বন্যাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলের ভাগ্য বদলাচ্ছে ভুট্টা
অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:১৯ পিএম, ৩ মে ২০২১ সোমবার আপডেট: ০৯:১৯ পিএম, ৩ মে ২০২১ সোমবার
বন্যাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলের ভাগ্য বদলাচ্ছে ভুট্টা
লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষজন নিশ্চয়ই ৯০ দশকের বন্যা ভুলো যাওয়ার কথা নয়৷ এসময় ভয়াবহ বন্যায় অনেকের বাড়িঘর ভেসে গেছে। স্বজন হারানোর পাশাপাশি অন্যান্য সম্পদ হারানোর বেদনা তো ছিলই। তবে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি ছিলো জমিগুলোর মাটি অতিরিক্ত বেলে হয়ে যাওয়া। ফলে তখন থেকে ধান ও তামাক চাষে লাভের মুখ কমই দেখেছে সেখানকার চাষিরা। এমন অবস্থায় পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেয়ায় কষ্ট হয়ে ওঠে অনেকের।
তবে তিন যুগ পেরিয়ে উত্তরাঞ্চলের অবস্থা এখন অনেকটাই ভিন্ন। সবসময় সরগরম থাকে সেখানকার বাজার। ঘরে যেমন আছে টেলিভিশন আবার বাইরেও অনেক ঘরে বসানো আছে সোলার প্যানেল। আর দরিদ্র মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটানোর মাধ্যম হলো ভুট্টা। কীভাবে এই ফসল সেখানকার মানুষের ভাগ্য বদলাচ্ছে তা তুলে ধরা হয় মোসাব্বের হোসেনের লেখা রয়টারের এক প্রতিবেদনে।
লালমনিরহাটের হাসেন আলী (৫০) নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি নিজের ভাগ্য বদলাতে প্রায় ২০ বছর ঢাকায় রিক্সা চালিয়েছেন। পাঁচ বছর আগে নিজের বাড়িতে ফিরে ধান চাষ করেন৷ ব্যর্থ হয়ে পরে শুরু করেন ভুট্টা চাষ। আর এখন প্রতি মৌসুমে আয় করেন অন্তত দুই লাখ টাকা। বর্তমানে হাসেন আলী তার ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন এবং নিজে সুখে আছেন বলে জানান।
এই চিত্র শুধু হাসেন আলীর নয়, বলা চলে উত্তরাঞ্চলের৷ অতিরিক্ত বন্যাপ্রবণ হওয়ায় এখানকার বেলে মাটিতে ধানের চাষ ভালো হয় না। তাই অন্য সব ফসল থেকে ভুট্টা চাষে অধিক মুনাফা পাচ্ছেন চাষিরা৷
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমিজ উদ্দিন বলেন, বেলে মাটিতে ভুট্টা ছাড়া অন্য কোন ফসলেই এত মুনাফা তোলা সম্ভব নয়। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ১ লাখ ১ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়। সরকারি তথ্যমতে, এখান থেকে দেশের ভুট্টা চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়৷ বর্তমান অর্থবছরে রেকর্ড ১০ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে এসব জমিতে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলে ঘনঘন বন্যা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় চাষিদের জীবনমান উন্নয়নে ভুট্টাই বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
এই কৃষিবিদ জানান, বেলে মাটিতে ভুট্টার শেকড় ৬ ফুট নিচে গিয়ে পানি স্পর্শ করতে পারে। অন্যদিকে ধান পারে মাত্র ছয় ইঞ্চি। আর পোলট্রি খাদ্য থেকে শুরু করে চিনি ও কাগজ তৈরিতে ভুট্টা ব্যবহার হওয়ায় তা অনেক বেশি লাভজনক।
কৃষকরা এক মন ভুট্টা বিক্রি করে পান অন্তত ৮৫০ টাকা। যা প্রতি মন ধানের চেয়ে ১৫ শতাংশ ও গম থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম এই তথ্য জানান।
পুরো বছর কাজের জোগাড়
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জলসম্পদ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক আতাউর রহমান বলেন, নদীর তীর ভাঙন ও বন্যা উত্তরাঞ্চলের সাধারণ সমস্যা হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রায় পর্বতমালার হিমবাহগুলি গলেছে, ফলে নদীগুলির মধ্যে আরও জল প্রবাহিত হচ্ছে, যা প্রচুর পরিমাণে বালি নিয়ে আসে।
তিনি আরও বলেন ফলে ভারী বর্ষণ বর্ষা মৌসুমে বন্যার সৃষ্টি করে, এবং বন্যার পরে যখন পানি আবার কমতে থাকে, তখন আবাদযোগ্য জমি বালুতে ভরে যায়,"
তিন বছর আগের তিস্তা নদীর পানিতে সৃষ্ট বন্যার কথা স্মরণ করে ৬২ বছর বয়সী কৃষক লতিফ তালুকদার বলেন, বন্যার পর কৃষকরা নিজেদের জমি ফিরে পেলেও কয়েক বছর কোন চাষাবাদ সম্ভব হয়নি। তিনিসহ কয়েকজন চাষি তখন ভুট্টা চাষের পরিকল্পনা করেন।
লতিফ তালুকদার বলেন, প্রাথমিকভাবে উচ্চ ফলনশীল বীজ ও সারের মাধ্যমে বেশ সাফল্য আসে। তখন আমরা আনন্দিত হই যে এই বেলে মাটিতে কোন কিছু চাষ করা সম্ভব।
তিনি আরও জানান, ১৯৯৭ সালে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে প্রতি একর জমিতে ৪০০ কেজি ভুট্ট উৎপাদনে সফল হন। তার ঠিক একবছর পরই প্রতি একরে ভুট্টা উৎপাদন বেড়ে যায় চার গুণ।
চাষিদের থেকে ভুট্টা নিয়ে পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন কারখানায় বিক্রি করেন আবদুর সবুর। তিনি বলেন, বর্তমানে লালমনিরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় এত বেশি ভুট্টা উৎপাদন হয় যা তাদের পুরো বছর কাজের সুযোগ দেয়।
চাষিরা সারা বছর জমি প্রস্তুতি, রোপন, ভুট্টা সংগ্রহ, সেগুলো শুকানোতে ব্যস্ত থাকেন। আবার অনেকে নিজেই সেখান থেকে পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করেন। ফলে সেখানকার কেউ আর বেকার থাকে না।
সরকারি সহায়তা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আঞ্চলিক উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পানি কম প্রয়োজন এমন জমিতে ভুট্টা চাষে উৎসাহ, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
প্রতি বছর সারা দেশে গড়ে ৩৮ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হলেও আরও ২০ লাখ টন আমদানি করতে হয় অন্য দেশ থেকে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে ভুট্টা চাষ করা কৃষকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। যদি বেলে জমিকে আমরা ভুট্টা চাষের জন্য যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা ভুট্টা রফতানি করতে পারবো।