অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সেকালের হালহালুটি ও আমাদের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান, শব্দভাণ্ডার

মুহম্মদ মুহসিন, শিক্ষক ও লেখক

প্রকাশিত: ০৬:০০ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ০৬:০৪ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার

সেকালের হালহালুটি, মুহম্মদ মুহসিন

সেকালের হালহালুটি, মুহম্মদ মুহসিন

ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার এক চাষা পরিবারের সন্তান আমি। জমিজমা বেশি ছিল না, কিন্তু বারো মাস চাষবাস ছিল। তবে এখন যখন বাড়িতে যাই মাঝে মাঝে দেখি চাষবাসে আমার যে এলেম-কালাম তার অনেকখানিই অচল হয়ে গিয়েছে। এমনকি তার কিছু বিষয়াদি এখনকার এলেমদার চাষীদের অনেকের কাছে পুরো গ্রিক-ল্যাটিনের মতো অবোধ্য-দুর্বোধ্য হয়ে গিয়েছে। মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধানে পুরো সচল একটি জ্ঞানকা- এমন হঠাৎ মরে যাবে ভাবতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। তাই পেশায় মাস্টার বলেই হয়তো মনে হলো আমার সেই এলেমকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কাগজ-কলমে মমি করে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেই ভাবনা থেকেই আমার ছোটবেলার হালহালুটি বিষয়ক জ্ঞানকা-টির এই বয়ান ও টীকাভাষ্যের আয়োজন।

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি বছর-মাস পাল্টায় ক্ষেতে-খালে, মাঠে-ময়দানে আর গাছ-গাছালি-লতাপাতায়; আজকের মতো ডায়েরি আর ক্যালেন্ডারের পাতায় নয়। সেগুলো ছিল অবশ্য আমাদের দেশি মাস ও বছর, ইংরেজি বা আরবি নয়। আমরা বুঝতাম শুকনো মাঠগুলোয় পানি উঠতে শুরু করেছে মানে হলো নতুন আবাদের মৌসুম শুরু হয়েছে, অর্থাৎ আমাদের দেশি মাস বৈশাখ শুরু হয়েছে এবং আমাদের নতুন বাংলা বছর শুরু হয়েছে। বছর শুরু মানে নতুন আবাদের মৌসুম শুরু। আবাদি কর্মকা-ের সাথে জড়িত এই বাংলা মাসগুলো ছিল এক অর্থে চাষবাসের কর্মপ্রক্রিয়া কতদূর এগিয়েছে এবং তৎমুহূর্তে কী করণীয় তার নির্ণায়ক ও সূচক।

তাই বাংলা মাসের দিনক্ষণের দিকে তাকিয়ে তখনকার দিনে আমরা আমাদের ক্ষেতখামারের করণীয় ঠিক করতাম। চৈত্র শুরুর প্রাক্কালেই, মাঘ সংক্রান্তিতে অর্থাৎ মাঘ মাসের শেষ দিনে যে দিনকে আমরা বলতাম মাঘের হারহৈন দিন, সেই দিনেই আমাদের মানসিক প্রস্তুতি শুরু হতো নতুন বছরের চাষের কর্মপ্রক্রিয়ার। ঐদিন আমরা ফুলে প্রায় গোল হয়ে উঠা চিতই পিঠা খাওয়াতাম আমাদের হালের গরুগুলোকে। কারণ, আমাদের বিশ^াস ছিল মাঘের হারহৈন দিনে এইভাবে পিঠা খাওয়ালে পরবর্তী কদিনে ঘাস খেয়ে বৈশাখের হাল জোড়ার আগেই গরুগুলো ঐরকম ফুলে ওঠা চিতই পিঠার মতো স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠবে এবং হাল টানার জন্য যোগ্য হয়ে উঠবে। 

চৈত্রের শেষ দিকে ধানচাষের ক্ষেতগুলোর সাথে সংযোগের সকল খালের বাঁধগুলো আমরা কেটে দিতাম। উল্লেখ্য যে ঐ বাঁধগুলো আমরা দিয়েছিলাম অগ্রহায়ণ মাসে যাতে পরবর্তী তিনমাস যাবৎ ধানের জমিতে পানি না উঠতে পারে এবং ধানের খড়গুলো নষ্ট না হতে পারে এবং ধানের জমিতে যে কলাই বোনা হয়েছে তা নষ্ট না হতে পারে। অবশ্য আশির দশকে আমাদের অঞ্চলে অর্থহীন কিছু স্লুইসগেট তৈরি হয়। এই স্লুইস গেটগুলোর বদৌলতে খালগুলো সবরকম ¯্রােত হারায় এবং লাভের মধ্যে আমরা দেখতে পাই যে আমাদের খালগুলোয় বাঁধ দেয়া ও কাটার যে প্রয়োজন উপরে বললাম সেই প্রয়োজনটুকু ফুরিয়ে গিয়েছে। অবশ্য প্রায় নব্বই দশকের শুরু পর্যন্ত ঐ বাঁধগুলো আমাদেরকে দিতে হয়েছে এবং চৈত্রের শেষ দিকে কাটতে হয়েছে।

চৈত্রের বাঁধ কাটার সাথে বাড়ির পাশের ‘ঝোর’ (নালা) ও ডোবাগুলো পানিতে ভরে গেলে সেই ‘ঝোর’ বা ডোবার পানি ‘ডুরি’ (সেঁওতি) মেরে তুলে সেই সিঞ্চিত পানি দিয়ে পাশের জমিতে আউশের বীজ বোনা হতো আউশের চারা তৈরির জন্য। উল্লেখ্য যে, ধানের চারাকে আমরা বীজ বলতাম আর ধানের বীজকে বলতাম বীজধান। বীজধানের অঙ্কুরায়ন প্রক্রিয়াটি ছিল আমার কাছে বিস্ময়কর এক বিষয়। গোবরে লেপা নয় কিংবা গাব-কুঁড়োয় লেপা নয় এমন বাঁশের ‘হাজি’তে (সাঁঝি) বীজধানের মোড়ক বাঁধা হতো সাঁঝির উপরে কলাপাতা বা শটিপাতার স্তর বিছিয়ে। আবার বাঁশের সাঁঝি ছাড়া শুধু কলাপাতা বা শটিপাতা দিয়ে মোড়ক বানিয়ে তাতেও বীজধান বাঁধা যেতো। কলাপাতা বা শটিপাতা দিয়ে মোড়ক বানানোর ক্ষেত্রে বুক-চেঁছে-তোলা কলার খোল দিয়ে বৃত্তের ব্যাসের মতো গোল কাঠামো বানানো হতো। এরপর কলার খোলের উক্ত কাঠামোর নিচে কলাপাতা বা শটিপাতা বিছিয়ে তার উপর ধান দিয়ে উপরে কলাপাতা বা শটিপাতা দিয়ে আবার ঢেকে দেয়া হতো। মোড়কটি সুপারির খোলের রশি দিয়ে গ্লোবের উপরের দ্রাঘিমা রেখার মতো করে এত সংখ্যক রশি দিয়ে বাঁধা হতো যে বৃত্তাকার মোড়কের নিরক্ষ বরাবর এক বাঁধের রশি থেকে আরেক বাঁধের রশির দূরত্ব এক ইঞ্চির বেশি হতো না। 

বীজধান এভাবে মোড়কে বাঁধার পরে মোড়কটি ১২ঘণ্টা পুকুরে ভিজিয়ে রাখা হতো। ১২ ঘণ্টা পরে উঠিয়ে দুই দিন দুই রাত ঘরের কোণে শুকনো স্থানে রেখে দেয়া হতো যাকে আমরা বলতাম ‘হুগনা উপাস’। ১২ ঘণ্টার ‘হুগনা উপাস’-এর পরে ১ ঘণ্টার জন্য বীজধানের মোড়কটি আবার পানিতে ভেজানো হতো। এক ঘণ্টা ভেজানোর এই প্রক্রিয়াকে আমরা বলতাম ‘ভুরভুরি’ দেয়া। ‘ভুরভুরি’ দিয়ে ওঠানোর পরের দিন মোড়কটি খোলা হতো। তখন দেখা যেত মোড়কের পাশ বেয়ে ধানের অঙ্কুরের এক ধবধবে সাদা স্তর তৈরি হয়ে গিয়েছে। আমরা এই অঙ্কুরকে বলতাম ‘কোন্ডা’। মোড়কটি যদি বাঁশের সাঁঝির না হয়ে সম্পূর্ণরূপে কলা বা শটিপাতার তৈরি হতো তাহলে মোড়কটি হালকা করে কেটে খুলে নেয়ার পরে দেখা যেত পাশাপাশি ‘কোন্ডা’য় অর্থাৎ অঙ্কুরে জড়িয়ে ধানগুলো মোড়কে যেভাবে রাখা ছিল সেই আকারে একটি শক্ত চাকায় পরিণত হয়েছে আর তার পাশে রয়েছে ধানের সাদা অঙ্কুরের এমন এক নিñিদ্র স্তর যে, অঙ্কুরের স্তর ভেদ করে ভিতরের ধানগুলো দেখাই যায় না। তখন আমাদের এমন ক্যামেরাওয়ালা সস্তা মোবাইল সেট ছিল না যে ধানের অঙ্কুরায়নের এই চমৎকার দৃশ্যটির একটি ছবি তুলে রাখবো। রাখতে পারিনি। সম্প্রতি ধানের অঙ্কুরায়নের এমন কোনো দৃশ্য গুগলে বা ইউটিউবে আছে কিনা দেখতে অনেক খুঁজেছি। ওরকম কিছুই পাইনি। 

অঙ্কুরে জড়ানো ধানের চাকাটি এরপর আমাদের মতো ছোটদের কাছে দেয়া হতো আলতো করে অঙ্কুরের জট ছাড়িয়ে ধানগুলো ঝুরঝুরে করার জন্য। ঝুরঝুরে করার সময় আমাদেরকে বার বার সতর্ক করা হতো যাতে ‘কোন্ডা’ (অঙ্কুর) ভেঙ্গে না যায়। ঝুরঝুরে অঙ্কুরের ধানগুলো এরপর বীজতলায় ছিটিয়ে দেয়া হতো। ধানের চারা তৈরির বীজতলাটি চাষের ক্ষেত্রে সর্বদা খেয়াল রাখা হতো যাতে উপরে নরম কাদার একটি স্তর তৈরি হয়। অঙ্কুরায়িত ধান ছিটানোর পরে ঐ নরম কাদার উপরে কলাপাতায় তৈরি একটি মইয়ের মতো বস্তু ক্ষেতের উপর দিয়ে হালকা করে টানা হতো যাতে অঙ্কুরায়িত ধানগুলো কাদার সামান্য ভিতরে চলে যায় এবং পাখি খেয়ে ফেলতে না পারে। কলাপাতার এই মইকে আমরা বলতাম ‘পাউত্যা’ এবং এই কাজটিকে বলতাম পাউত্যা দেয়া বা পাউত্যা টানা।
 
চৈত্রের শেষ দিকে আউশের এই বীজ বোনার পরে বৈশাখের প্রথম দিন শুরু হতো আউশের বীজ রোপনের ক্ষেত তৈরির কাজ। ততদিনে পুরো ধানের ক্ষেত যাকে আমরা ‘কোলা’ বলি তা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যেতো। আউশ ধানের ক্ষেত তৈরিতে জমিতে ‘দোছা’ দিয়ে প্রথম মই দেয়া হতো। ‘দোছা’ হলো ক্ষেতের পুরো জমিটুকু দুইবার গরুতে-টানা লাঙল দিয়ে চষার নাম। পুরো জমিটুকু প্রথমবার লাঙল দিয়ে চষাকে আমরা বলতাম ‘ভাঙ্গা’। ‘ভাঙ্গা’র পরে আরেকবার পুরো জমিটুকু লাঙ্গল দিয়ে চষাকে বলা হতো ‘দোছা’। জমি শক্ত হলে অর্থাৎ জমি পানিতে খুব নরম না হয়ে থাকলে মই দেয়ার পূর্বে আরো একবার পুরো জমি লাঙল দিয়ে চষা হতো। তৃতীয়বার এইভাবে লাঙল দেয়াকে বলা হতো ‘তেছা’। ‘দোছা’ বা ‘তেছা’র পরে প্রথম মই দেয়া হলে এই ‘দোছা’ বা ‘তেছা’সহ একবার মই দেয়ার কাজকে বলা হতো এক চাষ। একচাষে আউশ ধানের ক্ষেত তৈরি হতো না। তবে আমন ধানের ক্ষেত এক চাষেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তৈরি হতো। আউশ ধানের ক্ষেতের ক্ষেত্রে অন্তত দুই চাষ দরকার হতো। দ্বিতীয় চাষে একবার লাঙল টেনেই মই দেয়া হতো, তখন আর ‘ভাঙ্গা’র প্রসঙ্গ থাকতো না। সাধারণত দুই চাষে আউশ ধানের ক্ষেত তৈরি হতো।
 
এভাবে তৈরি জমিতে বৈশাখের ১৫ তারিখ থেকে জ্যৈষ্ঠের ১৫ তারিখের মধ্যে আউশ ধানের চারা রোপন করা হতো। রোপনের পরে আউশের ক্ষেতে দিন দিন পানি বাড়তে থাকতো আর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকতো আউশ ধানের চারা। এই সময় জমিতে প্রচুর পানি থাকতো বিধায় কোনো প্রকার আগাছা জমিতে জন্মাতো না। ফলে জমি নিড়ানো বা সার দেয়ার মতো কোনো কাজ আউশ ধানের ক্ষেতে চাষীদের আর থাকতো না। আউশ ধানের ক্ষেতে আমাদের পরবর্তী কাজ হতো শ্রাবণের ১৫ তারিখের দিকে ধান পাকলে পাকা ধান শুধু কেটে আনা। আউশ ধানের ক্ষেতে কোমর পরিমাণ বা তার বেশি পানি থাকলে আমরা নৌকায় বসে পানির উপর থেকে টেনে টেনে পাকা আউশের শীষগুলো কাটতাম।

যে-সব জমিতে বেশি পানি হতো সেগুলোয় আউশের পরিবর্তে বপন করা হতো ‘পঞ্চরতœ’ নামে এক ধরনের ধান। এই ধানের চারা আলাদা বীজতলায় তৈরি না করে সরাসরি অঙ্কুরায়িত ধান ক্ষেতে বুনে দেয়া হতো। এই ধানের গাছগুলো অত্যন্ত শক্ত হতো। ফলে অনেক পানিতেও এর মাথাগুলো পানির ওপর শুয়ে পড়তো না, উপরে জেগে থাকতো। তাই বেশি পানির জমিতে এ ছাড়া অন্য ধানের চাষ করে পাকা ধান ঘরে আনার সুযোগ হতো না। আউশের সাথে ‘পঞ্চরতœ’ ছাড়া আরো দুটি ধানের চাষ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। একটির নাম ‘হাইড্যা’, অপরটি ‘হলোই’। এই প্রকার ধানগুলোও ‘পঞ্চরত্ন’-এর মতো ক্ষেতে সরাসরি বুনে দেয়া হতো। এই ধান বোনার ক্ষেত অবশ্য আউশ ধানের ক্ষেতের মতো করেই তৈরি করা হতো। তবে জমিতে পানি বেশি হওয়ার আগেই এ ধান বুনতে হতো। অন্যথা অঙ্কুরায়িত ধান বেশি পানির জমিতে বুনতে গেলে ধান পানিতে ভেসে যেতো, চারা গজাতো না। তাই বৈশাখের শুরুতেই এ ধান বোনা শেষ করতে হতো। ‘হাইড্যা’ ও ‘হলোই’ ধান পেকে যেত আউশেরও একটু আগে, শ্রাবণের শুরুতেই। তাই আষাঢ়ের পরই নতুন ধানের প্রয়োজন যেসব অনটনের সংসারে খুব বেশি থাকতো সেসব গৃহস্থরা কিছু জমিতে অন্তত ‘হাইড্যা’ বা ‘হলোই’ ধান বুনতো। 

আউশ মৌসুমের সব ধান কাটা শেষ হয়ে যেতো ১০ ভাদ্রের মধ্যে। আউশ ধানের ফলন ভালো হওয়ার মধ্যে আমাদের প্রতি আল্লাহর কোনো রহমত বোঝা যেতো না। আমাদের প্রতি আল্লাহর রহমত আছে কিনা তা বরং নির্ভর করতো ধানগুলো মাড়াই করে শুকিয়ে ঘরে ওঠানোর সুযোগের ওপর। বেশির ভাগই আমরা ধান কেটে ঘরে এনে তা কাজে লাগাতে পারতাম না। শ্রাবণ-ভাদ্র দুই মাস আল্লাহ আমাদের এলাকার সাথে তাঁর মেঘের পানির লাইন ডাইরেক্ট করে দিতেন। সেই ডাইরেক্ট লাইনে দিনের পর দিন আমাদের আকাশখানা মেঘে ছেয়ে থাকতো আর ২৪ ঘণ্টা ঝরতে থাকতো পানি। পানির কারণে বাইরে গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের সুযোগ থাকতো না, আর পা দিয়ে মাড়াই করা ধান সিদ্ধ করা বা শুকানোর সুযোগও থাকতো না। তখনো আমরা ধান মাড়াইয়ের কোনো কল দেখিনি। কৃষিকাজে তখন কল বলতে ছিল শুধু ধান ভানা কল। কল ও গরুতে মাড়াইয়ের সুযোগের অভাবে ধান মাড়াইয়ের একমাত্র প্রক্রিয়া ছিল পায়ের পাতা দড়ি দিয়ে ঘন করে বেঁধে সেই পা দিয়ে ধান ‘মলা’ বা মাড়াই করা। আউশ ধানে জড়িয়ে থাকতো প্রচুর ক্ষুদ্র ধরনের শামুক বা ‘গেঁড়ি’ যাদেরকে আমরা বলতাম ‘লেরি হামুক’। পা দড়ি দিয়ে যতই বাঁধি, পা দিয়ে মলে ধান মাড়াইকালে পায়ের বাঁধা জায়গার পাশে ও গোড়ালিতে এই সকল লেরি হামুকে পা বিক্ষত না হওয়ার কোনো সুযোগ থাকতো না। উপরন্তু আউশ ধানের ক্ষেতে পাঁকে পা ক্ষয় হতে হতে আঙুলের ফান্দিগুলো থেকে প্রায় রক্ত বের হতো বা রক্ত বের হওয়ার উপক্রম হওয়ার অবস্থা থাকতো (পাঁকে পা ক্ষয় হওয়ার এই ঘটনাকে আমরা বলতাম ‘পা প্যাক্কায় খাইছে’)। সেই পা দিয়ে ধান মলার কালে পায়ের ক্ষতের মধ্যে ঢুকে পড়তো আউশ ধানের লম্বা ‘উংগা’ (শুঙ্গ)। সব মিলিয়ে পা দিয়ে আউশ ধান মলার বা মাড়াই করার পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক এক শ্রম।

আউশ ধান নিয়ে আমাদের বেদনার এখানেই ইতি ঘটতো না। এত কষ্টে ও শ্রমে হয়তো বিশ ‘কাডি’ ধান (১ কাডি = প্রায় ২৫ কেজি) মলা হলো। আর এবার শুরু হলো অক্লান্ত বৃষ্টির আসমানি আশীর্বাদ। ধানগুলো আমাদের ছোটঘরের এককোণে প্রায় স্তূপের মতো আকারে বি¯্রস্ত করে রাখা হলো। রোদের অভাবে প্রচ- আর্দ্র আবহাওয়ায় দু’তিন দিনেই হয়তো ধানগুলো থেকে প্রাকপচন-সূচক একধরনের গন্ধ আসতে শুরু করতো যাকে আমরা বলতাম ‘উমলা’ গন্ধ। এই গন্ধ নাকে আসার সাথে সাথে আমার মা-বাবার চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসতো। ঐ ধান বাজারে নিয়ে গেলে কোনো ক্রেতা পাওয়া যাবে না। ঐ ধান থেকে আর কোনো চাল তৈরি করা যাবে না। ঐ ধানের প্রক্রিয়াকরণে তখন আমাদের গৃহস্থ সংসারে ছিল একটাই উপায়, সেটা হলো ‘ওচা’। ওচা মানে হলো ঘরের কোনো কোণে তাফালের মতো বানিয়ে তাতে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে টিনের ডোঙ্গায় করে ধানগুলো নেড়ে নেড়ে আগুনের তাপে শুকানোর চেষ্টা করা। তার জন্য দরকার হতো অনেক কাঠ বা জ¦ালানি যার দাম আষাঢ়-শ্রাবণে অনেক সময় ধানের চেয়েও বেশি হতো। তারপর কাঠ বা জ¦ালানি জোগাড় করে ধানগুলো ওচা সম্ভব হলেও সেই ওচা আউশ ধান ভানলে তা থেকে চাউল পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত কতগুলো খুদ আর কুঁড়া। এইসব মিলে আমরা এমন অবস্থাও দেখেছি যে, আমরা আউশ মৌসুমে হয়তো সত্তুর কাডি ধান ফলাতে পেরেছি, কিন্তু তার ত্রিশ কাডিই হয়তো মলাই-মাড়াই ছাড়া ঘরের বাইরে পচে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছি। বাকি মাড়াই করে ঘরে তুলতে পারা চল্লিশ কাডির বিশ কাডি হয়তো ওচতে হয়েছে, যা থেকে কোনো চাল পাইনি, পেয়েছি খুদ। সবমিলিয়ে দশ কাডির হয়তো চাল করতে পেরেছি। ফলে ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত আমাদের হাঁসমুরগিগুলোর খাবারই ছিল সর্বোত্তম কারণ তাদের জন্য থাকতো আউশের সুস্বাদু কুঁড়ার অফুরান সমৃদ্ধি। আর ঘরের মানুষগুলোর মধ্যে আমার মা-বাবা ও মুরুব্বিদের জন্য বরাদ্দ থাকতো আউশের খুদ- খুদের ভাত, খুদের জাউ আর খুদের লাতা (খুদ সিদ্ধ করে নারিকেলের সাথে মিশিয়ে তেল ছাড়া খোলায় ভেজে বানানো সুস্বাদু এক খাবার)। আর আমরা ছাও-পোনা রূপে যে-কয়টা সন্তান ছিলাম সেইগুলোর জন্য তিনবেলার দুবেলা হয়তো জুটতো আউশের ভাত, বাকি এক বেলা সবার সাথে আমাদেরও খুদের লাতা বা জাউ। অথচ আমরা চাষী ছিলাম, আমরা ধান জন্মাতাম এবং সে ধানের পরিমাণ ছিল আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। তারপরও কপালে ভাত আমাদের জোটেনি, কারণ আমাদের ধানগুলো যাতে সব চাল না হয়ে ওঠে এবং আমাদের ধানগুলো যাতে মৌসুমের সময় ধানের দামে বিক্রি হতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের খোদাতায়ালা এবং আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র প্রায় বছরই যথেষ্ট সজাগ থাকতেন।

আউশের ভাত ও খুদের লাতা যাই হোক তা কিন্তু সর্বতো ধান থেকে নির্গত চাল বা খুদে তৈরি আহার্য ছিল না। তার সাথে অপরিহার্যভাবে মিশ্রিত থাকতো লেরি হামুক অর্থাৎ গেঁড়ির খোল-মাংস নির্গত উপাদান। কোনোরূপ প্রক্রিয়াকরণ দ্বারাই আমাদের সময়ে  আউশ ধানের শরীর থেকে সবরকম লেরি হামুক অপসারণের কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা শামুক খাই না, কখনো খেতাম না একথা হাড়েমাংসে সত্য, আবার গেঁড়ি শামুকের কণা বা আস্ত গেঁড়ি শামুকের উপাদান দুয়েকটি না গিলে আমরা আউশ চাউলের ভাত বা জাউ কিছুই যে কোনোদিন খেয়ে উঠতে পারিনি একথাও হাড়ে হাড়ে সত্য। তবে আজো মনে হয়, ওর মধ্যে শামুকের কণা বা আস্ত লেরি হামুক যাই থাকুক না কেন, এ জগতে সুস্বাদু বস্তু যেটুকু যা এ পর্যন্ত খেতে পেয়েছি তাদের তালিকা করলে গোটা চারেক মাইড্যা কাডালির  ভুনা সহ ঐ আউশ চালের এক বাসন পান্তা ভাত আমি এখনো চোখ বুজে তালিকার প্রথম স্থানে রাখবো। বেহেশতে যদি আউশ ধান মলার এবং ওচার ব্যাপারাদি না থাকে তাহলে মাওলাপাকের কাছে এ আমার স্থায়ী ফরিয়াদ- ‘তুমি আল্লাহ, আমারে বেহেশতে আর কিছু দ্যাও আর না দ্যাও, পেরতেক ব্যানে এ্যাক বাসুন পান্তাভাতের লগে গোডাচাইরে মাইড্যা কাডালি ভুনার ব্যবস্থা হইর‌্যা দিয়ো, আর কিছু লাগবে না’।  

 . মাইড্যা কাডালি হলো এক ধরনের ডিমওয়ালা চিংড়ি যা গলদা চিংড়ির চেয়ে আকারে একটু ছোট। মান ভাষায় এর নাম আমি জানি না।
 . ফ্যানেফ্যানে হলো নারিকেল সহযোগে রান্না করা আউশ চাউলের এক ধরনের ভাত যা প্রায় জাউয়ের মতো পাতলা। ইহাকে স্থানবিশেষে ‘ফেনাফেনা’ও বলে। 
 . আউশ চাউল ভেজে তা চাক-চাক করে কাটা নারিকলে সহযোগে গুড় দিয়ে সিদ্ধ করার মাধ্যমে বিস্কি প্রস্তুত করা হয়।

আউশ ধানের এই সাত কাহন থেকে অবস্থাপন্ন কৃষকদের সংসার অনেকটাই মুক্ত থাকতো। তাঁরা আয়েশ করে চিংড়ি ভর্তা দিয়ে দু’সন্ধ্যা ‘ফ্যানেফ্যানে’  ও শেষ ভাদ্রের অলস সময়ে এক সন্ধ্যা ‘বিস্কি’  খাওয়ার জন্য অল্প জমিতে আউশের চাষ করতেন। প্রকৃতি বিরূপ হলে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে তাঁরা ঐ ধান সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের লড়াইয়ে নামতেন না বরং বড়লোকি উন্নাসিকতায় ঐ ধান জমিতেই পচে যেতে দিতেন। তাঁরা তাঁদের বেশির ভাগ জমি বায়রা রাখতেন অর্থাৎ জমিতে আউশ মৌসুমের চাষ থেকে বিরত থাকতেন। বায়রা জমিতে তাঁরা ভাদ্র মাসের দিকে শুধু আমন ধান চাষ করতেন। আবার কিছু জমিতে আমন আর আউশ এক সাথে চাষের রেওয়াজও আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। এই ঘটনা ঘটতো শুধু বেশি রকম ডরা অর্থাৎ নিচু জমিতে। এই জমিতে বৈশাখের শেষ বা জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই আউশের সাথে লাম নামের এক প্রকার আমন ধান বুনে দেয়া হতো। লাম ধান ছিল দু’প্রকার- ‘ধল কউচ্যা’ ও ‘খলনি’। আউশ ধান যখন পেকে যেতো তখন লাম ধানের চলতো মধ্য যৌবন। তার পাকার সময় আসতো আরো তিন-সাড়ে তিন মাস পরে পৌষে।
 
লাম ছাড়া অন্য প্রকার আমন ধানগুলো ছিল রোপনের; বোনা বা বপনের নয়। অন্যজাতের আমন ধানের চাষের আয়োজন আমরা শুরু করতাম আমাবতীর জোবায়। আমাবতীর জোবা মানে হলো আষাঢ়ের প্রথম জোবা অর্থাৎ আষাঢ়ের প্রথম ভরা কটাল। পঞ্জিকা অনুযায়ী সাধারণত আমাবতী (অমাবতী) তিথি শুরু হতো আষাঢ়ের ৬ষ্ঠ দিনে আর শেষ হতো ৭ম দিনে। আমাদের ছোটবেলায় এই আমাবতীকে জানতাম কৃষি কর্মকা-ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ তিথি হিসেবে। আমরা জানতাম আমাবতী এমন এক তিথি যে তিথিতে কৃষিক্ষেত্রের অনেক কাজ প্রাকৃতিকভাবে সিল করে দেয়া হয়, অর্থাৎ এর পরে আর ঐ কাজে প্রকৃতি অনুমতিই দিবে না। যেমন, এই তিথির পরে খেজুর আর পাকবে না। ফলে এর পরেও কোনো খেজুর গাছে থেকে থাকলে তা আর কোনো প্রক্রিয়ায় পাকানোর চেষ্টা করা বৃথা। আবার কৃষির কিছু কাজ আছে যা এই তিথির আগে শুরু করতেও বাঁধা আছে। যেমন, এই তিথির আগে কোনো আমনের বীজ করতে প্রকৃতির অনুমোদন নেই, অর্থাৎ এই তিথির আগে আমন ধানের বীজ করতে চাইলেও বীজ জন্মাবে না। আমাবতীর পরে কোনো তালের শাঁস আর নরম থাকার সুযোগ নেই। আমাবতীর আগে সব আম ও জাম পেকে যাবেই। কৃষিকর্মধারার সূচক হিসেবে আমরা জানতাম আমাবতীর এমনই সব জহুরা।

আমাবতীর জোবায় অর্থাৎ আষাঢ় মাসের প্রথম ভরা কটালে আমনের প্রথম বীজ বোনা হতো কার্তিক বালাম ধানের। কার্তিক বালাম নামটাই বলে দেয় যে, এটি ছিল কার্তিক মাসে পাকার একটি আমন ধান। কার্তিকের শেষে বা অগ্রহায়ণে এটি পাকতো। এটির চাষ হতো বেশিরভাগ খালের ধারে একটু উঁচু জমিতে যাকে আমরা বলতাম ভিটা। এর চালগুলো হতো হলদে রঙের। ভাতগুলো হতো যেন কাঁচা হলুদে মাখা। এটিই ছিল আমাদের নবান্নের ধান। ভিটার চেয়ে একটু নিচু জমি যাকে আমরা বলতাম ‘কোল ডরা’ সেই জমিতে আমরা যেসব আমন ধান চাষ করতাম সেগুলোর মধ্যে ছিল সীতাভোগ, পাইজাম, বাসফুল, সাক্করখানা, ডিঙ্গামানিক ইত্যাদি। আর পুরো ডরা বা নিচু জমিতে আউশের সাথে লাম বুনে না থাকলে সেখানে আমরা রোপন করতাম কালামোডা, কালঝারা, জামরি মোডা, অইলদা গোডাইল, কমলামোডা, সাদামোডা ইত্যাদি জাতের আমন ধান।
 
আষাঢ়ের আমাবতীতে কার্তিক বালামের বীজ বপনের সপ্তাহখানেক পরেই শুরু হতো অন্যান্য জাতের আমন ধানের বীজ বপনের পালা। আমন ধানের বীজ বপনের স্বাভাবিক বীজতলাই ছিল খালের পাড়ের উঁচু জমি যাকে আমরা বলতাম ভিটা। বীজ বড় হলে শ্রাবণের শেষ থেকে ১৩ই ভাদ্রের আগেই শেষ করা হতো বীজতলা থেকে বীজ তুলে নিয়ে আমনের ক্ষেতে রোপন। আমনের বীজ তুলে নেয়ার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা থেকে আরেকটা নির্দিষ্ট দূরত্বে কিছু বীজ বীজতলায় রেখে যাওয়া হতো এই উদ্দেশ্যে যে ঐ জমিতে নতুন করে ধানের গোছা রোপনের চেয়ে বরং এই বীজগুলোই যাতে বড় হয় এবং ধান জন্মায়। ধানের চারা রোপন না করে বীজতলায় এভাবে চারা রেখে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে আমরা বলতাম ‘পাড়া ভাঙ্গা’। পাড়ায় ধান সবসময়ই রোপা আমনের চেয়ে কম জন্মাতো। তা-ও রোপার জন্য উক্ত জমি পুনরায় চাষ করা, বীজ রোপন করা ইত্যাকার শ্রম থেকে বাঁচা যেতো। 

রোপা আমনের জন্য ডরা জমিগুলোতে খুব বেশি চাষ দিতে হতো না। আগেই বলেছি যে আউশের জমিতে আমরা তিন চাষ দিলেও আমনের ডরা জমিতে এক চাষ দিয়েই আমন রোপন করতে পারতাম। বায়রা জমির জন্য চাষটা একটু বেশি লাগতো। দুই চাষ তো অবশ্যই, এমনকি তিন চাষও লেগে যেতে পারতো। আউশের জমিতে কোনোভাবে আউশের নাড়াগুলো (ধানগাছের নি¤œভাগ) একবার লাঙল দিয়েই মই দিয়ে মাটিতে মিশিয়ে আমনের বীজ (ধানের চারা) রোপন করে দিতাম। ধানের চারা বীজ রোপন করাকে আমরা বলতাম ‘রোয়া’ আর ধানের চারার যে গোছা রোপন করতাম তাকে বলতাম ‘গুছি’। আমাদের একে অপরের জমিগুলো আল দিয়ে আলাদা করা থাকতো না। আমরা যৌথ মালিকানার একসারি ‘গুছি’ দিয়ে পরস্পরের জমির সীমানা চিহ্নিত করতাম। সীমানা চিহ্নিতকরণার্থে এই গুছি দেয়ার কাজকে আমরা বলতাম ‘হাইর দ্যাওয়া’।

আমন ধান রোপনের ক্ষেত্রে এবং আরো কতিপয় কৃষি কর্মকা-ের বিষয়ে আমাদের ছোটবেলায় ১৩ই ভাদ্র তারিখটা ছিল অনেক জহুরার এক জিনিস। লোকবিশ^াসে বা উপাখ্যানে ১৩ ভাদ্রের বিশেষত্ব হলো এই দিনটি হচ্ছে যমরাজার মায়ের ফইত্যা (ফাতেহা = শ্রাদ্ধ) অনুষ্ঠানের দিন। কৃষিকাজের সংশ্লিষ্টতায় আমরা শুনতাম ১৩ ভাদ্র ১৩টা শিকস্তি শুরু হয়। শিকস্তি দ্বারা বোঝানো হতো প্রকৃতির কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন। ১৩টা শিকস্তির সব আজ আর এই মুহূর্তে মনে নেই। যে-কয়টি মনে আছে সেগুলো হলো: ১। ১৩ ভাদ্র গুছিচোরা বইবে, অর্থাৎ ১৩ ভাদ্রের পরে আমন ধান রোপন করলে ধানের গোছাগুলো মোটা ও স্বাস্থ্যবান হয়ে ক্ষেত ভরে উঠবে না, মনে হবে কোনো চোর এসে ক্ষেতের গোছাগুলো চুরি করে নিয়ে গিয়েছে তাই ক্ষেত ধানের গোছায় ভরে যাচ্ছে না। ২। ১৩ই ভাদ্র কুমীরের মুখে খিল পড়বে, অর্থাৎ কুমীর অনেকটা সাপের মতো হাইবারনেশনে চলে যাবে। ৩। ১৩ই ভাদ্র শীতের কাডা বইবে, অর্থাৎ প্রকৃতিতে শীতকালের আয়োজন এই দিন থেকে শুরু হবে। ৪। ১৩ই ভাদ্র কাকের মাথা থেকে লোম খসে যাবে। এই শিকস্তির একটি কার্যকারণগত ব্যাখ্যা আছে। বলা হয়, যমরাজার বাড়িতে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধে কাজের জন্য ডাকা হয় বনের সব পশুপাখি। সেখানে কাকের দায়িত্ব হয় মাথায় করে শ্রাদ্ধের সব দাউর টানা (জ¦ালানি বহন করা)। সেই দাউর টানতে টানতে কাকের মাথা ও শরীর থেকে অনেক লোম খসে যায়। ৫। হডির লগে গুছিচোরায় গলায় দড়ি দেবে, অর্থাৎ ১৩ ভাদ্রের পর থেকে শটি গাছের পাতা মরতে শুরু করবে যেমনটা গুছিচোরা ১৩ ভাদ্রের পরে রোপিত ধানের গোছার ক্ষতি সাধন করে থাকবে। ১৩ই ভাদ্রের এরকম আরো ৭টি শিকস্তি ছোটবেলায় শুনেছি যা আজ আর সব মনে করতে পারছি না।

এ সব শিকস্তির কথা আমরা মেনে চলতাম। তাই আমরা যত কষ্ট হোক ১৩ ভাদ্রের আগেই শেষ করতে চেষ্টা করতাম আমন ধানের রোপন। আমন ধান রোপনের পরে দুমাস ছিল আমাদের কৃষক জীবনের অবসর যাপনের সময়। এসময়ে আমাদের বয়সের গ্রুপটা হাডুডু খেলে কাটাতো আর বড়রা তাস খেলে আর গরুর ঘাস কেটে কাটাতেন। বড়রা আশি^নের শুরুতে মাঝে মাঝে ধানক্ষেতের খবর নিতেন সেখানে গুছিচোরার কারণে গুছিরা (ধানের গোছাগুলো) কতটা হারিয়েছে তা দেখতে। বেশি মাত্রায় হারালে তারা খোজ দিতে নামতেন। খোজ দ্যাওয়া মানে হলো ধানের যে গোছাগুলো মরে গেছে সেই জায়গায় নতুন গোছা রোপন করা। আশি^ন মাসের শেষের দিকে পানি কমে গেলে বিশেষ করে কোল ডরা জমিতে কিছু আগাছা জন্মাতো যেগুলো পরিষ্কার করা প্রয়োজন হতো। সেসব আগাছার মধ্যে বিশেষ করে ছিল ঘন শ্যাওলার স্তর যেগুলোকে আমরা বলতাম কাডাহ্যালা। আরো ছিল বোতল, রানা, চেচড়ি ইত্যাদি জাতীয় আগাছা যাদের মান-ভাষায় কী নাম তা আমি জানি না। 

কম শ্রমের এই আশি^ন ও কার্তিক মাসে একটু পরিশ্রমী কৃষকরা অবশ্য জেলে হয়ে উঠতো। এই সময়ে ঝাকি জালে, বিন্দি জালে, ধর্মজালে, মইয়া জালে এমনকি বাদা জালে পর্যন্ত অনেক কৃষক মাছ ধরতে নেমে যেতেন। এর মধ্যে আমাদের ঘরে ঝাকি জাল ও ধর্মজালের বাইরে কোনো জাল ছিল না। ফলে আশি^ন মাসে আমরা খুব শ্রমী কৃষক বা জেলে কিছুই ছিলাম না। 

আশি^ন মাসটা ঘুমিয়ে, মাছ ধরে আর হাডুডু খেলে পার করার পরে কার্তিক মাসে আবার শুরু হতো আমাদের কাজের জবর মৌসুম। কার্তিকের মাঝামাঝি আমরা বন্ধ করে দিতাম ধানের ক্ষেতগুলোর সাথে সংযোগকারী সকল খাল। খালগুলোর গোড়ায় মাটি কেটে বাঁধ দিয়ে খালগুলোর পানি প্রবাহ বন্ধ করা নিশ্চিত করতাম যাতে খালের জোয়ারের পানি ওঠা বন্ধ হলে ধানের ক্ষেতগুলো শুকানোর সুযোগ পায়। ধানের ক্ষেত না শুকালে আমন ধান ঘরে তোলা খুবই কঠিন। এই বাঁধের উঁচু পাশে পানি জমে থিতিয়ে স্বচ্ছ হয়ে যেত। সেই স্বচ্ছ পানি এলাকার অনেকের শীতকালীন গোসলের একটি পছন্দের স্থান হয়ে উঠতো। ঝুপ করে নেমে ডুবটি দিয়ে উঠে অবারিত সূর্যালোকের ওম নিয়ে ¯œান উপভোগের এমন স্থান আসলেই নস্টালজিক করে তোলে। যাই হোক, এই বাঁধের মাধ্যমে খাল বন্ধ করে পানি ওঠা বন্ধ করার পরপরই ভিটাঘাটার চেয়ে নিচু কিন্তু ‘ডরা’ জমির চেয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু ধানক্ষেতে রোপা ধানের মাঝেই আমরা বুনে দিতাম কলাই ডালের বীজ, যা খেসারি ডাল নামেও পরিচিত। এর মধ্যেই কার্তিকের মাঝামাঝি কৃষকরা প্রতীক্ষার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন কার্তিক বালাম ধানের ক্ষেতের দিকে। কবে পাকবে এই ধান আর ঘরে ওঠবে বছরের নতুন ধান তথা নবান্নের আনন্দ! এই ধান রোপন করা হতো আষাঢ়ের শেষ দিকে বা শ্রাবণের শুরুতে। এই ধান হতো একটু উঁচু জমিতে, বিশেষ করে খালের পাড়ের এলাকায় যাকে আমরা বলতাম ‘কান্দাকুল’। সাধারণত কার্তিকের শেষ দিকেই পেকে যেতো কার্তিক ধান। কার্তিক বালাম চালের ভাতের রংটা ছিল যেন কাঁচা হলুদে মাখা। কাঁচা হলুদের রঙের সেই ভাত দিয়ে ঘরে ঘরে চলতো নবান্নের আনন্দ।
   
নবান্নের আনন্দের সাথেই আমাদের শুরু হতো খরিপ মৌসুমের ফসলের আবাদ-আয়োজন। আমাদের খরিপ মৌসুমের ফসলের মধ্যে ছিল বেগুন, খিরাই, টমেটো, শালগম, মুলা সরিষা, মরিচ ও সবশেষে মিষ্টি আলু। আমাদের ছোটবেলায় আমরা এসবের বাণিজ্যিক চাষ করতাম না। পুরোটাই ছিল নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর খাতিরে। তাই এর চাষ হতো বেশির ভাগ বাড়ির ভিতরে। তবে মরিচ, সরিষা, মিষ্টি আলু এবং এরকমের দুয়েকটি শস্য আমরা খালের পাড়ের উঁচু জমিতেও চাষ করতাম। খালের পাশের উঁচু জমি যাকে আমরা বলতাম ‘কান্দাকুল’, সেই জমি সাধারণত নিচু জমি (নামা ভুই) থেকে বিচ্ছিন্ন করা থাকতো উঁচু একটি আল দিয়ে, যাকে আমরা বলতাম ‘কান্দি’। কান্দি দিয়ে আলাদা করা থাকতো বলেই এই উঁচু জমিকে বলা হতো ‘কান্দাকুল’। কান্দাকুলের কার্তিক বালাম ধান তোলা হয়ে গেলেই সেখানে শুরু হতো খরিপ মৌসুমের এসব ফসলের আবাদ। প্রতিবছর বর্ষায় ‘কান্দি’ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো বিধায়, খরিপ মৌসুমের ফসলের আবাদের শুরুতেই আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতো অগ্রহায়ণমাসের মধ্যে কান্দিটা বেঁধে ফেলা। কান্দি বান্ধার মূল উদ্দেশ্য ছিল কান্দির বাইরের জমিতে ছেড়ে দেয়া গরুবাছুরের হাত থেকে কান্দির ভিতরের জমিতে চাষকৃত খরিপ শস্য রক্ষা করা, কারণ গরু-ছাগলের পক্ষে অত উঁচু কান্দি ডিঙ্গিয়ে ফসলের ক্ষেতে যাওয়া সম্ভব হতো না।

অগ্রহায়ণ মাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল খেজুর গাছ ‘ছিলান’, অর্থাৎ রসের জন্য খেজুর গাছ কাটার প্রস্তুতি হিসেবে খেজুর গাছের এক পাশের শাখাগুলো কেটে ‘কপাটি’ বের করা।  ‘কপাটি’ বের করা মানে হলো গাছের নরম কা-ের একটা অংশ উন্মুক্ত করে চেঁছে মসৃণ করা আর তার সাথে ‘রসখিল’, ‘নাটখিল’ ইত্যাদি বসানো। এই সময় ‘মুইন্যা’ (হুলো/ পুরুষ জাতের) খেজুর গাছগুলো সব ছিলানো হতো। খেজুর গাছ ছিলানের কাজে আমরা ছোটরা শুধু সহায়কের ভূমিকায় থাকতাম। সহায়তার মধ্যে থাকতো টোনা, দড়া, কাইড্যা, বালিকোচা ইত্যাদি খুঁজে এনে বা এগিয়ে এনে দেয়া। টোনা হলো বেত বা নারিকেলের ‘চুরি’ (নারিকেলের ছড়া বা পির যে আচ্ছাদন ফুঁড়ে বের হয়) দিয়ে বানানো একধরনের থলে যার মধ্যে খেজুর গাছ কাটা দা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে খেজুর গাছ কাটতে যাওয়া হয়। দড়া হলো মোটা একগাছা দড়ি যা দিয়ে ‘গাছি’ অর্থাৎ খেজুর গাছ কাটার লোকটি গাছ কাটার সময় নিজেকে গাছের সাথে বেঁধে নিতেন। কাইড্যা হলো এক টুকরা কাঠ যা খেজুর গাছের সাথে বেঁধে তার ওপর গাছি গাছ কাটার সময় বা গাছ ছিলানের সময় সচ্ছন্দভাবে দাঁড়াতেন। বালিকোচা হলো এক টুকরা লম্বা মসৃণ চৌকো কাঠ যার উপর বালিতে ঘষে দা ধারালো করা হতো। খেজুর গাছ ছিলানের সময় আমাদের জন্য আরেকটি সহায়তার কাজ ছিল খেজুরের বাইলগুলোর (খেজুরের শাখা) মাথার পাতা দুহাতে ধরে চিরে দুভাগ করে ‘পাইডান’ অর্থাৎ বাইলটির বাম হাতের ভাগ পরপর রেখে এক দিক দিয়ে সাজানো, আর ডান হাতের ভাগ উল্টো দিক করে তার ওপরে সাজানো। এভাবে ‘পাইডাইন্যা’ (পরিপাটীকৃত) বাইলগুলো কিছুদিনেই কাজে লাগতো শুকনো মৌসুমে ঘরের পাশে যে নতুন খোলা পাকঘর তৈরি হতো তার বেড়া দিতে। এই সহায়তার একটি ভালো পুরস্কারও থাকতো। সেটি হলো মুইন্যা খেজুর গাছ ছিলানের সময় গাছটির পুরুষ ফুলের ছড়াগুলোর মিষ্টি যে-কয়েকটি গোড়া পাওয়া যেত যাদেরকে ‘মাতি’ বলা হতো সেগুলো সব আমাদের কপালে জুটতো। বাবা, চাচা, ভাই যে-ই গাছ ছিলাতেন ঐ মিষ্টি মাতিগুলো আদরের সাথে আমাদের হাতেই তুলে দিতেন।

অগ্রহায়ণের মধ্যে সকল খেজুর গাছ ছিলান হয়ে যেতো, বাড়ির আঙ্গিনায় মরিচ আর বেগুনের বীজ ‘পাচ্চা’ দেয়া হয়ে যেত এবং কার্তিক বালামের ক্ষেত পরিস্কার হয়ে যেত ‘ধুলোট’- এর জন্য। ধুলোট হলো রবিশস্যের জন্য শুকনো জমি প্রস্তুতকরণ। অগ্রহায়ণের শেষে পাকতে শুরু করতো মূল ধানক্ষেতের ধানগুলো। কান্দাকুলের কাছে অল্প ‘নামা ভুইয়ে’ (স্বল্প নিচু জমিতে) কিংবা যাকে বলা হতো ‘কোল ডরা ভুই’ সেই ভূঁইয়ে বা জমিতে রোপা থাকতো ‘মৌলতা’, ‘ডিঙ্গামানিক’, ‘পাইজাম’, ‘পাইরজাল’, ‘সীতাভোগ’ ইত্যাদি ধানগুলো। নামা ভূঁইয়ে এই ধানগুলোই আগে পাকতো। যে জায়গার ধান পেকে গেছে সে জায়গাটি যদি পায়ে কাদা বাঁধে না এমন পর্যায়ে শুকিয়ে গিয়ে থাকতো তাহলে আমরা সেই ধান কাটতাম ‘দুনা’ দিয়ে। ‘দুনা দেয়া’ মানে হলো ধান গাছের গোড়া কেটে প্রথমে সারি করে রাখা এবং তারপরে ‘আগা ছাডা’। আগা ছাডা মানে হলো গাছের উপরিভাগের অংশ অর্থাৎ ধানের অংশ আবার ‘দুনা’ রূপে ফেলে রাখা ধান গাছের মাঝখান থেকে কেটে নেয়া। ‘ধান দাওয়া’ বলতে মূলত এভাবে ধানগাছের মাঝবরাবর থেকে কাটা বা ‘আগা ছাডা’কে বোঝাতো। দুনা না দিয়ে দাওয়া ধানের ক্ষেত্রে পরে জমি শুকালে দ্বিতীয়বার ধান গাছের গোড়ার অংশ কাটা হতো। এভাবে ধান গাছের গোড়ার অংশ কাটাকে বলা হতো নাড়া কাটা। কোলডরা ভুইয়ের ধান পৌষের মধ্যভাগের মধ্যে দাওয়া শেষ হয়ে যেতো। কোল ডরা ভুই তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেতো বলে এই জমিতে ধান পাকার আগেই ইঁদুর এসে জুটে যেতো এবং গর্ত খুঁড়ে শুয়ে পড়া ধানগাছ থেকে ধানের ছড়া কেটে কেটে নিয়ে সেখানে জমা করতো। আমরা ছোটরা যারা ধান দাইতে পটু ছিলাম না তাদের একটি বড় কাজ ছিল এই ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে পাঁজা করা ধান সংগ্রহ করা আর ইঁদুর ধরে আনা। পাঁজা করা ধান সংগ্রহ সহজ হলেও ইঁদুর ধরা খুব সহজ ছিল না। গর্তে হাত ঢুকিয়ে ইঁদুর ধরতে গিয়ে ইঁদুরের কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকের কাছে বলার মতো গল্প হয়ে উঠতো।
   
কোলডরা ভুইয়ের নিচে পুরো নামা ভুই বা ডরা ভুইতে রোপা থাকতো ‘কালঝাড়া’, ‘কালামোডা’, ‘ধলামোডা’, ‘কাচামোডা’ ইত্যাদি ধান। এগুলো পাকতে পাকতে পৌষের শেষ বা মাঘের শুরুর সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতো। ফলত সবশেষে দাওয়া হতো এই ধানগুলো। অনেক সময় এমন হতো যে, ধান পেকে গেছে কিন্তু ক্ষেতে জবর কাদা বলে ধান কাটতে দেরি করতে হতো। তবে এই দেরিরও একটি সীমা থাকতো। সাধারণত দেখা হতো ধানের ‘খুনি ছড়া ভাঙ্গা’ কিনা। খুনি ছড়া ভাঙ্গা মানে হলো পেকে ধানের ছড়ার ছোট ছোট উপছড়া ঝরে পড়া। খুনি ছড়া ভাঙ্গা শুরু হলে আর বসে থাকা যেতো না। কাদা যতই হোক ওর মধ্যেই ধান দাওয়া শেষ করতে হতো। এমনটা হতো হতো সাধারণত মাঘের দ্বিতীয় সপ্তায়।

পৌষ মাসটায় কাজের দিক দিয়ে আমাদের দিনগুলো তিন ভাগ হয়ে যেতো। খুব ভোরটা কাটতো খেজুরের রস আহরণ আর রবিশস্যের ধুলোটে কাজ করে। এরপর ভোরের খাবার খেয়ে আমরা নেমে যেতাম ধানক্ষেতে ধানদাওয়া বা নাড়া কাটার কাজে। দুপুরের পরটায় শুরু হতো ধানমাড়াইয়ের কাজ। ভাদ্রমাসের ধান মাড়াইয়ের মতো এই সময়ের ধান মাড়াইটা কোনো কঠিন কাজ ছিল না। পৌষমাসে শুকনো উঠোনে সহজেই আমরা ধান মাড়াইয়ের জন্য গরু দিয়ে ‘মলন’ লইতাম। ‘মলন লওয়া’ মানে হলো কেটে এনে ‘পালা’ করে রাখা ধানের আঁটি খুলে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে তার ওপর পাঁচ-ছটা গরু একত্রে জুড়ে বৃত্তাকারে ঘুরানো। এ কাজকে কেউ বলতো ‘মলন লওয়া’, আবার কেউ বলতো ‘মেই ভাঙ্গা’। বৃত্তাকার ‘মেই’ বা ‘মলন’- এর কেন্দ্রে যে গরুটি থাকতো সে প্রায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতো আর বাকি গরুগুলো তাকে কেন্দ্র করে পরিধি জুড়ে ঘুরতে থাকতো। কেন্দ্রের এই গরুটিকে বলা হতো ‘গোরের গরু’। ভাঙ্গা ধানের মলনের ধানটা মাড়াই হতো অর্থাৎ ধানগাছ থেকে ধানটা পড়ে যেতো মূলত মলনের উপর হাঁটতে থাকা গরুগুলোর পায়ের বা খুরের চাপে। মলনে পালা থেকে নামানো আঁটির ধান প্রথম ছড়িয়ে দেয়াকে বলা হতো ‘ধান ভাঙ্গা’। মলনে গরু ঘোরানোর একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে যখন দেখা যেতো উপরের খড়গুলো থেকে ধান প্রায় সব ঝরে গেছে তখন উপর থেকে ঝেড়ে ঝেড়ে খড়গুলো পাশে সরিয়ে রাখা হতো। এভাবে দুয়েক স্তর খড় সরানোর পরে আলগা খড় আর পাওয়া যেতো না। তখন গরু সরিয়ে মলনের পুরো খড়গুলো একবার ঝেড়ে নেয়া হতো। এই কাজটিকে বলা হতো ‘তলা ঝাড়া’। তলা ঝাড়ার পরে ঝেড়ে রাখা সব খড় আবার বিছিয়ে তার ওপরে আবার এক প্রস্থ গরু ঘোরানো হতো। মূলত মলন মানেই এমন দুই প্রস্থ মলনের একত্রিত রূপ।

মলনের খড় ও ধানক্ষেতের নাড়া দুই জিনিস একত্র করে পরে সংরক্ষণের একটি কাজ থাকতো। এই সংরক্ষণ হতো ফাল্গুন মাসের দিকে আর এই সংরক্ষণ হতো খড়ের গাঁদা রূপে। এই খড়ের গাঁদার নাম অঞ্চলভেদে কোথাও ‘মেই’ আবার কোথাও বা ‘কুড়’। এই মেই দেয়ার জন্য মেইয়ের কেন্দ্রে সাধারণত একটি জ্যান্ত গাছ রাখা হতো। সাধারণত শিমুল গাছ ছিল এই কাজের জন্য সবচেয়ে পছন্দের নির্বাচন। কাউপলা গাছেও চলতো। একটু উঁচু মাটির বেদী করে তার উপরে প্রথমে নাড়া সাজিয়ে ও পরে খড় বিছিয়ে এই মেই তৈরি করা হতো। খড়ের এই সংরক্ষণ হয় গোখাদ্য হিসেবে।

পৌষ ও মাঘ জুড়ে এই কাজ চলতে থাকার মধ্যেই থাকতো রবি শস্যের জন্য ধুলোটের ব্যস্ততা। ধুলোটে কাজ হলো মাটি চষা, মুগুর বা ‘খাইড্যা’ দিয়ে মাটির বড় চাকাগুলো গুড়িয়ে দেয়া এবং মই দিয়ে ছোট মাটির চাকাগুলো গুড়ো করা। এভাবে ধুলোট বানিয়ে তাতে পৌষের শেষ দিকে ‘লাগানো’ হতো মরিচ চারা। আর মাঘে লাগানো হতো আড়াই প্যাঁচ দেয়া মিষ্টি আলুর লতা। মাঘের শেষ থেকে আমাদের আবার শুরু হতো অনেকটা বিশ্রামের দিন। ধুলোটে নিড়ানি দেয়া, কলাই ঘরে তোলা, মরিচ গাছ থেকে পাকা মরিচ তোলা এই জাতীয় কিছু কাজ ছাড়া মাঘের শেষে ও ফাল্গুনে কর্মঠ পুরুষদের আর তেমন কোনো কাজ থাকতো না। তবে ফালগুনটায় আমাদের মতো পিচ্চিদের জন্য কিছু অকাজ এসে জড়ো হতো। এই অকাজের মধ্যে ছিল জ¦ালানির জন্য ঘুঁটে কুড়ানো, নাড়ার ‘মুথা’ অর্থাৎ মাঠে ধানের নাড়া কাটার পরে রেখে আসা ধানগাছের গোড়া ‘উগলিয়ে’ (উপড়িয়ে) তা সংগ্রহ করা আর মাঠে ঘাস খাওয়ার জন্য দড়িতে বাঁধা গরুর ‘ছোপ বদলানো’। ছোপ বদলানো মানে হলো এক দড়ির বৃত্তাকার অঞ্চলে কিছুক্ষণ ঘাস খাওয়ানোর পরে গরুটির দড়ির ‘গোছ’টা (খুটো) সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র পুঁতে দেয়া যাতে গরুটি নতুন জায়গায় ঘাস খেতে পারে।
 
এ তো গেলো বাড়ির কর্মঠ পুরুষদের কাজের সাথে আমার সহায়তা আর ভাগাভাগির ক্ষেত্র। তবে ছোটবেলার হালহালুটিতে আমার কাজের ভাগাভাগিটা যতটা পুরুষদের কাজে ছিল তার চেয়ে কিছুটা বেশিই ছিল মা-চাচিদের কাজের সাথে। বিশেষ করে পৌষ-মাঘে আমার বেশির ভাগ কাজই ছিল তাঁদের সাথে। আমার তো মনে হতো পৌষ মাঘের হালহালুটিতে তাদের কাজ পুরুষের চেয়ে একটু বেশিই থাকতো। এই মাসগুলোয় তাঁদের সকাল হতো ফজরের আজানেরও প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। এরকম দুঘণ্টা রাত থাকতে উঠে তাঁদের কাজ শুরু হতো ধান সেদ্ধ করা দিয়ে। তখনো ঘরের পুরুষ কর্মীরা কাঁথার তলেই সটান থাকতেন। সূর্য ওঠার একটু পরে পুরুষ কর্মীরা তাঁদের কাজ শুরু করতেন খেজুরের রস সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। খেজুর রস বাড়িতে পৌঁছার পরে একদিকে ডোঙ্গায় চলতো ধান সেদ্ধ আর একদিকে তারাশিতে চড়ানো হতো রস। এই দুই কাজেই আমার অংশ ছিল চুলায় ‘জ¦াল ঠ্যালা’ অর্থাৎ চুলার পাশে বসে জ¦ালানির তুষ, লতাপাতা আর নাড়ার মুথা চুলা বা তাফালের মুখ দিয়ে সময়মতো ঢোকানো।
 
মহিলাদের জন্য দিনের এর পরের কাজ হতো উঠানে বা খৈল্যানে ‘গোবর দেয়া’ অর্থাৎ পানিতে গোবর গুলে উঠোন বা খৈল্যান জুড়ে পানিটা লেপে দেয়া। এটা না করলে মাটির উপরে ধান শুকানো যেতো না। গোবর-না-লেপা উঠানে বা খৈল্যানে ধান শুকাতে দিলে ধানে-ধুলায় মাখামাখি হয়ে যায়। এর মধ্যে সকালের পান্তা পর্ব শেষ হতো। পুরুষরা ধুলোটের কাজ শেষে ধানক্ষেতের কাজে চলে যেতেন। মহিলাদের শুরু হতো সেদ্ধ ধান শুকানোর জন্য উঠানে ধান বিছিয়ে দেয়া। চুলায় ‘জ¦াল ঠ্যালা’ শেষ করে এবার আমার কাজ শুরু হতো ‘ধান খ্যাদানো’ অর্থাৎ শুকাতে দেয়া ধানগুলো যাতে হাঁসমুরগিতে খেয়ে না যায় সেজন্য উঠানের পাশে একটা লম্বা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে পাহারায় বসে থাকা। মিনিট ১৫ অন্তর ধানটা পা দিয়ে নেড়ে দিতে হতো। এটা খুব সহজ কাজ ছিল। কাজটা হলো পা দুটো একটু চ্যাপ্টা করে বিছানো ধানের পুরো আয়তন জুড়ে খালি পায়ে হাঁটতে থাকা। কাজটা আমি খুব আনন্দের সাথে করতাম। হাঁটার সময় পায়ে ধানের মৃদু চাপ থেকে এক অদ্ভুত সুখকর আনন্দ হতো আমার। গত বছর থাইল্যান্ডের চিয়াংমাইতে দেখেছিলাম অদ্ভুত এক ফিশ থেরাপি। একটি ছোট একুয়ারিয়ামে ছোট ছোট কিছু মাছ। তার মধ্যে পায়ের নলা পর্যন্ত ডুবিয়ে সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েরা বসে আছে। মাছগুলো তাদের পা জড়িয়ে সুড়সুড়ে এক অনুভূতি দিচ্ছে আর বিশ মিনিটের এই সুড়সুড়ির সুখ বাবদ ছেলে-মেয়েগুলো ৬০ বাথ অর্থাৎ ১৮০ টাকা করে গুনছে। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে হচ্ছিলো ছেলেমেয়েগুলো ধরে নিয়ে আমাদের শুকাতে দেয়া ধানের উপর হাঁটার জন্য ছেড়ে দিলে ওদের পায়ের সুড়সুড়ি সুখও হতো আর আমাদের ধানগুলোরও বিনা পয়সায় নাড়া দেয়ার ব্যবস্থা হতো। ধান নেড়ে পায়ের সুড়সুড়ির এই আনন্দস্মৃতি আমার ছিল বলেই চিয়াংমাইয়ে ঐ সুড়সুড়ির জন্য আমার কোনো ইচ্ছা জাগেনি বরং ঐ ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি করুণা হয়েছে।
 
শুকাতে দেয়া ধানের ‘পানি মারা’ হয়ে গেলে অর্থাৎ সেদ্ধ হিসেবে ধানগুলোয় যে রসালো ভাব থাকে শুকানোর প্রক্রিয়ায় তা হারিয়ে যাওয়ার পরে ধানের নিচের উঠানের আর্দ্রতা যাতে আর ধানকে আর্দ্র না করতে পারে এ জন্য শুকানোর ধানে ‘ইর দেয়া’ হতো। ইর দেয়া মানে হলো বিছানো ধানের পরিধিতে ধানগুলো টেনে এনে বৃত্তের অভ্যন্তরটা খালি করে ফেলা যাতে রোদে সেই জমিটার আর্দ্রতা শুকিয়ে যায়। ইর দেয়ার জন্য ধান টেনে আনা হতো তালের শাখার গোড়া বা কলাগাছের খোলের ছোট ছোট টুকরা দ্বারা যাকে আমরা ‘হাতা’ বা ‘আতা’ বলতাম। ‘হাতা’ বা ‘আতা’ শব্দটি বরিশালের ভাষায় কৃষিকাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থ দিতো। ধানের চারা তোলার সময় ‘আতা’ বলতে বোঝাতো এক মুঠিতে যতগুলো বীজ বা চারা ধরা যায় ততটুকুকে। রান্নার সময় ‘আতা’ বলতে বোঝাতো পাতা বা কাপড় দিয়ে তৈরি সেই বস্তু যার সাহায্যে চুলার গরম পাতিল ধরা হতো। ধান ভানার সময় ‘আতা’ বলতে বোঝাতো নারিকেলের শাখার গোড়ার ভাগ দিয়ে তৈরি সেই বস্তুকে যা দ্বারা ঢেঁকিতে ধান ভানার সময় মুষল বরাবর জায়গা থেকে সরে যেতে থাকা ধান টেনে এনে মুষল বরাবর রাখা হতো। যাই হোক ইর দেয়ার আতা দিয়ে ধান টেনে যেমন ইর দেয়া হতো তেমনি ভিতরাংশ শুকানোর পরে ‘ইর ভাঙ্গা’ অর্থাৎ ইরের ধান আবার ছড়িয়ে দেয়ার কাজেও এই আতাই ব্যবহার করা হতো। আবার শেষ বেলায় রোদ পড়ে গেলে শুকনো ধান স্তূপ করার কাজেও ঐ ‘আতা’ই ব্যবহার করা হতো।
 
এভাবে শেষ বেলায় ধান তুলে বাড়ির মহিলারা যেতে পারতেন গোসলে ও পরিচ্ছন্নতায়। এর মধ্যেই দুপুরের রান্না সামলাতে হতো। বিকালে গোসল-খাবারাদি শেষে শীতকালে প্রায়ই থাকতো ধান ভানার কাজ। ধান ভানা মানে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান থেকে চাল বের করা। এ কাজে একজন বা দুজনে পাড় দিতো। আর আমি গায়ের বলে খাটো ছিলাম বলে আমার কাজ হতো ‘আলান’। ‘আলান’ মানে হলো উপরে যে আতার কথা বলেছি সেই আতা দিয়ে প্রতিবার পাড় দেওয়া ঢেঁকির মুষলটি ‘লোট’- এর উপর পড়ার আগে মুষল বরাবর জায়গা থেকে সরে যেতে থাকা ধান টেনে এনে মুষল বরাবর রাখা যাতে প্রতিবার ঢেঁকির মুষলটি নতুন ধানের উপর পড়ে বা আঘাত করে। আলানের কাজটি একটি ছন্দ মেনে করতে হতো। ঢেঁকিটি উপরে জেগে যতটুকু সময় উপরে থাকবে ততটুকু সময়ের মধ্যে প্রতিবারের আলানটি শেষ করতে হবে, নচেৎ ঢেঁকির মুষলটি ‘আতা’র উপর পড়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আমার কবিতায় ছন্দ না থাকলেও আলানের কাজে হাতে ঐ ছন্দটা যথাবিহিত ছিল। আমার মা সাক্ষী। আর বিকালে যেদিন ধান ভানার কাজ থাকতো না সেদিন থাকতো সকালের খেজুরের রস যেটুকু গুড় না বানিয়ে লাল রঙের ঘন রস রূপে অর্থাৎ ‘তায়ৈল’ রূপে রেখে দেয়া হয়েছে সেইটুকুর সদ্ব্যবহারের কাজ। ঐ রসের সদ্ব্যবহার মানে কোনো পিঠা তৈরি। হতে পারে সে ‘চ্যাবা’ পিঠা, হতে পারে ‘চুই’ পিঠা বা হতে পারে চিতই পিঠা যা ভিজানো হতো ঐ রসে। খেজুর রসের পিঠা তৈরিতে সব সময় ব্যবহৃত হতো ঐ তায়ৈল রস, আর একমাত্র পায়েস বা শিরনি হতো সাদা রঙের কাঁচা রসে।
 
এই কাঁচা রসের মতোই রসের ছিল আমাদের হালহালুটির সেই ছোটবেলার দিনগুলো। হারিয়েছে সে দিন। হারিয়ে গেছে চিরতরে। এখন আর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মাসের পর মাস থেকেও এর একটি দিনও খুঁজে পাই না। এমনকি হারিয়ে গেছে সে সময়ের এই সব কাজের শত শত শব্দও। কৃষিকাজের সেই দিনগুলোর জন্য যেমন মায়া লাগে, তেমনি মায়া লাগে হারিয়ে যাওয়া সেই শব্দগুলোর জন্যও। আসুন দিনগুলো ধরে না রাখতে পারলেও আমরা শব্দগুলো অন্তত ধরে রাখার চেষ্টা করি।     

লেখক: মুহম্মদ মুহসিন, শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।