মিষ্টি মেয়েটি ছিলেন অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা
ফারুক ওয়াহিদ, মুক্তিযোদ্ধা
প্রকাশিত: ০৭:১৮ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার আপডেট: ০৭:১৯ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার
‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত উজ্জ্বল নক্ষত্র কবরী কি শুধু একজন বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নায়িকা? উত্তরে যদি শুধু ‘হ্যাঁ’ বলি তাহলে আমি বলবো উত্তরটি শতভাগ সঠিক হয়নি। সদ্য প্রয়াত মিনা পাল থেকে কবরী সারওয়ার থেকে সারাহ বেগম কবরীর গল্পে গর্বিত হওয়ার রয়েছে আরও অনেক উপখ্যান। তিনি ছিলেন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার অপরাধে কবরীকে জীবিত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পুরস্কার ঘোষণা করেছিলো, সে গল্পটাই আপনাদের শোনাবো।
পাবনার মেয়ে কিংবদন্তী মহানায়িকা সুচিত্রা সেনকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি কিন্তু চট্টগ্রামের মেয়ে কবরীকে ঠিকই পেয়েছি। বীর চট্টলার মেয়ে কবরী ছিলেন আরেক বীর চট্টলার অগ্নিকন্যা বিপ্লবী প্রীতিলতা ও বীর চট্টলার অগ্নিকন্যা বিপ্লবী কল্পনা দত্তের অনুসারী।
কবরীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। মুক্তিযুদ্ধে ছিলো কবরীর বিশেষ অবদান- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ১৯ এপ্রিল পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকা থেকে প্রথমে গ্রামের বাড়ি এবং পরে সেখান থেকে ভারতে পাড়ি জমান তিনি।
বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জমমত তৈরি, অর্থ ও পোশাক সংগ্রহ করতেন। সে সময় ভারতের ‘আকাশবাণী'তে কবরী বিশ্ববাসীর উদ্দেশে একটি আবেগঘন ভাষণ দিয়েছিলেন। যা মাঝেমধ্যেই ‘আকাশবাণী'তে বাজানো হতো। এই ভাষণ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, দেশের মানুষসহ বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যায়। রণাঙ্গনের সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি নিজেও অনেকবার শুনেছি কবরীর সেই হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা।
একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে কবরী নিজেই বলেছিলেন- “বাবা, মা, ভাই-বোন, সম্পদ, লোভ-লালসা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে আমি ভাষণ দিয়েছিলাম এবং জনসম্মুখে কাঁদছিলাম এ জন্য যে পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে হত্যা-নির্যাতন চালাচ্ছিল আমাদের দেশের মানুষের উপর তার হাত থেকে যেন আমার দেশের মানুষ অতি দ্রুত রক্ষা পায়। সে জন্য আমি মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে যে আহ্বান জানিয়েছিলাম তার পরিণতি যে কী হতে পারে তা একবারও আমার মনে আসেনি এবং ভাবার কোনো অবকাশও ছিল না।”
সাক্ষাৎকারে কবরী নিজেই সে সময়ের একটি স্মৃতি তুলে ধরে কবরী আরো বলেছিলেন, “সেখানে একটি অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে আমি তুলে ধরি, কীভাবে আমি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে একেবারে কপর্দকহীন অবস্থায় সেখানে পালিয়ে যাই। সেটা বলতে বলতে আমি বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন করি, আমার দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য, আমার মা-বোনকে বাঁচানোর জন্য। তারপর আমি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞানহারা হয়ে পড়ি। আর কিছুই জানি না।” এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, “দেশের জন্য লড়াই করতে পেরেছিলাম বলে আমি গর্ববোধ করি৷ এ ছাড়া আমার দুই ছোট্ট শিশুও সে সময় আমার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী। এটাই আমার সবচেয়ে গর্ব ও সার্থকতার বিষয়।”
‘আকাশবাণী'তে কবরীর আবেগঘন ও জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার অপরাধে ক্রুদ্ধ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষে কবরীকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করে। পুরস্কারের টাকার অঙ্কটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে তাকে ও সে সময়ের আরেক জাগ্রত কণ্ঠ- স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আব্দুল জব্বারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য জারি হয়েছিলো এই হুলিয়া।
কবরী সে সময়ে ভারতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে পয়সা সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, আর অন্যদের কেউ কেউ বাঙালি ললনা হয়েও পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে অনুষ্ঠান করে পয়সা কামিয়েছেন নিজের জন্য- এই হলো কবরীর সাথে অন্যদের পার্থক্য।।
একাত্তরে কবরী দুই সন্তান নিয়ে বিরতিহীন টানা তিনদিন তিনরাত হেঁটে রামগড়ের নারায়ণহাটে পৌঁছে তার দেখা হয় যুদ্ধরত আর্মি ক্যাপ্টেন কাদেরের সাথে। ক্যাপ্টেন কাদের কবরীকে সাব্রুম সীমান্ত পার করে নিরাপদে পৌঁছে দেন আগরতলায়। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হলো আগরতলা থেকে ফেরার পথেই শহীদ হন ক্যাপ্টেন কাদের।
১৯ এপ্রিল কবরী আগরতলায় হাজার হাজার শরণার্থীর সাথে গাছের তলে এবং খোলা আকাশের নিচে দুই বাচ্চা নিয়ে আশ্রয় নেন- সে এক করুণ দৃশ্য। আগরতলার যুগান্তর পত্রিকার সংবাদিক অনীল ভট্টাচার্য কবরীকে শরণার্থী ক্যাম্প থেকে তার বাড়িতে নিয়ে যান।
সংবাদিক অনীল ভট্টাচার্যর বাড়িতে ১০-১২ দিন অবস্থান করে চলে কবরী চলে যান কলকাতায়। কলকাতায় আয়োজন করেন ‘জয় জোয়ান নাইট’ নামের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। শ্রীমতি নার্গিস, সুনীল দত্ত, ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, অংশুমান রায়, সলিল চৌধুরীসহ আরো অনেক খ্যাতনামা শিল্পী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এদের নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করেন কবরী সারোয়ার। অনুষ্ঠানে সংগৃহীত টাকা পাঠাতেন তিনি যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে। ভারতের গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে আমি নিজেও ভারতীয় ৯০ রুপী পেয়েছিলাম।
অথচ তখন মাছে-ভাতে ও দুধে-ভাতে বাঙালি শিল্পী হয়েও একজন পশ্চিম পাকিস্তানে দেদারছে গান গেয়েছেন এবং আরকেজন উর্দ্দু সিনেমায় নায়িকা হয়ে অভিনয়ও করেছেন আরেকজন বাঙালি যে ছায়াছবিগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলোতে তখন হাউসফুল যেতো। কবরী না খেয়ে বা আধা পেটে অনুষ্ঠান করে পয়সা সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর অন্যরা বাঙালি হয়েও পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে পয়সা কামিয়েছেন নিজের জন্য- এই হলো কবরীর সাথে অন্য শিল্পীদের পার্থক্য।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অভিযোগে কবরী চৌধুরী ও কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার-কে ১৩ আগস্ট ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঢাকার সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ, অন্যথায় অনুপস্থিতিতে তাদের সামরিক আইনের বিধান অনুযায়ী বিচার করা হবে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্দেশের খবরটি সে সময় প্রকাশিত হয় ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপিতে। সেখবরে বলা হয়- ঢাকা সাব-সেক্টর-১ এর সামরিক আইন উপ-আঞ্চলিক প্রশাসকের জারি করা ওই নির্দেশে ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট সকাল ১০টায় কবরী চৌধুরী ও আব্দুল জব্বারকে তার সামনে হাজির হতে বলা হয়েছিলো। দুজনই তখন চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন শিল্পী। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশির আহমেদ ছিলেন এই নির্দেশদাতা। তাদের দুজনের বিরুদ্ধেই সামরিক আইন অমান্যের অভিযোগ আনা হয়েছিলো, এবং বলা হয়েছিলো নির্ধারিত সময় হাজির হতে না পারলে, তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার প্রক্রিয়া চালানো হবে।
সেটাই হয়েছিল। যতদুর মনে পড়ে এরপর কবরীকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নিয়ে যেতে পারলে পুরষ্কার দেওয়া হবে। কত অংকের পুরস্কার সেটি ছিলো তা এখন মনে করতে পারছি না, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারি কবরী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহদাতা হিসেবে পাকিস্তান সামরিক জান্তার কাছে বিপজ্জনকই হয়ে উঠেছিলেন।