১৪১ বছরের পুরনো পাগলা গারদে পাগল হওয়ার দশা!
ছবি ও লেখা: কমল দাশ
প্রকাশিত: ০৩:১৩ এএম, ১২ মে ২০২১ বুধবার আপডেট: ০১:২১ পিএম, ১২ মে ২০২১ বুধবার
জোয়ারার পাগলা গারদে একজন রোগী
"পাগলা গারদ কোথায় আছে নেই বুঝি তা জানা, ঘোড়ার কি ডিম হয় সেই ডিমের কি হয় ছানা?" নিশি বৈদ্যের বাড়ি, কিংবা দামোদর ঔষাধালয় কিংবা কবিরাজ নিশি চন্দ্র দাশের গড়ে তোলা প্রায় দেড় শত বছরের পুরোনো মানসিক রোগীদের সুস্থ করার চিকিৎসা কেন্দ্রটি থেকে বের হয়ে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সেই গানের কলি দুটিই বার বার মনে আসছিলো।
এটিই দেশের প্রথম মানসিক অসুস্থতা নিরাময় কেন্দ্র। স্থানীয়রা বলে পাগলা গারদ। তবে এর সুনাম আছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত তিন হাজার রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এই কেন্দ্র থেকে, এমনটাই দাবি সংশ্লিষ্টদের। আর এখানে সম্পূর্ণ আর্য়ুবেদিক চিকিৎসা চলে।
বস্তুত চট্টগ্রামের চন্দনাইশের এখানটা দিয়ে কাজ সেরে ফিরছিলাম। পথে একটা চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে কয়েকজন স্থানীয় বয়স্ক মানুষের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো। তারাই বলছিলেন এই নিশি বৈদ্যের বাড়ির কথা। সেখানে নাকি সুস্থ-সবল মানুষকে জমি বা অন্য কোনো বিবাদের জেরে মানসিক রোগী বানিয়েও পাঠানো হয়। অন্য রোগীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কদিন পর তারা সত্যি সত্যি মানসিক রোগীতে পরিণত হন৷ তবে সত্যিকারের রোগীও আসে। তারা এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িও ফেরেন, সে গল্পও করছিলেন তারা।
ভিতরে ঢোকার লোভ সামলাতে পারলাম না। কাঁধে ক্যামেরা রয়েছে। ঢুকতে বাধা নেই। তো ঢুকেই পড়লাম। চোখে পড়লো সাইনবোর্ড। তাতে লেখা দামোদর ঔষাধালয়। স্থাপিত- ১৮৮০ সাল। ভেতরটা প্রথম একটু নিরবই মনে হলো। কারো সাড়াশব্দ নেই। এগুতেই দেখি ভাঙা একটি জানালা দিয়ে একজন তাকিয়ে। তার সামনে জানালার শিকটি হয়তো খুলে পড়ে গেছে কবেই। সেই পথে অনায়াসে বের হয়ে আসা যায়। তারই সামনে মাথাটা ইষৎ উপরের দিকে তুলে ধরে আকাশ পাতাল ভাবছেন শশ্রুমণ্ডিত মানুষটি। তার দুটি বিষ্ফোরিত চোখ অন্তত সে কথাই বলছিলো। একটু পর তার নামটিও জানলাম। অনুপম। তার চিকিৎসা চলছে।
অনুপম একা নন, এখন এই কেন্দ্রের বাসিন্দা আট জন। এদের মধ্যে সাত জন পুরুষ এক জন নারী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
কাজি আসাদের কক্ষটি দেখে নিজেরই পাগল হওয়ার দশা। উঁচু ছাদের সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠের মেঝে আর দেয়াল পুরোই নোংরা। তারই মাঝে শুয়ে আছেন মধ্য বয়সী মানুষটি। পেশায় তিনি একজন অ্যাডভোকেট। নাম জানতে চাইলে বললেন, অ্যাডভোকেট কাজি আসাদ।
মাথার উপর সিলিংয়ে একটি ফ্যানের মাঝের গোল অংশটি ঝুলে রয়েছে। তার কোনো পাখা নেই। এমন একটি কক্ষকে নিঃসন্দেহে পাগলা গারদই বলা চলে।
ঝুটন আর আনু মিয়ার দেখা মিললো বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। তারা কখনো হাসছেন, কখনো মেজার খিচরাচ্ছেন।
তাদের সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে অপরদিকে দেখা মিললো দেবী রাণির। সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে ক্যামেরায় পোজ দিলেন। তার পরনে লাল কামিজ, মাথায় সিঁদুর। কোনো কুলের বউ, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এই পাগলা গারদে ঠাঁই পেয়েছেন।
মানসিকভাবে অসুস্থ মানে পাগল নয়। এই সহজ সত্যটা বুঝতে মানুষের সময় লেগেছে বহু কাল এবং এখনও লাগছে৷ আর তার দাম চোকাতে হয়েছে, হচ্ছে সেই সব অসুস্থ মানুষদের ও তাদের পরিবারকে। সমাজের দেওয়া পাগল উপাধি নিয়ে গারদে কাটাতে হয়েছে এইসব মানুষের। তবে এরা সত্যিই কোন না কোন ভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এই দামোদর ঔষাধালয়ের ওষুধ সেবনে ভালো হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
পাগল, পাগলা গারদ ইত্যাদি শব্দ আমরা পাল্টে তুলনামূলক মানবিক শব্দ মানসিক রোগী, মানসিক হাসপাতাল করেছি৷ কিন্তু ছিন্নমূল রোগী দেখলে রাস্তায় তাকে উত্যক্ত করা বা কাউকে ঠাট্টা করে মানসিক রোগী বলে বলার মানসিকতা কি পাল্টেছে? ওদের ‘পাগল' বলে বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়ছে আর বড়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন, এমন দৃশ্য প্রায়শঃই দেখা যেত৷ শহরে-গ্রামে। এখনও নিশ্চয়ই এমন হয়৷ আপনার কোনো প্রিয়জনও কিন্তু এমন ঢিল কিংবা হাসির আঘাতে বিপন্ন হতে পারেন!
তবে এখানে এই কেন্দ্রে তাদের ভালোই চিকিৎসা হয়। সে গল্পই শোনাচ্ছিলেন পীযুষ সেন। তিনি এই কেন্দ্রের বর্তমান তত্বাবধায়ক। জানালেন ১৪১ বছর আগে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দিতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে গড়ে উঠে দামোদর ঔষধালয়। ১৮৮০ সালে সরকারি অনুমোদন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। কবিরাজ নিশি চন্দ্র দাশের গড়ে তোলা এ চিকিৎসালয়ে মানসিক রোগীদের সুস্থ করতে চলে আর্য়ুবেদিক চিকিৎসা। চট্টগ্রাম-কক্সাবাজার মহাসড়ক থেকে ১ কিলোমিটার পশ্চিমে জোয়ারা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ চিকিৎসালয়কে দামোদর ঔষধালয় হিসেবে সাইনবোর্ড টানানো হলেও এটি প্রথমে নিশি বৈদ্যের বাড়ি পরে ধীরে ধীরে জোয়ারার পাগলা গারদ নামে পরিচিতি পায়। সেই থেকে এখনো সরকারি কিংবা বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে এটি।
তাদের এ চিকিৎসায় স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন সহস্রাধিক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এমনটাই দাবি পীযুষ সেনের।
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে শাখা খোলে চিকিৎসা সেবা দিতো প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিশি বৈদ্যের গড়ে তোলা এ পাগলা গারদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধ্বংস করা হয় কবিরাজি ওষুধের কারখানাও। দেশ স্বাধীনের পর ধার-কর্জ করে ফের এ মানসিক হাসপাতাল চালু করা হলেও তা আর আগের রূপ ফিরে পায়নি। নিশি বৈদ্য বাড়ির ঐতিহ্য বজায় রাখতে প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরেন কবিরাজ নিশি রঞ্জন দাশের ছেলে কবিরাজ চিত্ত রঞ্জন দাশ।
সাধারণ রোগী ভর্তি ফি বাবদ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা নেয়া হয়। কেউ ভর্তি করিয়ে ভরণ- পোষণ চালায়, আবার কেউ ভরণ-পোষণ তো দূরের কথা রোগীর খোঁজই নেয় না, জানালেন তত্ত্বাবধায়ক। আছেন একজন কেয়ারটেকারও যিনি খাওয়া-দাওয়াসহ রোগীদের যাবতীয় বিষয়াদি দেখছেন।
তারা দুজনই জানালেন, কালের সাক্ষী হয়ে থাকা এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটির দিকে স্বাধীনতার পর কোন সরকারের সময় স্থানীয় এমপি, মন্ত্রীর নজরে আসেনি।
তারা বলেন, ব্যক্তিগত দানে হলেও এইটি দেশের প্রথম উন্মাদ বা মানসিক ভারসাম্যহীনদের হাসপাতাল। তাই আমরা এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আর্কষণ করছি।
বাংলাদেশে মানসিক ভারসাম্যহীনদের এই একমাত্র আয়ুর্বেদিক চিকিৎসালয়ে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বৃক্ষ, গুল্ম, লতা-পাতা ও বিভিন্ন ওষুধি দ্রব্যের সাহায্যে প্রস্তুত করা ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কোনো ধরনের এলোপ্যাথিক বা অন্য কোন ঔষধ তারা রোগীদের দেন না।
পীযুষ সেনের দাবি, প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া পাগলদের সুস্থ হওয়ার রেকর্ড শতকরা ৮০ ভাগ।
আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কোন ব্যবস্থা না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারি বা বেসরকারি কোন বিভাগ বা সংস্থা থেকে কখনও কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে ইচ্ছা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরণা দিয়েও তেমন সাড়া মেলেনি। রোগীদের চিকিৎসায় পাওয়া অর্থে কোনোমতে চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাণিজ্যিক নয়, শুধুমাত্র সেবাব্রত নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৪১ বছর ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানসিক বিকারগ্রস্তদের রোগ নিরাময়ে কবিরাজি ওষুধপত্র দিয়ে যতটুকু উপকার করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অন্যান্য ওষুধ দিয়ে তা সম্ভব নয় বলিই মত পীযুষ সেনের।