ভার্চুয়াল ডায়রি
অপরাহ্নের সামগীতি: সুপারম্যান, হাঁসছানা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
রিফাত ফাতিমা, ইন্ডিয়ানা থেকে
প্রকাশিত: ০৩:৪৩ পিএম, ২ মে ২০২১ রোববার আপডেট: ১১:০৭ এএম, ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার
রিফাত ফাতিমা। এখন একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি। বছর খানেকের কিছুটা বেশি সময় ধরে বাস করছেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের সাউথবেন্ডে। সেখানকার প্রকৃতি, জীবনাচার এসব নিয়ে নতুন বিষ্ময়ের আবিষ্কার করেই চলেছে সদ্য দেশ ছাড়া এই মানুষটির কৌতুহলী মন। সেগুলো আবার লিখে রাখছেন ভার্চুয়াল ডায়েরিতে। করোনা ভাইরাসের মহামারি কালে যুক্তরাষ্ট্র যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে তার পর আবার যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেসব চাক্ষুস করছেন কিংবা জানছেন। এর সাথে মিলিয়ে দেখছেন পৃথিবীর অপরপীঠ বাংলাদেশকেও। অপরাজেয় বাংলা'র পাঠকদের জন্য আমরা তুলে আনছি লেখাগুলো রিফাত ফাতিমার ডায়রি থেকে। যার তিনি নাম দিয়েছেন অপরাহ্নের সামগীতি।
আজ পড়ুন সুপারম্যান ও হাঁসছানা প্রসঙ্গ
গতকাল আমাদের স্কুলে সুপারম্যানের আউট ফিট পরে এসেছিল বাচ্চারা। গেট সেট ক্লাসে ঢুকতেই আমার কোলে সুপারম্যানের মত লাফ দিল কুইন্স। আমি তো ঘাবড়ে গেছি, খানিক ধাতস্থ হবার পর মনে পড়ল গতবছর নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএলসির ক্লাসে প্রফেসর ক্যাথরিন বেনেট আমেরিকান সংস্কৃতি পাঠের অংশ হিসেবে আমাদের প্রবল পরাক্রমশালী কিছু চরিত্রের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। তো আমি এঁকেছিলাম সুপারম্যান। প্রফেসর ঘুরে ঘুরে সবার ছবি দেখছিলেন, এমন সময় জানসি আমার ছবি দেখে হা হা করে সে কি হাসি। ‘‘রিফাত তোমার সুপারম্যানের গায়ে কাপড় নেই কেন?’’ আমি তো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছি। প্রফেসর বেনেট কাছে এসে ছবি দেখে মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘‘ডোন্ট ওরি, জাস্ট পুট অন এন আন্ডারওয়্যার।’’ ততক্ষণে পুরো ক্লাসে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলে প্রিকের টিচার ট্রিনা লাল টি শার্ট পরে এসেছে, ‘‘ওয়েল ট্রিনা, সো ইউ আর এ সুপার ওম্যান!” ‘‘ওহ নো! আই এ্যাম জাস্ট এ ব্যাট।’’
এবার ভয়াবহ কোভিড বাস্তবতায় ফিরি। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন একাই আক্রান্তের শ্বাসনালীর কোষের জিনগত কাঠামো পরিবর্তন করতে সক্ষম। ওই কোষগুলো সুস্থ হবার পরেও এই পরিবর্তন চলতে থাকে। ফলে সুস্থ হবার পরেও দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত ব্যক্তি শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা ও দুর্বলতায় ভোগে। টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটি হেলথ সায়েন্সেস সেন্টারের গবেষক নিকোলাস ইভান্সের উদ্ধৃতি দিয়ে আইবিটি’র এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে। ইভান্স বলেন,‘‘এই গবেষণার ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আক্রান্ত হবার পর রোগীর যেসব প্রাথমিক উপসর্গ দেখা যায় তা শরীরের কোষের সাথে স্পাইক প্রোটিনের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার ফল।’’
আমি এখনো ভুগছি, কথা নেই বার্তা নেই, মধ্যরাতে কাশতে কাশতে দম আটকে আসে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বললে কষ্ট হয়। আর বেতাল লাগা তো আছেই। কিছুদিন আগে সেভেন ইলেভেনের সামনে ফাহমিদ (রিফাত ফাতিমার স্বামী, বর্তমানে নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণায় রত) গাড়ি পার্ক করে কিছু একটা কিনতে দোকানে ঢুকেছিল। আমি তাড়াহুড়া করে গাড়িতে ঢুকতেই দেখি এটা আমাদের গাড়ি নয়। ঘাড় ফেরাতেই দেখি পাশের গাড়ির আফ্রো আমেরিকান ভদ্রলোক ফিক ফিক করে হাসছেন। আমি সামলে নেবার চেষ্টায় বললাম, ‘‘ইউ ডিডন্ট সি এনিথিং, এ্যান্ড আই ডিডন্ট ডু এনিথিং।’’সে আশ্বাসের সুরে হো হো করে হেসে বলল, ‘‘রাইট! আই ডিডন্ট সি এনিথিং।’’
স্কুলে মাঝে মাঝেই কিছু না কিছু অনাসৃষ্টি ঘটাই। আমাদের এডুকেশন ডিরেক্টর জুলিয়া একবারেই গন্ধ টের পায়না। ট্রিনা ঘন ঘন ছুটি নেয়। স্টেফানি অনেকদিন ভুগে চাকরিটাই খুইয়েছে। ফাহমিদও যখন তখন কাশে। ভারতের মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে গত দু’সপ্তাহ ধরে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘন্টায় সেখানে ৫৩ হাজার ৪’শত ছিয়াত্তর জন কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। গত অক্টোবরের পর এই প্রথম সেখানে এক দিনে এত বেশি সংখ্যক আক্রান্তের ঘটনা ঘটল। ভারতে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, আত্মীয় পরিজন বিহীন মৃত্যু, লেলিহান চিতার আগুন এখন একমাত্র সত্য। ধনী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন নেবার হার বাড়ছে আর ল্যাটিন আমেরিকা বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর পরিস্থিতি বিপদজনক দিকে বাঁক নিচ্ছে। গত সপ্তাহে সেখানে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার বৈশ্বিক হিসেবে শতকরা ৩৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের কোভিড ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক এমারজেন্ট বায়োসল্যুশন’এর প্রধান কর্মকর্তা বিনিয়োগকারীদের সাথে আলাপকালে এ মাসে কোম্পানিটির বাল্টিমোর প্ল্যান্টে উৎপাদিত এক ব্যাচ ভ্যাকসিনের ভাইরাল দূষণের পরিপূর্ণ দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। গতমাসে জনসন এ্যান্ড জনসনের ১৫ মিলিয়নের বেশি ডোজ এমারজেন্টের কারখানা থেকে ফেলে দিতে হয়েছে। এর ফলে সরকারের অনুরোধে তাদের টিকা উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা দেখেছেন যে, প্ল্যান্টের জীবাণুমুক্তকরণ প্রক্রিয়া, কাঁচামালের ব্যবহার ও কর্মীদের প্রশিক্ষণ যথার্থ নয়। খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগ ১২ পৃষ্ঠাব্যাপী এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অপর ব্যাচের উৎপাদিত ভ্যাকসিনও যে দূষণের শিকার হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মজার বিষয় হচ্ছে এতসব জটিলতার মধ্যেও এমারজেন্ট ২০২১ সালের প্রথম কোয়ার্টারে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে এবং ভ্যাকসিন উৎপাদন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এই বছর ৮৭৫ মিলিয়ন ডলার আয়ের প্রত্যাশা করছে যার উল্লেখযোগ্য অংশই আসবে কোভিড ভ্যাকসিন উৎপাদনের চুক্তি থেকে। আর এমারজেন্টের শেয়ারের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দ্রুত। প্রণোদনা চেক প্রাপ্তির ফলে সাধারণ মানুষের যানবাহন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনার ক্রয়সক্ষমতা বেড়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে ১.৬ শতাংশ বেড়েছে, এ সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬দশমিক ৪ শতাংশ। এই গ্রীস্মে সামগ্রিক অর্থনীতির গতি মহামারীর আগের সময়কার মত হওয়া উচিত বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। ভ্যাকসিন নেওয়ার হার বেড়ে যাওয়া ও করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ব্যবসায়ী বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে।
অক্সফোর্ড ইকোনোমিক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ডাকোর একটি বক্তব্য পড়ছিলাম। তিনি মনে করেন, মানুষ আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবাধে ফিরে আসছে, একজন ভোক্তাকে বাইরে থেকে যদি আত্মবিশ্বাসী মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সে অকাতরে খরচ করতেও সক্ষম। তার বিশ্বাস এবছরের শেষ নাগাদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৯৫১ সালের পর এটাই সেরা পারফরম্যান্স।অপরদিকে ইউরোপের অর্থনীতি যাচ্ছে মন্দার দিকে।
সকালে আজ নির্ধারিত সময়ের পাঁচ মিনিট আগে স্কুলে পথে রওয়ানা হয়েছিলাম। আরবি রেস্তঁরার একটু আগে হঠাৎ দেখি সব গাড়ি থেমে আছে। এক হংস জননী ছানাপোনাসহ রাস্তা পার হচ্ছেন, তাই সব গাড়ি থেমে গেছে। একটা ছানা পিছিয়ে পড়েছিল, বারবার চেষ্টা করেও কিছুতেই ফুটপাতে উঠতে পারছিল না। আমি একটু এগিয়ে নেমে পড়লাম। ফাহমিদ সমানে চিৎকার করছে আমার উপর ক্ষেপে গিয়ে, ছানাটা আমাকে কাছে আসতে দেখি ভয় পেয়ে আবার উল্টোদিকে দিল দৌড়। সিগনাল পড়ায় আমিও তার পিছুপিছু। রাস্তার মাঝখানে আয়ল্যান্ডের ঝোপে লুকালো, সাথে ভয়ার্ত প্যাঁক প্যাঁক। পাঁচ মিনিটের কসরত শেষে সে আবার রাস্তা পার হল, তারপর ফুটপাতে উঠতে পারল। ততক্ষণে তার মা ও ভাইবোনেরা চোখের আড়ালে। জানি না সে তার মায়ের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল কিনা।
বিকেলে হাওয়া বইছে শোঁ শোঁ শব্দে, বাতাসে ভাসছে অসংখ্য পরাগরেনু। দেশে সংসদ ভবনের পেছনের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার আলো এখনো নিশ্চয় জ্বলছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গিয়াসউদ্দীন আবাসিক ভবনের সামনের রাস্তা থেকে শুরু করে রোকেয়া হলের ফুটপাত জুড়ে বেগুনি জারুলের ঘনঘটাও বোধহয় ফুরোয় নি। কার্জন হলের সামনের ক্যানন বল আর ইলেকট্রিক এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের সামনের বসন্তমঞ্জরী গাছের ফুলেরা বুঝি ঝরে গেছে ভীষণ দাবদাহে, কে জানে! এখানে সন্ধ্যা ঘনায় ধীরে। আমরা নিঃশব্দে ইফতার সারি। আবুল খায়ের ভবনে যখন থাকতাম মোসলেমা ভাবি প্রতিদিন ইফতার পাঠাতেন আমার জন্য।অফিস থেকে ফিরে সময় ও শক্তি কোনটাই থাকত না আমার।
গভীর রাতে জানালায় গলে গলে পড়ে জোছনা। উরসা মেজর ও উরসা মাইনরের ভীড়ে কোথায় লুকিয়ে আছে আমার মা? প্রিয় কাজিন আদিত জানিয়েছে আজ আম্মার কবর পরিস্কার করা হয়েছে। তাহিয়া জড়িয়ে ধরে রাখে আমাকে। একসময় ঘুমিয়েও পড়ে। কেবল আমার চোখে ঘুম নেই। জীবনানন্দ হানা দেয় মগজে- ”কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।’’ পরের পর্ব পড়ুন এখানে
রিফাত ফাতিমা
১ মে, ২০২১, সাউথবেন্ড, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র