অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

না দাও অধিকার না দাও ন্যায্য মজুরি, কাজ চাই কাজ দাও

মাহমুদ মেনন, সম্পাদক, অপরাজেয় বাংলা

প্রকাশিত: ০১:১৯ এএম, ১ মে ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০১:২৬ এএম, ১ মে ২০২১ শনিবার

মে দিবস

মে দিবস

মে দিবস কী? এ প্রশ্নের উত্তর কোনটা পাবেন তা নির্ভর করবে আপনি ঠিক কার কাছে জানতে চাইছেন তার ওপর। কেউ হয়তো বলবেন- মে দিবস সেতো নিছকই গ্রীষ্মের একটি দিন! ওই দেখুন না, প্রখর রোদের নিচে গায়ের সব ঘাম ঝরিয়ে পাথর টেনে তুলছেন যে নারী শ্রমিক, তার জন্য দিনটি তপ্ত এক বঞ্চনারই দিন। পুরুষের সমান ওজন বয়, তাও তার  মজুরি আজও কম। কেউ তার খোঁজ নেয়না। নারীটিও জানে না, তার মজুরি হতে পারে পুরুষটিরই সমান। যে পুরুষ সহকর্মী তার মাথায় বোঝা তুলে দিচ্ছে, কিংবা যে পুরুষ কর্মীটি সমান বোঝা বয়ে একই তালে হাঁটছে- সেও কি বোঝে? না বোঝে না। বোঝে না বলেই এভাবেই তপ্ত রোদে তারা পুড়ে কাজ করে, কিন্তু অধিকার বুঝে পায়না। 

কেতাবী ঢংটা যাদের আয়ত্বে তারা বলবেন- কেনো মে দিবস স্রেফ এক গ্রীস্মের দিন হতে যাবে। মে দিবসতো শ্রমিকের জন্য বিরাট এক সম্মানের দিন। বিপুল অর্জনেরও দিন বটে। এই দিনেই তো তাদের জন্য দিনে আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা বিনোদন, আর আট ঘণ্টা ঘুমানোর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।

তাই বুঝি? তা জানতে চান না ওই নারী শ্রমিকটির কাছে? সেই ক’টায় কাজে এসেছে? কখন যাবে? আর দিন শেষে ক’টাকাই বা কাপড়ের খোঁটে বেঁধে ফিরতে পারবেন ঘরে?

কিংবা এই শ্রমিকটির কাছে, যে সেই যে ভোরের আলো ফোঁটার পর প্ল্যাস্টিক ভাঙারি খুঁজতে বেরিয়েছে। কখন ঘরে ফিরতে পারবে জানেন না। তাও দেখুন একটি পুরনো টেলিভিশনের খাঁচা পেয়ে কত খুশি। খাসা দাম মিলবে সে আশায় হাসির ঝিলিক তুলেছে। সে কী আর এখনই জানে না যে ভাঙারির মহাজন তাকে গোটা কয় টাকা গছিয়ে দেবে! দিন শেষে তাকে যা নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে তাতে আর যাই হোক খুশি জুটবে না। 

আপনি হয়তো সেই কেতাবি কথাটাই বলবেন বলবেন, আরে না! এরা নয়। এরা তো অনানুষ্ঠানিক শ্রমিক, মানে হচ্ছে ইনফরমাল ওয়ার্কার। কাজ করলে টাকা পাবে। তা যতক্ষণ করবে ততক্ষণের মজুরি। তাতে দু’টাকা বেশি কামাই করতে দু ঘণ্টা বেশি খাটতে তো হবেই। আর দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, বেশি খাটুনি ছাড়া উপায়ই কী?

তাই যদি হয়, তাহলে আর এত সব অধিকারের কথা বলাই বা কেনো? কিংবা কেনোই ওসব আট ঘণ্টার বিনোদন, আট ঘণ্টা ঘুমের কাসুন্দি। 

কেনো, সেতো জানেই সবাই। সেতো ইতিহাসের অংশ। সেটা ১৮৮৬ সালের গল্প। শিকাগোর হে মার্কেট। সেখানে শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় হলো সংগ্রাম। সে সংগ্রাম যখন উত্তাল হয়ে উঠলো, তাতে হামলা হলো, বোমা ফাটলো, তাতে মৃত্যু হলো পুলিশ-সাধারণ মানুষের। আর তাতে আন্দোলনকারীদের নেতারা ধরা পড়লেন। বিচারের নামে প্রহসন হলো। তাদের ফাঁসি হলো। কিন্তু সে যা কিছুই হোক, ওই আন্দোলন থেকেই মিললো ফল। শ্রমিকের জন্য দিনের আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন, আট ঘণ্টা বিশ্রাম।

১৩৫ বছর আগের ইতিহাস। আজ আর তার কীই বা আছে মানে। এখন এই মাল্টি টাস্কিংয়ের যুগে, কিংবা লং ওয়ার্ক আওয়ারের যুগে ভালো একটু থাকতে হলে এসবই মানতে হবে। সুতরাং অনেকের জন্য কর্মঘণ্টা ১২ থেকে ১৪ হয়ে গেছে। আর যারা করেছেন, তারা তো মনে করছেন এটাই স্বাভাবিক!

এরা তো আর ইনফরমাল শ্রমিক নয়। তারা তো রোজ প্যান্ট-শার্ট পরে, লাঞ্চের ডিব্বা হাতে নিয়েই কাজে যায়। 

বলবেন, আরে না কাজ নয় এরা অফিসে যায়। সেখানে তো আর তপ্ত রোদ নেই। মাথার ওপর পাখা ঘোরে। সেখানে বেশি কাজ করতে অসুবিধে কোথায়। এরা তো শ্রমিক নয়। এরাতো কর্মকর্তা।

তা আর জানি না বুঝি! এদের এই যে কর্মকর্তার তকমা, তাও কিন্তু এদের বঞ্চনারই এক হাতিয়ার। ওই যে কর্মকর্তা হলে তাদের জন্য আর শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে না। তাদের জন্য তৈরি হবে চাকরির আলাদা শর্ত। যখন যেখানে যেমন।

তা সে যে শর্তই হোক না কেনো, সব কিছুরই একটাই লক্ষ্য কিভাবে দু পয়সা কম দিয়ে দু দণ্ড বেশি খাটিয়ে নেওয়া যায়। জানেন তো তৈরি পোশাক কারখানাগুলো আজকাল এসব বেশ চলে। ফলে সেখানে গ্রেড ভেদে শ্রমিকরাই পেয়ে যাচ্ছেন কর্মকর্তার সম্মান। নাম পাচ্ছেন কিন্তু দাম পাচ্ছেন না। 

শুধু তাদের কথাই বলি কেনো? এই যে আমরা সাংবাদিকরা। আমাদের রয়েছে কি কোনো কর্মঘণ্টার বালাই। কোথায় কোন হাউসে শতভাগ মানা হয় শ্রমিকের কর্মঘণ্টার সেই নিয়ম। এটসবই বুঝি মে দিবসের শিক্ষা!

না তা হতে যাবে কেনো? মে দিবস। আমার মহান মে দিবস। এ দিবসকে প্রতিষ্ঠা করতে ফাঁসিতেও ঝুলতে হয়েছে। মে’র প্রথম দিনটিই মে দিবস। আর এর মানে অনেক বেশি বিস্তৃত। এটি হচ্ছে সংগঠিত হবার দিন। যা এর ইতিহাসেই প্রোথিত। অতটা সংগঠিত হতে না পারলে এত বড় আন্দোলন হতে পারতো।

মে দিবস পালনে বিশ্বের দেশে দেশে ভিন্ন রূপ রয়েছে বটে, তবে সব দেশেরই কারণ একটাই, সকলে মিলে শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলার সে দিনটিকে স্মরণ করা।

আমাদের বাংলাদেশ যে বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি, তার পেছনে মে দিবসের চেতনার ভূমিকটাকেই গৌন করে দেখার সুযোগ নেই। আমরা দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো কে স্রেফ শ্রম বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্লোগান হিসেবে দেখিনি। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের হুংকার হিসেবে উচ্চারণ করে যুদ্ধেও ঝাঁপিয়ে পড়েছি। তাতেই আমার এ দেশ কৃষকের শ্রমিকের মজুরের হয়েছে।

ধীরে ধীরে মে দিবস কেবলই শ্রমজীবী মানুষের নয়, রাষ্ট্রের হয়ে উঠেছে। আর সে কারণেই এই দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবেও থাকে নানান কর্মসূচি। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো- দিনটি বিশ্বের দেশে দেশে একটি সাধারণ সরকারি ছুটির দিন। ফলে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমে নিযুক্ত তারা এই দিনটিতে কমবেশি সকলেই ছুটি পান। তবে সত্যি কথা বলতে কি বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা এখনো ৭০ শতাংশ কিংবা তারও বেশি। তাদের জন্য মে দিবসের ছুটি প্রযোজ্য নয়। এই দিন তারা কাজ করলে মজুরি পাবেন, কাজ না করলে কেউ কেউ হয়তো সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতেও পারবেন না। সুতরাং কাজে তাকে যেতেই হবে। আর তাই তার কাছে মে দিবস স্রেফ গ্রীষ্মের এক তপ্ত রোদের দিন।

আর করোনা ভাইরাসের এই মহামারি কালে কাজহীন, রোজগারহীন একটি দিন। শ্রমিক যে যতই কষ্ট হোক কাজ চায়। কাজ হলেই তার মজুরি মেলে, দু বেলা দু মুঠো অন্ন মেলে। সুতরাং এবারের দাবি- না দাও অধিকার না দাও ন্যয্য মজুরি কাজ চাই কাজ দাও।