৯ স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের বিবৃতি
লকডাউনে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশিত: ০৪:২৪ পিএম, ২ মে ২০২১ রোববার
লকডাউন দেয়ার ফলে দেশে ৯৯% রোগীর জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার বিভিন্ন মেয়াদী প্রভাবে অনেক লোক ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং আরো মারা যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। লকডাউন দীর্ঘায়িত করলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন ৯ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ।
রবিবার (২ মে) সকাল ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে “জনস্বাস্থ্যে লকডাউনের প্রভাব”- শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে ৯ জন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ’র পক্ষ থেকে লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট অনুজীববিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ মঞ্জুরুল করিম।
বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, গত বছর করোনা ভাইরাস আসার পর আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের নন-কোভিড রোগীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে এনেছে। ২০২০ সালে দেশে মোট মৃত্যু ছিলো ৮ লক্ষাধিক, কিন্তু করোনায় মৃত্যু ঘটে মাত্র ৮ হাজার লোকের, যা মোট মৃত্যুর মাত্র ১%। এ ১% মৃত্যু কমাতে গিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করে বাকি ৯৯% মৃত্যুকে তরান্বিত করা হয়েছে। বিশেষ করে, লকডাউন দেয়ার ফলে এই ৯৯% রোগীর জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার বিভিন্ন মেয়াদী প্রভাবে অনেক লোক ইতিমধ্যে মারা গেছে এবং আরো মারা যাওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।
যেমন, বিবিএসের মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২০ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার ৪০৮ লোক, যা ২০১৯ এর তুলনায় ২০% বেশি। ব্রেন স্ট্রোকে মারা যায় ৮৫ হাজার ৩৬০ জন যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুন। ২০২০ সালে কিডনি জটিলতায় মারা যায় ২৮ হাজার লোক, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ গুন, (সূত্র- ডেইলি স্টার: মার্চ ১০, ২০২১)।
কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় তিনগুণ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বিবিসির কাছে এক সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা নিজেও স্বীকার করেছেন, করোনা ও লকডাউন-ই এ মৃত্যু বৃদ্ধির মূল কারণ, (সূত্র- বিবিসি: ১১ মার্চ ২০২১) ।
বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, এছাড়া লকডাউনের কারণে মানুষের আর্থিক অসংগতি বাড়ে। যার দরুণ মানুষ জরুরি ওষুধপত্র কেনা ও পরীক্ষা (স্ক্রিনিং), অপরেশন ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সামর্থ হারাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে নিকট ভবিষ্যতে দেশে মৃত্যুহার মারাত্মক আকারে বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মূলতঃ বিজ্ঞান মতে, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যর উপর কোন পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে তার সেফটি ও ইফিকেসি (কার্যকরীতা) পরিমাপ করে, সে অনুসারে পদক্ষেপ নিতে হয়। সেটা শুধু ১% নয়, বরং শতভাগ জনগণের উপর পরিমাপ করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা না করে, তাড়াহুড়া করে লকডাউন দিয়ে দেয়া হয়েছে। যার মাশুল এখন জনস্বাস্থ্যে ভয়ঙ্কর আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে, বলেন তারা।
অনেকে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে গিয়ে যুক্তি দিয়ে থাকেন, লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ রোধ না করলে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১% না হয়ে আরো বেশি হতো। তারা এই ধরনের চটজলদি সিদ্ধান্ত লকডাউনের সে্ইফটি-ইফিকেসি নিয়ে গবেষণা না করেই বলে থাকেন, দাবি তাদের।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়-
মুলতঃ লকডাউনের ইফিকেসি গতবছর এপ্রিল মাসে প্রশ্নবিদ্ধ হয় যখন ইটালির বিভিন্ন শহরে লকডাউনের ডাটা প্রকাশ হতে থাকে। যেমন- ইটালির ভেনটো অঞ্চলের গ্রাফে দেখা যাচ্ছে, করোনায় মৃত্যুর উপর লকডাউনের কোন কার্যকর ভূমিকা নেই।
এরপর ২০২০ সালের মে মাসে মার্কিন সংস্থা ‘জেপি মরগান’ বিভিন্ন দেশের ডাটা সম্বলিত গবেষণা প্রকাশ করে, যেখানে প্রকাশ পায়, করোনা দমনে লকডাউনের কোন প্রভাব নেই, (তথ্যসূত্র: দ্য স্যান, ইউকে, ২২শে, ২০২০)।
বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, সর্বশেষ অতি সম্প্রতি পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ সাইন্স জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণায় একই ধরনের তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, করোনা ভাইরাস বায়ুবাহী। এর আগেও পৃথিবীর ৩২টি দেশের ২৩৯ জন বিজ্ঞানী প্রমাণ পেয়েছেন, করোনা বাতাসে ছড়ায়। করোনা ভাইরাস যদি বাতাসে ছড়ায় তবে করোনা দমন করতে লকডাউনের কোন ভূমিকা নেই।
কারণ লকডাউন দিয়ে মানুষ আটকে রাখা যায়, কিন্তু বাতাস আটকে রাখা যায় না।
তবে এরপরও অনেকে বিভিন্ন গ্রাফ ও গবেষণা প্রকাশ করে দাবি করে, করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউনের ভূমিকা আছে। তাদের এ গবেষণাগুলো মূলত আন-কন্ট্রোলড বিফোর-আফটার স্টাডি, যেখানে এক্সপেরিমেন্টাল গ্রুপকে কোন কন্ট্রোল গ্রুপের সাথে তুলনা করা হয় না। ফলে প্লাাসিবো ইফেক্টসহ অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোকে বিবেচনায় আসে না। এতে তাদের স্টাডিগুলোতে অনেক ভুল ফলাফল প্রদর্শিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ কেউ দাবি করছে, সাম্প্রতিক লকডাউনের কারণে নাকি কোভিড হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগী ভর্তি ৩৫-৪০% কমে গেছে। ফলে সংক্রমণ রোধ হয়েছে, (তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ২৪, ২৯শে এপ্রিল, ২০২১) কিন্তু রোগী হ্রাসের এ পরিমাণকে তারা কোন কন্ট্রোল গ্রুপের সাথে তুলনা করছেন না, ফলে প্ল্যাসিবো ইফেক্ট ও অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা নিয়ে আসছে ভুল ফলাফল।
এক্ষেত্রে আমরা যদি সঠিক ফলাফল নিয়ে আসতে চাই, তবে সঠিক পদ্ধতিতে (প্ল্যাসিবো ইফেক্ট ও অন্যান্য ফ্যাক্টর বিবেচনায়) ‘সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কার্যকরীতা’ নির্ণয় করতে হবে। এজন্য লকডাউনের সময় হাসপাতালগুলোতে সংক্রামক রোগ এবং অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী ভর্তির কম-বেশি তুলনা করতে হবে। এ পদ্ধতিতে আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, হাসপাতালগুলোতে করোনার যে পরিমাণ রোগী কমছে, তার দ্বিগুন কমছে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী সংখ্যা।
এ প্রসঙ্গে, অতি সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কেন্দ্রীয় তথ্যকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, হাসপাতালটিতে স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনিক ৩৫০-৪০০ জন রোগী (ননকোভিড) ভর্তি হয়। কিন্তু লকডাউনে রোগী ভর্তি হচ্ছে মাত্র ৭০-১০০ জন। একই অবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও। যেখানেও স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক নন কোভিড রোগী ভর্তি হয় ১৫০-২০০ মত। অর্থাৎ লকডাউনে হাসপাতালে সাধারণ রোগীর আগমণ ৭০-৮০% পর্যন্ত হ্রাস পাচ্ছে। তাই সঠিক পদ্ধতিতে লকডাউনের ইফিকেসি (কার্যকরীতা) প্রমাণিত হয় না, বরং লকডাউনের কার্যকরীতা ঋণাত্মক বলে প্রমাণিত হয়।
লকডাউনের ইফিকেসি (কার্যকরীতা) প্রমাণিত না হলেও লকডাউনের সেফটি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেক এলাকায় লকডাউনে ‘স্টে হোম স্টে সেফ’ প্রচারণাও ক্ষতিকর রূপে প্রমাণিত হয়েছে। জরিপে উঠে এসেছে, যারা বাসায় দীর্ঘদিন নিজেদের বন্দি রাখছেন করোনায় তারাই বেশি অসুস্থ হচ্ছেন। এ সম্পর্কে ২০২০ সালে মে মাসে নিউইয়র্ক হাসপাতালের প্রকাশিত তথ্যে পাওয়া যায়, হাসপাতালে ভর্তি ৬৬% রোগী ‘স্টে হোম স্টে সেফ’ নীতি অনুসরণ করে নিজেকে বাসায় বন্দি করে রেখেছিলেন। (তথ্যসূত্র: সিএনবিসি, ৬ই মে, ২০২০)
বিবৃতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, লকাডউনের সেফটির কথা গুরুত্ব না দিয়ে যেভাবে জনগণের উপর লকডাউন চাপিয়ে দেখা হয়েছে, ঠিক একইভাবে টিকার সেফটি কতটুকু বিবেচনায় আনা হয়েছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। টিকা নেয়ার পর এক-দেড় মাসের মধ্যে অনেকে মারা যাচ্ছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া নানান তথ্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আসলে অক্সফোর্ড বা স্পুটনিকের টিকায় যে Adenoviral vector প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা একেবাইরে নুতন প্রযুক্তি এবং তার সেফটি এখনও পরীক্ষিত নয়। এত দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি পজিটিভ সেন্সের আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের সেফটি ভালো হবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এক্ষেত্রে টিকার সেফটি আমাদের জনগণের ইম্যুনিটি সাপেক্ষে অবশ্যই পরীক্ষা করা উচিত এবং সেফটি পরিমাপ না করে জনগণের উপর তা গণহারে প্রয়োগ কখন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বিবৃতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ আরো বলেন, মূলতঃ প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ফ্লু ভাইরাসগুলোতে স্বাভাবিকভাবে ১০০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ২০ কোটি লোকের ইনফেকশন ভাইরাল নিউমোনিয়া পর্যায়ে চলে যায়। ভাইরাল ফ্লু-গুলোর একটা বড় অংশের জন্য দায়ী করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনগুলো। এ সমস্যা নতুন কিংবা সাময়িক কোন বিষয় নয়। তাই তাড়াহুড়া করে লকডাউন দিয়ে এ সমাধানের চেষ্টা করেও কোন লাভ হবে না, বরং এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দিকে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের দৃষ্টি দিতে হবে। এ সমস্যার সমাধানে অপরীক্ষিত লকডাউনের দিকে না ঝুঁকে বরং ভাইরাল নিউমোনিয়ার সঠিক চিকিৎসা সহজলভ্য করা আমাদের জন্য জরুরী। এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোতে হাইফ্লো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করা, রোগীর ভাইরাল ইনফেকশন যেন সেকেন্ডারী ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের দিকে যেতে না পারে, সে দিকে দৃষ্টিপাত করা এবং সর্বপরি চিকিৎসকরা যেন রোগীকে ভয় না পেয়ে রোগীর প্রতি আন্তরিক হয় এবং রোগীর সার্বিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা আগে দরকার।
করোনা অবশ্যই একটি সমস্যা। কিন্তু সেই সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ও বৈষম্যহীন সমাধান আমাদের কাম্য। কিন্তু করোনার নামে ভুল ও বৈষম্যযুক্ত পদক্ষেপ আমাদের সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য কখনই ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে না।
বিবৃতিদাতারা হলেন-
১) অণুজীব বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ মঞ্জুরুল করিম, অধ্যাপক- অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; বাংলাদেশ জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি (BJM) এর সম্পাদকীয় পরিষদের সদস্য; বি এস টি আই এর কলসালট্যান্ট, এশিয়ান ফেডারেশন অব বায়োটেকনোলজি (AFOB) এর এক্সকিউটিভ বোর্ড মেম্বার।
২) এমবিএম রুহুল হাসান, এমপ্ল্যানড স্পেসালিস্ট, ব্যুরো ভ্যারিটাস প্রাইভেট লিমিটেড। প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার, গ্যাকো ফার্মাসিটিক্যাল। ৩) ডাক্তার মুহম্মদ নুরুল আফসার, আইসিইউ স্পেসালিস্ট। ৪) মুহম্মদ আসাদুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক, ফামের্সী বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক। ৫) ডা: মুহম্মদ মহসিন রেজা চৌধুরী। ৬) ডা: মুহম্মদ মুজাহিদুর হাসান। ৭) ডা: এস.এম. ইবনে শাইখ এমবিবিএস সহকারী রেজিস্ট্রার, নেফ্রোলজী বিভাগ খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ৮) ডা. মুহম্মদ জর্জিসুর রহমান। ৯) ফার্মাসিস্ট আব্দুল্লাহ আল মামুন।