিক (মানে, ছোট)। ইনি ছিলেন দ্বিতীয় দারিয়ুসের সন্তান। পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তর অংশের শাসনকর্তার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর বড়ভাই আর্দেশির সম্রাট হলে তিনি তাকে উৎখাতের জন্য যুদ্ধযাত্রা করেন এবং এ জন্য দশহাজার গ্রিক সৈন্যের সহায়তা নেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে এ ভাড়াটিয়া সৈন্যরা ঠিকমত যুদ্ধ করেননি। তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে একপাশে রেখে নিজে মাঝখানে থেকে কনিষ্ঠ সাইরাস রণসজ্জা করেছিলেন। গ্রিকদের অংশে তেমন কোনো শক্তি ব্যয় করতে না হওয়ায় আর্দেশির পূর্ণ শক্তিতে কেন্দ্র বরাবর আক্রমণ করতে সক্ষম হন। কনিষ্ঠ সাইরাস পরাস্ত ও নিহত হন।
*** মূল উপন্যাসে Artaksathra উল্লেখ করা হয়েছে। ইরানি নাম আর্দেশির।
**** মূল উপন্যাসে ফার্সি রুবাইটি নেই, কেবল ইংরেজি অর্থ দেয়া আছে। অনুবাদক রুবাইটির ফার্সি উচ্চারণ সংযুক্ত করেছেন এবং মূল ফার্সি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছেন।