অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ফ্যান্টাসি কফিন

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ০৯:৪১ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০৯:৪৩ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

বিমান, মোবাইল ফোন, মোরগ, সিংহ, চিতাবাঘ, ঈগল পাখি, হাঙ্গর, মাছ, পিঁয়াজ, গরু, কাঁকড়া, টয়োটা প্রাইভেট গাড়ি, বোট, ট্রাক ইত্যাদি কাঠ দিয়ে বানানো আর রঙ করা। প্রথম দেখায় ওগুলোকে মনে হবে ওগুলো বুঝি খেলনা। জী না। চোখ কপালে উঠে যায় শুনলে। খেলনার আদলে ওগুলো আসলে কফিন। মরা মানুষ রাখা হয় ওগুলোর মধ্যে। তারপর মাটির নিচে কবর দেয়া হয়। শুনতে অদ্ভূত মনে হলেও এটাই সত্যি।

ঘানার জেলে পাড়া-গ্রাম ওশিয়েনে মানুষের মৃত্যুর পর তার লাশ এ ধরনের অদ্ভূত কফিনে রেখে দেওয়া হয় কয়েক দিন। তারপর নিজস্ব নিয়মে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বা দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হয়। জেলেদের সর্দার নুনু’র কথাই ধরা যাক। লোকটা মারা যাওয়ার পর তার আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবরা তাকে মাছের কফিনে করে কবর দিয়েছে। নুনু’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অন্তত দু’হাজার লোক হয়েছিলো। শুধু জেলে গ্রাম ওশিয়েন নয়, ঘানার বেশ কিছু  গ্রাম ও শহরে এ ধরনের বিচিত্র কফিনে পুরে লাশ কবর দেওয়া হয়। আর কাকে কোন কফিনে কবর দেওয়া হবে, তা ঠিক করা হয় তার পেশা, গোষ্ঠী বা বংশ মর্যাদা দেখে আগে ভাগেই। 

ঈগল আকারের কফিনে শুধু প্রধান দলপতিরই কবর হবে আর কারও নয়। কৃষক বা চাষা ভুষো শ্রেনীর পছন্দ পিঁয়াজ বা গরু মার্কা কফিন। কোন কোন ইলেকট্রিশিয়ান, কারিগরি মিস্ত্রি, কামার- কাঁকড়া বা মোবাইল ফোনের কফিনে শুয়ে কবরে যেতে পছন্দ করে। কারণ ওটাই তার বংশ মর্যাদার প্রতীক। আবার গাড়ির মেকানিক আশা করে তাকে টয়োটা করোলা হান্ড্রেড প্রাইভেট কারের কফিনে বা বিমানের কফিনে কবর দেওয়া হবে। জেলেদের পছন্দের কফিন হলো মাছ বা গলদা চিংড়ি। এরকম নানা ধরনের কফিনে পুরে মৃতদের কবর দেয় ঘানাবাসী। তবে মোবাইল ফোন, প্রাইভেট কার, মাছ, কাঁকড়া, পশু-পাখি ও বিমানের এসব বিচিত্র কফিনের বেশ চাহিদা ঘানায়। 

ওদিকে ইউরোপ আমেরিকার জাদুঘরে এসব কফিন প্রদর্শনের কফিন কিনে নিয়ে সাজানো হয় গ্যালারিতে। তবে সবগুলো কফিনের দাম খুব চড়া। গড়ে চার’শ মার্কিন ডলার একেকটার দাম। যা ঘানার মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয়ের সমান। অনেকে আত্মীয় বা বন্ধুর জন্য কফিন কিনতে সারজীবনের সঞ্চয় খরচ করে ফেলে। অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়ায় ভালো কফিনে ভালো মর্যাদা পাওয়ার জন্য নিজের উপার্জনের একটা বৃহৎ অংশ সঞ্চয় করে কেউ কেউ। অবশ্য দাম ওঠানামাও করে। কফিনের নকশা, কাঠের ধরন, দৈর্ঘ্য প্রস্থ ইত্যাদির কতটুকু কী হবে তার ওপর নির্ভর করে দাম। কফিন বানানোর জন্য আগে-ভাগে কারিগরকে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। 

ঘানার বিচিত্র এই কফিন তৈরি কারিগর রয়েছে এখন মাত্র কয়েকজন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে নুগুয়া শহরের জোসেফ টেটেথ আশং ওরফে পা জো। পা জো কফিন তৈরি শিখেছে তার চাচা সেথ কেন কুইর এর কাছ থেকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেথ কেন কুইর কফিন বানিয়ে বিক্রি করে গেছেন। বর্তমানে পা জো বছরে দশটি কফিন বানাতে পারে। এসব কফিনে মৃতদেহ মোটমুটি মাস খানেক রাখা যায়। এতো খাটা খাটুনি করে এত সুন্দর করে কফিন তৈরি করে পা জো। অথচ শেষ পর্যন্ত সবগুলোর আশ্রয় ঘটে সাড়ে তিনহাত মাটির নীচে। 

নিজের গড়া এমন সুন্দর শিল্প কর্মের এহেন করুণ দশা দেখে কষ্ট হয় না পা জোর? এ প্রশ্নের জবাবে পা জো বলেন, প্রদর্শনীর জন্য কফিনগুলো কিছুদিন বাইরে রাখা হয়। ওই সময়টা কফিনগুলো মানুষ দেখে যায়। মানুষ অবাক হয়। ভালো বলে। তখনই উপযুক্ত মর্যাদা পায় শিল্পকর্ম। তবে ব্যবহার হওয়ার পর ওগুলোর আর কোন মূল্য থাকে না। তখন কফিনগুলো উপযুক্ত আশ্রয় তো মাটির নিচেই হওয়া উচিত, তাই নয় কি? 

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।