ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
ওমর, দ্য টেন্টমেকার। অনুবাদ: কবির চান্দ । মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-সাত]
প্রকাশিত: ১২:১৯ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০২১ রোববার আপডেট: ০৭:৪৩ পিএম, ১২ মে ২০২১ বুধবার
ওমর, দ্য টেন্ট মেকার
সাত. উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকারী
উজির নিজাম-উল-মুলক কুড়ি বছর আগে করা প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। তিনি হাসান বিন সাবাহকে সুলতানের নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তার জন্য সুপারিশ করে পতাকাবাহকের মত গুরুত্বপূর্ণ ও লোভনীয় পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ভালোমত কাজ দেখাতে পারলে আরও বড় পদে নিয়োগের সুযোগও মিলতে পারে। তিনি সাবাহকে মানানসই পোষাকপরিচ্ছদ আর বেশ বড় অঙ্কের স্বর্ণমুদ্রাও দিয়েছিলেন। এতকিছুর পরও কেউ যদি বলে যে উজির ঠিকমতো ব্যবহার দেখাননি তাহলে তাকে বদমেজাজি আর অকৃতজ্ঞ বলতে হবে।
কিন্তু হাসান বিন সাবাহ ছিল মাত্রাতিরিক্ত রকমের স্বার্থপর আর উচ্চাভিলাষী। মিশরে থাকার সময় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে সে এমনভাবে প্রস্তুত করেছিল যেন প্রাচ্যজগতে ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে পারে। তার যথেষ্ট পড়াশুনাও ছিল। সে মালিকশাহকে বলল,
“ছেলেবেলা থেকে, এমনকি সাত বছর বয়স থেকেই আমার সমস্ত চেষ্টা ছিল জ্ঞান অর্জন করা।”
মার্ভের চেয়ে নিশাপুরের আবহাওয়া ভালো ছিল। পাহাড়ঘেরা এই উপত্যকার গ্রীষ্মকালটা সত্যিই আনন্দের। সেজন্যই গরমের দিনগুলো কাটাতে সুলতান এখানে এসেছিলেন। কিন্তু রাজ্য চালনার ব্যাপারগুলোতেও তিনি সমান মনোযোগী ছিলেন। তার সামনে অনেক সমস্যা তুলে ধরা হল। কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পারস্যের উত্তরাঞ্চলে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চান। সম্ভব হলে জয় করতে চান সিরিয়া, কেরমান আর এশিয়া মাইনরের দূরবর্তী প্রদেশগুলোও। তিনি অনেক পরিকল্পনা করতে চান আর সেগুলি বাস্তবায়নে বড় রকমের প্রস্তুতিও নিতে চান। হাসান বিন সাবাহর আগ্রহ দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বরণ করে নিলেন। এমন একজন লোক যে নানা ভাষা জানে আর অনেক দেশ দেখেছে সে তাঁর এই মহাপরিকল্পনায় কাজে আসবে।
হাসানের বলা কিছু ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। তার জীবনের বছর দশেক অস্পষ্টতায় ঢাকা। এ সময়টায় সে মিশর ও স্পেনে গিয়েছিল। তার পিতাও মারা গিয়েছিল, তবে সেটা নিজ গৃহে নয়। এবং তিনি লোকসানের মুখেও পড়েননি। রাজদ্রোহী মোতাজেলা দলের সদস্য ছিলেন বলে শাসকরা তার উপর রুষ্ট ছিল। প্রদেশের শাসনকর্তা আবু মুসলিমকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দিয়ে তিনি রাজরোষ থেকে রক্ষা পান। শেষ জীবনে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে একটি উপাসনালয়ে আশ্রয় নেন এবং বৃদ্ধ বয়সে সেখানেই মারা যান।
দাস হবার যে ঘটনার কথা সে দুই বন্ধুকে বলেছিল সেটাও সত্যি। তবে সে কালক্রম গুলিয়ে ফেলেছিল। এটা নিশ্চয়ই কমপক্ষে ষোলো বছর আগের ঘটনা, কারণ বোরখায় ঢাকা যে মানুষটিকে সে ওমরের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল এবং তার স্ত্রী বলে রেখে এসেছিল, সে আসলে তার ছেলে ওস্তাদ বিন হাসান। ষোলো বছর বয়সী এ তরুণের বুদ্ধি ছিল প্রখর, তবে সেরকম ব্যক্তিত্ব ছিল না। তার মা ছিল একজন ককেশীয় রমণী, যার সাথে পূর্বে বলা বিবরণমতই হাসান বিন সাবাহর দেখা হয়েছিল। ওস্তাদ সম্পূর্ণভাবে পিতার বশীভূত ছিল, এবং সবকিছুতেই তাকে অনুসরণ করত। ঠিক কী কারণে হাসান তাকে নারীর ছদ্মবেশ ধরিয়েছিল এবং ওমরের বাড়িতে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বলা কঠিন। হঠাৎ করে লায়লার অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই সন্দেহের সৃষ্ঠি করবে। কোনোরূপ সংশয়ের উদ্রেক না করিয়ে তা বন্ধুদের কাছে বলাটাও একটা বিরাট সমস্যা যার সমাধান তাকে করতেই হতো। হাসান বিন সাবাহ অবশ্য সবকিছু ভেবেই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। ওস্তাদকে সে নির্দেশ দিয়েছিল ওমরের বাড়ি থেকে চুপি চুপি পালিয়ে গিয়ে আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটা আস্তানায় চলে যেতে। সময় হলে তাকে হাসান তাকে ডেকে পাঠাবে। তার বিশ্বাস ছিল যে রাজসভায় চাকরি জুটবেই। সেটা পেয়ে গেলে ওস্তাদকে নিয়ে আসা হবে। তবে সে যে হাসানের ছেলে রাজসভায় সেটা জানানো হবে না, বরং তাকে পরিচয় করানো হবে তার কিশোর চাকর হিসেবে। আর লায়লার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে সে অনেক উৎসব-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া থেকে রেহাই পাবে, যে সময়টাকে সে নিজ উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যয় করতে পারবে।
এ পর্যন্ত সবকিছুই হাসানের হিসেবমতোই ঘটছিল। সুলতানের কাছাকাছি থাকা যাবে এরকম একটা পদে সে নিয়োগ পেয়েছে। তার কোনো সন্দেহ নেই যে নিজের চিরাচরিত ধূর্ততা দিয়ে সে শীঘ্রই সাম্রাজ্যের শাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে, এবং ইউরোপের না হলেও অন্তত এশিয়ায় মহাদেশীয় বিষয়গুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। সে ভালোই জানত যে অদূর ভবিষ্যতে বড় বড় ঘটনা ঘটতে চলেছে। ইসলামের বিস্তারে আতঙ্কিত খৃষ্টান জগত যে-কোনো সময় প্রাচ্যের ক্ষমতাসীনদের আক্রমণ করতে পারে। আরেক দিকে, ইউরোপের রাজধানীগুলোতে দৃঢ়ভাবে আসন গাড়তে না পারা পর্যন্ত মুসলিমদের বিজয় তরবারিও থামবে বলে মনে হয় না।
শতাব্দীর শেষ দিকে বেঁচে থাকাটা চমৎকার। চমৎকার কোনো একটা নতুন যুগের শেষ বা শুরুতে বেঁচে থাকা। মহাকাল তার কিছু মূহূর্তকে আলাদা করে রেখে দেয়, যখন ঘড়ির কাঁটা নতুন দিনের ধ্বনি শোনায়। মানুষের জীবনের মত এরও যেন চক্র আছে, যা নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে চলে। শতাব্দীর শেষ দিকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলো ঘটে। গড়মাপের চেয়ে বেশি ধী সম্পন্ন মানুষেরা ভাবে যে ক্ষতিকর কিছু জিনিসের পরিবর্তন হওয়া দরকার। হাসান তাদেরই একজন। সে বুঝতে পেরেছিল যে দুনিয়া একটা সঙ্কটের সন্নিকটে। মনের ভেতরের কিছু একটা তাকে বলছিল যে এ কাজে তাকেও অংশ নিতে হবে। কিন্তু ঠিক কী করতে হবে তখনও সে তা বুঝতে পারেনি। তার ভেতরে নবিদের মত অন্তর্দৃষ্টি ছিল না, কিন্তু নিজের ভেতরে সে একটা নতুন মত প্রচারের নিরন্তর তাড়না অনুভব করছিল, যে ব্যবস্থার মধ্য গগণে সে সূর্যের মত দীপ্তি বিলাবে।
তার মনে হল, যে মূহূর্তে উজির তাকে এত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে, তখনই তার যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ ঘটেছে। এরপর তাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বসন সজ্জিত করানোটা দ্বিতীয় আর সুলতানের সামনে আনত হয়ে মাটিকে চুম্বন করাটা তৃতীয় পদক্ষেপ। এইভাবে শুরু হওয়া যাত্রাটা প্রথম দিনেই এতদূর এগিয়ে গেল যে সে প্রাসাদেই থাকার কক্ষ পেল আর উপদেষ্টাদের একজন হিসেবে গণ্য হল। দ্বিতীয় দিনে সে নীরবে তার ছেলে ওস্তাদকে নিয়ে এল, আর নিজের কক্ষের কাছাকাছি তার থাকার ব্যবস্থা করল। ওস্তাদ তখন হালকাপাতলা গড়নের কিশোর, অত্যন্ত শান্ত আর নিভৃতচারী। সময়ের তুলনায় তার হাব-ভাব অনেক ভারিক্কি। তার চেপে রাখা ঠোঁটের বঙ্কিম কোণে বা চোখের বিষণ্ন মণিতে হাসির লেশমাত্র দেখা যেত না। কী এমন ঘটেছে যা যৌবনের সবল চাপল্যকে এত অল্প বয়সেই দমিয়ে দিয়েছে? কোন কালো দিগন্ত এসে তার সামনে পর্দা টেনে দিয়েছে, যার ফলে কয়লার মত কালো আর ঘন চুলে ঢাকা কপাল থেকে সূর্যের ঝলমলে আলো চিরতরে বিদায় নিয়েছে? পিতার কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিত্ব কি তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে? তার রক্তে কোন বংশীয় বন্যতা বইছে বা তার রহস্যময় আত্মার অন্তরালে উত্তরাধিকারের কোন প্রভাব বইছে তা বলা কঠিন। সে ছিল আনুগত্যের প্রতিমূর্তি। তার পিতা কেবল একটু নেত্রপাত করলেই বাঘ যেমন করে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমন করে সে কাজে নেমে পড়ত। চুম্বক থেকে চুম্বকে তড়িৎপ্রবাহের মত তার ছিল একেবারে গাণিতিক ছকে বাঁধা মন, যা চট করে সোজাসাপ্টা সিদ্ধান্ত টানত। কথা বলত খুব কম। সে পিতার কাছ থেকেই এ বৈশিষ্ট্য পেয়েছিল, যে তাকে কঠিন ও ভয়ানকভাবে তৈরি করেছিল। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও সে ব্যবহারিক বিষয়াদি দাড়ি পেকেছে এমন অনেকের চেয়ে বেশি বুঝত। হাসান জানত যে ছেলে মনে প্রাণে তার উদ্দেশ্য সাধনে নিয়োজিত, আর তার ভক্তি ইস্পাতের মতই খাঁটি। সে সুলতানের রাজসভায় এমন সহজাতভাবে জায়গা করে নিল যেন সারাজীবন সে সেখানেই কাজ করেছে। কিশোর সেবকের নাম জিজ্ঞেস করা হলে হাসান তাকে পরিচয় করিয়ে দিল ওস্তাদ ইবনে আলি আল কুফা। বলল যে ছেলেটি আরব বংশীয় এবং অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
নিজাম-উল-মুলক বেশ সকাল সকাল হাসানের সঙ্গে দেখা করতে এলেন আর তার সঙ্গে নদীর ধারে ওমরের গ্রীষ্মকালীন নিবাসে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু হাসান বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করল, বলল যে সেদিন যেহেতু তার নতুন চাকরির প্রথম দিন, আনন্দ ভ্রমণে যাওয়া ঠিক হবে না। উজির জবাব দিলেন যে সেদিন তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই, তবে কোনো অসুবিধা থাকলে না গেলেও চলবে।
হাসান বুঝতে পারল যে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আর যাই হোক পিছিয়ে আসার পাত্র সে নয়। সে শুধু বলল, হে সাম্রাজ্যের প্রতাপান্বিত নিয়ন্ত্রণকর্তা, আমি আপনার সঙ্গে যাবার জন্য পাগল, কিন্তু মাসের শুরু থেকে আমি কেবল ভ্রমণের উপরই আছি। এই মূহুর্তে বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের চেয়েও একটু বিশ্রাম আমার বেশি প্রয়োজন। আরেকদিন অবশ্যই ওমরের কাছে যাব আর গোলাপকুঁড়ির সুঘ্রাণ নেব। আমি বন্ধুত্বের অত্যন্ত মর্যাদা দেই কিন্তু আজকে আমাকে ক্ষমা করতে হবে।”
অজুহাতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, কাজেই উজির খোলা মনেই হাসানের কথা মেনে নিলেন। কিন্তু তিনিও কম ধূর্ত ছিলেন না। তিনি আপনমনে একথাও ভাবলেন, “মনে হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই সাবধান থাকতে হবে, যেন আচমকা কোনো ঘটনার সম্মুখীন হতে না হয়। হাসান যেন কূয়ার মতই গভীর, কিন্তু গর্তের তলার অন্ধকারে সত্য থাকে না। আমি তার দাবি মোতাবেক প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। তবে তার ওপর চোখ রাখতে হবে।” আর প্রকাশ্যে বললেন, “তোমার ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয় এরকম কিছু চাওয়া থেকে আল্লাহ আমাকে বিরত রাখুন। সাতদিনের সপ্তাহের একদিন কাজ না করলেও চলবে। বিশ্রাম নাও। আল্লাহ তোমার নতুন দায়িত্ব, তোমার আর তোমার সবকিছুর উপর প্রসন্ন থাকুন।”
দুজনের সাক্ষাৎ এখানেই শেষ হল। নিজাম-উল-মুলক ঘোড়ায় চড়ে জ্যোতির্বিদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন আর হাসান গেলেন ছেলের খোঁজ করতে।
পরের পর্ব: আট. কবির শিক্ষাজীবন
[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ] [কিস্তি-৫: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী] [ছয়. প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ]