সমাজভাষাবিজ্ঞানের আলোকে বরিশালের ভাষার কতিপয় খণ্ডচিত্র
মুহম্মদ মুহসিন, শিক্ষক ও লেখক
প্রকাশিত: ০১:০২ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২১ সোমবার আপডেট: ০১:০৫ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২১ সোমবার
বরিশালের ভাষা নিয়ে কথা কম হয় না। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা নিয়ে হেন চর্চা নেই যা করা হয়না। তা যারা এই ভাষায় কথা বলেন, তাদের বাইরেও। মজাটাই বেশি হয়। গান, নাটক, সংলাপের অংশ হয়ে বিনোদনের খোড়াকও যোগান দেয় বরিশালের ভাষা। কিন্তু এই ভাষা যে গবেষণারও দাবি রাখে, এই ভাষার অভিব্যক্তিতে যে শব্দ কিংবা বাক্যের বুৎপত্তিগত গুঢ়ার্থের পরিবর্তন ঘটে যায়, তা কি ভেবে দেখেছেন কেউ? বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক মুহম্মদ মুহসিন সেদিকটাতে আলোকপাত করেছেন ্এই রচনায়। পড়ুন- সমাজভাষাবিজ্ঞানের আলোকে বরিশালের ভাষার কতিপয় খণ্ডচিত্র
সমাজভাষাবিজ্ঞান ভাষাবিজ্ঞানে তুলনামূলকভাবে একটি নবীন সংযোজন। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে সুইস ভাষাতাত্ত্বিক লুইস গাউচাটের (Louis Gauchat) হাত ধরে এর যাত্রা শুরু। সমাজের সাধারণ বিষয়গুলো কীভাবে ভাষাকে প্রভাবিত করে এ নিয়েই মূলত ভাষাবিজ্ঞানের এই শাখার কাজ। এর বিপরীতে দাঁড়িয়েছে ভাষাবিজ্ঞানের আরেকটি নবীনতর শাখা যেটিতে আলোচনা করা হয় ভাষা কীভাবে সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে এবং ভাষাবিজ্ঞানের সেই শাখার নাম ভাষার সমাজতত্ত্ব। ভাষার ওপর সমাজের যেসকল প্রভাবক কাজ করে মর্মে সমাজভাষাবিজ্ঞান দেখায় সে-সব প্রভাবকের মধ্যে সাধারণভাবে রয়েছে লিঙ্গভেদ, সামাজিক শ্রেণিস্তর-ভেদ, ধর্ম, পেশাগত বিভেদ, জাতিভেদ, শিক্ষাগত বৈষম্য ইত্যাদি। এগুলোকে ইংরেজিতে সোশিয়োলেক্ট (sociolect) বলা হয়, বাংলায় বলা যেতে পারে সমাজভাষাবিজ্ঞানগত প্রভাবক। এই প্রভাবকগুলোর ভিত্তিতে দেখলে বরিশালের ভাষার অর্থ ও ব্যবহারে চমকপ্রদ কিছু বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। সে-সব বৈশিষ্ট্য থেকে সাধারণভাবে দৃষ্টিগোচর হয় এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য, তথ্য ও ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রভাবকের অধীনে বিন্যস্ত করে নিম্নে আলোচিত হলো।
প্রথমেই ধরা যাক লিঙ্গভেদের বিষয়টি। যেমনটা সর্বত্র পরিলক্ষিত তেমনটাই বরিশাল তথা বৃহত্তর দক্ষিণবাংলা অঞ্চলেও মানব-মানবীর পারস্পরিক সম্পর্কে একটি তীব্র চেতনাগত দ্বন্দ্ব রয়েছ। এই দ্বন্দ্বের প্রকাশ রয়েছে তাদের পারস্পরিক রেষারেষি ও একে অন্যকে ছোট করে দেখা ও দেখানোর প্রয়াসের মধ্যে, যা কখনো হাস্যকর পর্যায়ের আবার কখনো বা দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামাজিক পর্যায়ের। এই লিঙ্গগত দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির বিষয়গুলো এতদঞ্চলের ভাষায় যেভাবে প্রকটিত হয়েছে তা কৌতুকপ্রদ ও বিস্ময়কর। কৌতুকপ্রদভাবে লক্ষ্যণীয় যে, এই রেষারেষি ও দ্বন্দ্বের প্রকাশে এতদঞ্চলের ভাষায় জয় হয়েছে নারী জাতির। পুরুষ বা মদ্দা জাতিটা এখানকার ভাষায় তীব্র ব্যঙ্গাত্মকভাবে নির্বোধ ও অকর্মণ্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। কতিপয় উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
পুরুষবাচক শব্দের মধ্যে বুদ্ধির স্থূলতার অর্থের যে প্রকাশ রয়েছে তার একটি সার্থক উদাহরণ বরিশালের ভাষার ‘আসা’ শব্দটি। পুরুষ প্রজাতির হাঁসকে এখানে ‘আসা’ বলা হয় আর স্ত্রী প্রজাতির হাঁসকে বলা হয় ‘আসি’। ‘আসা’ শব্দটি এখানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় নির্বোধ বা অথর্ব বোঝাতে। ‘এই আসাডারে লইয়া কোনো কাম সুসার অইবেনানে’ (এই নির্বোধ ছেলেকে দিয়ে কোনো কাজ সার্থকভাবে করা যাবে না), ‘ঐ আসাডাড্ডে মাইয়া দেবা মাইয়াডার জীবনডা খুয়াইতে?’ (ঐ নির্বোধ ছেলেটার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে কি মেয়েটার জীবন শেষ করতে?)- ‘আসা’ শব্দের ইত্যাকার ব্যবহার বরিশালের ভাষায় অহরহ হয়ে থাকে। একইভাবে বিড়ালের পুরুষ প্রজাতি ‘হুলো বিড়াল’কে বরিশালে বলে ‘ওলাবিলোই’। এই পুরুষপ্রজাতির শব্দটিকেও একইভাবে অকর্মণ্য ও অথর্ব হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাউকে তাচ্ছিল্য করার ক্ষেত্রে এতদঞ্চলে একটি লাগসই প্রবাদ হলো ‘মানু ওলাকানি বাশশাই উকুম’। অকর্মন্যতার আরো একটি প্রবাদ আছে ‘ওলাবিলোই দিয়া ঝোলা ফিরান যায় না’। এই সকল প্রবাদেই অকর্মন্যতার ও অথর্বতার সাথে ‘হুলো’ অর্থাৎ পুরুষ প্রজাতিকে সমান্তরালে দাঁড় করানো হয়েছে। এছাড়া মানভাষার সাথে মিল রেখে পুরুষ প্রজাতির শব্দ যেমন ‘পাডা’ (পাঁঠা), ‘বলদ’ ইত্যাদিও বরিশালের ভাষায় অথর্বতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় জ্ঞাপক।
এর বিপরীতে পুরুষদের প্রয়াসে (হয়তো) নারীকে ছোট করে কিছু শব্দও বরিশালের ভাষায় লালিত হয়েছে। একটি বহুল ব্যবহৃত এমন শব্দ হলো ‘মাইগ্যা’। বরিশালের ‘মাউগ’ শব্দটি উপপত্নী বা বেশ্যা অর্থে ব্যবহৃত হলে এর থেকে উৎপন্ন ‘মাগি’ শব্দটি সাধারণভাবে স্ত্রীলোক বোঝায়। আর ‘মাগি’র বিশেষণরূপ ‘মাইগ্যা’ বলতে নারীজাতীয় বোঝায়। তবে শব্দটি সম্মানবাচক নয়। শব্দটি দ্বারা সাধারণত নারী জাতির ঐসব বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয় যেগুলো পুরুষরা অপছন্দ করে কারণ সেগুলো নারীদের গণ্ডির ছোটত্ব, মনের ক্ষুদ্রতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আচার কর্মকাণ্ডের সাথে তাদের অসম্পৃক্ততা ইত্যাদি প্রকাশ করে। ‘ব্যাডায় অফিসার বড় অইছে ঠিকই কিন্তু খাছলতটা এ্যাক্কারে মাইগ্যা জুইতের’ - এমন বাক্য বরিশালের ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে বোঝা যায় যে, ‘মাইগ্যা’ শব্দের এই নারীবিদ্বেষের রূপ সমাজে পুরুষতান্ত্রিকতা কায়েমের যুগ থেকে উদ্ভূত, এর ইতিহাস ভাষার সমান প্রাচীন নয়।
সামাজিক শ্রেণিস্তর ও স্তরভেদের প্রভাব বরিশালের ভাষায় ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। এই স্তরভেদের সাথে ধর্মীয় পেশার সাধারণ অর্থনৈতিক দরিদ্রতা ও শিক্ষার বৈষম্যের বিষয়াদি প্রকটভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। সোশিয়োলেক্টের এই বিশেষ রূপটির দ্বারা বরিশালের ভাষার অজস্র শব্দের অর্থ প্রভাবিত বা ক্ষেত্রবিশেষে নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। ধরা যাক, একটি শব্দ ‘আলামতারার মুনসি’। শব্দটি স্বল্প ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত দীনদরিদ্র লোকদেরকে তূচ্ছার্থে বোঝায়। ‘ঐ মেয়া আলামতারার মুনসি, তোমারে বোলাইছে কেডা শালিসিতে?’- অপমান করার মর্মে এমন কথা বরিশালে সচরাচর বলা হয়। অবশ্য ‘আলামতারা’ এবং ‘মুনসি’ এই দুটি শব্দের কোনোটিতেই অভিধানমতে তূচ্ছতা জ্ঞাপনের অবকাশ নেই। ‘আলামতারা’ হলো কোরানের আম্মা পারার শেষ দিক থেকে দশম সুরার সূচক বাক্যটি, আর ‘মুনশি’ হলো মোগল আমলের সরকারি দপ্তরে ফার্সিতে দলিল দস্তাবেজ লিখতে পারা কর্মচারি। কিন্তু, যেহেতু কোরানের আম্মা পারার এই সুরা সাধারণভাবে অশিক্ষিত লোকেরাও জানে এবং যেহেতু ইংরেজ রাজত্বে ফার্সি লিখতে পারা কর্মচারী আর কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক গুরুত্ব বহন করে না, সেহেতু সমাজবাস্তবতার এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘আলামতারার মুনসি’ শব্দের এমন তূচ্ছার্থক অর্থ সৃষ্ট হলো। একই ধারায় শুধু ‘আলামতারা’ হয়ে গেল কোনোকিছুর বিষয়ে একেবারে প্রাথমিক বা অনেকটা মূর্খ পর্যায়ের জ্ঞান; যেমন বলা হয়- ‘জান না আলামতারা, খোচতে আইছো হাপের গারা’ অর্থাৎ, সাপধরা বিষয়ে তোমার নেই মূর্খ পর্যায়ের জ্ঞানও, অথচ তুমি এসেছো সাপের গর্ত খুঁড়ে সাপ ধরতে।
এমন আরেকটি শব্দ ‘আল্লারাস্তে’। মূল শব্দটি হলো আল্লাহর ওয়াস্তে যার অর্থ হলো আল্লাহর জন্য বা আল্লাহকে খুশি করার জন্য নিবেদিত এমন। কিন্তু এই বিশুদ্ধ ভাবনার ধর্মীয় শব্দটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীনদরিদ্র মুসল্লি ধরনের লোকদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ায় সমাজের সাধারণ বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত তুলনামূলকভাবে উচ্চস্তরের শ্রেণিটির ব্যবহারে শব্দটি ক্রমান্বয়ে একটি তূচ্ছার্থ অর্জন করে। বর্তমানে শব্দটি ভিক্ষা চাওয়ার সাথে প্রাসঙ্গিক অনেকটা ধর্মীয় এক অভিব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন এতদঞ্চলে প্রতিটি ভিক্ষুকের ভিক্ষার ভাষা হলো ‘আল্লারাস্তে দুগগা খয়রাত দেন’ (অর্থ, দয়া করে ক’টা ভিক্ষা দেন)। যখন বলা হয় ‘আল্লারাস্তের খাওয়া খাইয়া পড়লে মন-টন এট্টু ছোডোই থাহে’ (অর্থাৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দান বা ভিক্ষার অন্নে যারা লালিত হয় তাদের মনমানসিকতায় একটু ক্ষুদ্রতা জড়িয়ে থাকে), তখন শব্দটি কাউকে দীনদরিদ্র হিসেবে মারাত্মক তাচ্ছিল্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়।
সামাজিকস্তরের উন্নয়ন অবনয়নের সাথে সাথে তাদের অবস্থান জ্ঞাপক শব্দের অর্থেরও ব্যাপক উন্নয়ন অবনয়ন ঘটে এমন বিস্ময়কর দৃষ্টান্তও বরিশালের ভাষায় প্রচুর। এমন একটি শব্দ ‘কুইড্যাল’। মানভাষায় শব্দটির মূল রূপ হলো ‘কুঠিয়াল’। কৃষি-সংযুক্ত শিল্প গড়ে তুলতে যারা কুঠি নির্মাণ করতেন সেই শিল্পমালিকদেরকে বোঝাতে আদিতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হতো। স্বাভাবিকভাবেই শব্দটির সাথে তখন একটি সমীহ ও সম্মানবোধ সংযুক্ত ছিল। কিন্তু বৃটিশ শাসনাবসান ও জমিদার বিলোপের মধ্য দিয়ে সমাজের এই শ্রেণি হারিয়ে যায় এবং বরিশাল অঞ্চলে ধান থেকে চাল বানানোর জন্য সম্পূর্ণ কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল এই জাতীয় কুটির শিল্প গড়ে ওঠে এবং তাদের কাজের নাম হয় ‘কুইড্যালি’। এই কুইড্যালরা সারা বছর গতর খাটে এবং কোনোভাবে সামান্য আয় থেকে জীবন চালায়। শব্দটি আদিতে শিল্পপতি শ্রেণিকে বোঝালেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এদের আর্থিক দুরবস্থা ও শ্রেণি অবনয়নের কারণে শব্দের আদি অর্থটি হারিয়ে যায় এবং শব্দটি তাচ্ছিল্যের অর্থে সমাজের একটি নিচু স্তরকে বোঝাতে শুরু করে। যখন একটি মানুষ বলে, ‘বড় মেয়া, ভুইটুই এবার চওয়াইতে পারিনায়, কোনোমতে কুইড্যালি-মুইড্যালি হইরাই খাই, মোগো দিক এট্টু চাইয়েন’- তখন বোঝা যায় যে লোকটি তার দীনদশা বোঝাতে ‘কুইড্যালি’ শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং সেই দীনদশার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ধনিক ব্যক্তির নিকট সাহায্য কামনা করছে। ভেবে অবাক হতে হয়, আর্থিক সচ্ছলতা হারানোর কারণে একটি পেশাজ্ঞাপক শব্দ কীভাবে মর্যাদার অর্থ হারিয়ে তাচ্ছিল্যের অর্থে চলে আসে।
এর আরেকটি খানদানি উদাহরণ ‘জাগির’ শব্দটি। শব্দটি আদিতে ছিল ফার্সি ‘জায়গির’ (جایٔگیر)। শব্দটি দ্বারা সুলতানি আমলে বোঝাতো একটি সামন্ত বা জমিদারি ব্যবস্থা। তখন কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরূপ অথবা সুফি বা দরবেশ হিসেবে মর্যাদাস্বরূপ বাদশাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত নিষ্কর জমিদারিকে জায়গির বলা হতো। পরবর্তীতে সুলতান বা বাদশাহর অনুসরণে জমিদাররাও সাধুপুরুষদেরকে তাঁদের এলাকায় থাকার জন্য এরূপ জায়গির প্রদান করতেন। তখনো শব্দটি অত্যন্ত সম্মানবাচক ছিল। তারই অনুকরণে অবস্থাপন্ন লোকরা গরিব কোনো ধর্মীয় লোকদেরকে থাকার জায়গা করে দিলে তাকেও জায়গির বলা হতে লাগলো। তারও পরে যখন স্কুল-মাদ্রাসায় পড়া গরিব শিক্ষর্থীদেরকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী অবস্থাপন্ন লোকেরা থাকাখাওয়ার জায়গা দিলো তখনো শব্দটি জায়গির রয়ে গেলেও শব্দটির সাথে পুরনো মর্যাদার অনুষঙ্গ আর থাকলো না। বরং আশ্রয়দানের অনুকম্পা ও আশ্রয়গ্রহণের দীনতা এর সাথে যুক্ত হয়ে গেল। ফলে জায়গির প্রাপ্তির সাথে আজ আর জমিদারির কোনো শানশওকত নেই বরং আছে দীনতা অনুভবের মানসিক কষ্ট। আজ যখন বলা হয়- ‘পোলাউগগা সর্সিনা মাদরাসায় পড়ে আর সরুপকাডি এ্যাক বাড়ি জাগির থাহে’ (= ছেলেটি এক বাড়িতে পড়ানোর বিনিময়ে থাকে-খায় আর সর্সিনা মাদরাসায় পড়ে) তখন বোঝা যায় ছেলেকে মাদ্রাসায় নিজ খরচে পড়ানোর সঙ্গতি বাবার নেই বিধায় তাকে এক বাড়ির আশ্রয় ও অনুকম্পার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
সামাজিক স্তর পরিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট স্তর-জ্ঞাপক শব্দের অর্থের এমন পরিবর্তনের প্রচুর উদাহরণ বরিশালের বাংলায় আছে। একটি অতি পরিচিতি শব্দ হলো ‘ম্যাতোইর’। এর মূল উৎস শব্দ হলো ফারসি ‘মেহতর’ (মেহতর > মেথর > ম্যাতোইর) যার অর্থ ‘অতি সম্মানিত’। কিন্তু আদি অর্থে যতই লিখিত থাকুক ‘অতি সম্মানিত’ বা ‘অতি মর্যাদাবান’, বর্তমানে এ শব্দ দ্বারা কি পরিমাণ অসম্মান বোঝায় তা আমাদের সকলের জানা। কারণ হলো আমরা যতোই ন্যায়শাস্ত্র দ্বারা শব্দের অর্থের সাথে মর্যাদার সংযোগ ঘটাতে চাই না কেন, শব্দ তার অর্থ সমাজবাস্তবতার অমোঘ নির্দেশের বাইরে নিতে কখনো রাজি নয়। ‘মুসাফির’ শব্দটির ভাগ্যেও এমন ঘটেছে। আরবি মুসাফির শব্দের অর্থ ভ্রমণকারী বা প্ররিব্রাজক। কিন্তু বরিশালের ভাষায় মুসাফির শব্দ দ্বারা এখন বোঝায় ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ানো ব্যক্তিকে। আরবি ‘খয়রাত’ শব্দের অর্থ ছিল কল্যাণ, কিন্তু বরিশালের ভাষায় ভিক্ষুকরা এই কল্যাণ চেয়ে চেয়ে শব্দটিকে ভিক্ষার অর্থে নামিয়ে এনেছে। সামাজিক মর্যাদায় পেশাগত নিম্নধাপের সাথে সংযুক্তির কারণে শব্দটি তার কল্যাণের মর্যাদাকর অর্থ হারিয়েছে।
সামাজিক স্তর ও শ্রেণিভেদে যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ উদ্ভূত হয় তা-ও শব্দের গঠন ও অর্থে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। বরিশালের ভাষায় এর বহু নজির রয়েছে। উঁচু শ্রেণির প্রতি কর্মজীবী শ্রেণির তীব্র বিদ্বেষ জ্ঞাপক এরকম একটি বাগ্বিধি হলো ‘গ্যারাইদ্যা হোচা’। ‘গ্যারাইদ্যা হোচা’ বাগধারাটির মূল অর্থ হলো হাতের পরিবর্তে নারিকেলের শাখার গোড়া দিয়ে শৌচকর্ম করা। এতদঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষেরা মনে করে যে, যারা সাহেব-সুবো হয় তারা কাজকর্ম ছেড়ে বসে বসে খায়, ফলে তাদের নিতম্ব ভারী হতে থাকে। নিতম্ব যদি এতখানি ভারী হয়ে যায় যে, তা আর হাতে নাগাল পাওয়া যায় না তখন শৌচকর্মের জন্য লম্বা কোনো হাতিয়ার দরকার হয়। সেই হাতিয়ার হতে পারে নারিকেলের লম্বা শাখার গোড়ার ভাগ। এমন কল্পনাকে উপজীব্য করে মারাত্মক শ্লেষের সাথে বড়লোকদের তথা উঁচু শ্রেণির ব্যাপারে এই বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়। এমন কথা ব্যাপক বলতে শোনা যায়- ‘ওনরা তো তিন পুরুষের তালুকদার, ওনরা কি আর হোগা আতে লাগ পায়, ওনরা তো গ্যারাইদ্যা হোচে’ (ওনারা তো তিন প্রজন্ম ধরে তালুকদার, ওনাদের পাছা তো এত মোটা যে ওনারা তো তা হাতে নাগাল পায় না, তাই ওনারা নারিকেলের শাখার গোড়া দিয়ে শৌচকর্ম করে)। অপেক্ষাকৃত উঁচু শ্রেণি এবং নব্য বড়লোকদের প্রতি বিদ্বেষ থেকে সৃষ্ট এ এক মারাত্মক বাগ্বিধি বা চিত্রকল্প।
অপেক্ষাকৃত মৃদু বিদ্বেষের এরকম আর একটি উদারহণ হলো ‘ছেরেচ্ছাদ’। ব্যুৎপত্তিগতভাবে শব্দটির মূল রূপ হলো ‘শ্রী-ছাঁদ’, অর্থ হলো কোনো বস্তুর সৌন্দর্য বা নান্দনিক রূপ। কিন্তু বরিশালের ভাষায় এই উৎস থেকে উদ্ভূত ‘ছেরেচ্ছাদ’ শব্দের মধ্যে নান্দনিকতার কোনো অর্থ নেই, বরং বরিশালের ভাষায় এর অর্থ হলো কোনো কাজের সাথে জড়িত অতিরিক্তি ও অসহনীয় ঝামেলা। নান্দনিকতার সাথে জড়িত শব্দটি ঝামেলা বা বিঘ্ন অর্থে কীভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু হলো তার পিছনে রয়েছে মজুর শ্রেণি এবং ধনিক শ্রেণির মধ্যকার বিদ্বেষের ইতিহাসের সংশ্লিষ্টতা। ধনিক শ্রেণির গৃহকর্মের সকল কিছুতে নান্দনিকতা আনয়নের দায় হলো মজুর শ্রেণির। ধনিক শ্রেণির ঘরের সকল কিছুর সেই নান্দনিকতার জন্য কেটে মরতে হয় মজুর শ্রেণিকে। এই নানন্দনিকতার জন্যই যে কাজ তিন ঘন্টার তা সম্পাদনে মজুর শ্রেণির ত্রিশ ঘন্টা চলে যায়। তাই ধনিক শ্রেণির এই নানন্দনিকতা মানেই মজুর শ্রেণির অসহনীয় ঝামেলা। মজুর শ্রেণির এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ‘শ্রী-ছাঁদ’ অর্থাৎ ‘ছেরেচ্ছাদ’ শব্দটি বরিশালের ভাষায় এখন শুধু ‘ঝামেলা’র অর্থ দিচ্ছে। এর অর্থের সাথে নান্দনকিতার কোনো যোগ এখন আর নেই।
সামাজিক স্তর ও শ্রেণিভেদের এই বিদ্বেষ যে শুধু একতরফা নয়, অর্থাৎ শুধু মজুর শ্রেণির বিদ্বেষ ধনিক শ্রেণির প্রতি তা নয়, বরং এই বিদ্বেষ যে ধনিক শ্রেণির দিক থেকে মজুর শ্রেণির প্রতিও অনেকটা সমভাবে ক্রিয়াশীল তার প্রকাশও বরিশালের ভাষায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা উল্লেখ করা যেতে পারে ‘দুর্গাইত্যা’ শব্দটি। ‘দুর্গাইত্যা’ বিশেষণটির উৎপত্তি ‘দুর্গত’ থেকে। অথচ বরিশালের ভাষায় শব্দটির ব্যবহারে দেখা যায় যে, যার জন্য এই বিশেষণটি ব্যবহৃত হচ্ছে তার প্রতি দুর্গত হিসেবে সমবেদনা তো নেই-ই, উল্টো তার প্রতি ক্ষোভ ও নিন্দার বর্ষণ ঘটছে যেন। বিষয়টি থেকে অনুমিত হয় ইংরেজি ভিলেইন শব্দটির মতো এটিও এতদঞ্চলের সামন্তদের মুখে হতভাগা প্রজা চাষীদের ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশক একটি শব্দ। শব্দটি এখনো ধারণ করছে ইতিহাস থেকে আহরিত এই সত্য যে চাষী ও প্রজার দুর্ভাগ্যের প্রতি ধনিক শ্রেণির বা সামন্ত শ্রেণির সমবেদনার স্থান তো নেই-ই, বরং রয়েছে নিন্দা ও ক্ষোভ। অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্নরা অবলীলায় বলে থাকে- ‘তোমরা যারা কাপুরচুপর ছয়ছুরাতে এট্টু ভালো হেরাই ওস্তাদের ধারে আবা, লুরিপিছা কায়দার দুরগাইত্যাগুলানরে আনবানা’ (তোমরা যারা কাপড়চোপড়ে একটু দুরুস্ত তারাই নেতার কাছে আসবে, কাপড়চোপড় নেই এমন দুর্গতদেরকে আনবে না), কিংবা বলে থাকে- ব্যাবাহে যে সোমায় কাছা দিয়া কোলায় কাম হরে, ঐ দুর্গাইত্যাডায় হে সোমায় ঘরে বইয়া উরুছ মিলায়, আহার মাসে ওর ঘরে চুলা বন্দো অইবে না তয় অইবে আর মানসের ঘরে? (= অন্য সকল মানুষে যখন আটঘাট বেঁধে মাঠে কাজ করে, তখন ঐ লক্ষ্মীছাড়াটায় ঘরে বসে উরুসের আয়োজন করে, তো আষাঢ় মাসে ওর ঘরে চুলা জ্বলা বন্ধ না হয়ে কি বন্ধ হবে অন্য মানুষের ঘরে?)। দুর্দশাগ্রস্তদের নিয়ে এমন নিন্দাসূচক শব্দ এখানে অবস্থাপন্নরা ঐতিহ্যের ধারায় অবলীলায় বলে ফেলে, এর নীতিগত অশোভনতার কথা চিন্তাই করে না।
সামজিক স্তর বিন্যাসের শ্রেণিভেদগত বিদ্বেষ ছাড়াও বরিশালের সমাজে বিভেদ-বিদ্বেষের চর্চা রয়েছে ধর্মভেদে এবং জাতিভেদেও। জাতিভেদ বিচারে এতদঞ্চলে এথনিক ভিন্ন সম্প্রদায় নেই, কিন্তু বাঙালির বাইরে ইউরোপিয় এক সময় ছিল। ঔপনিবেশিক সেই প্রভুদেরকে অন্যদের মতো বরিশালের লোকেরাও বিদ্বেষের সাথে দেখতো। তাই তাদের পরিচয় জ্ঞাপক Gringo শব্দটি বরিশালের ভাষায় এক ঘৃণা ও বিদ্বেষের শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। Gringo শব্দটি বরিশালে রূপ পেয়েছে ঘিরিঙ্গি হিসেবে। ইংরেজ তথা সাদা ইউরোপিয়দের প্যাঁচালো ও কুচক্রী কাজকর্ম এতদঞ্চলের উপনিবেশিত জনগণের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অশান্তির ও ঝামেলার ছিল বিধায় ঘিরিঙ্গি শব্দটিকে তারা কুচক্রী কর্মকাণ্ডের সাথে সমার্থক করে নিয়েছে। এখন এরকম কথা বরিশাল অঞ্চলে অহরহ বলতে শোনা যায়- ‘বিয়াডা সুসারভাবে অইয়া যাইবে হেয়া মাইয়ার মামু আইয়া মোহরানা লইয়া ঘিরিঙ্গি যা এ্যাট্টা লাগাইছে হেতে মোনে কয় শ্যাষ পোর্যোন্ত বিয়াডা ভাইঙ্গাই যাইবেআনে’ (বিয়েটা সুষ্ঠুভাবে হয়ে যাবে তা, মেয়ের মামা এসে কুচক্রী প্যাঁচ যা একটা লাগিয়েছে তাতে মনে হয় বিয়েটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গেই যাবে)। ইউরোপিয়দের কুচক্রী কাজকর্মের প্রতি ঘৃণা প্রকাশক এই শব্দ বরিশালে এখনো চলমান রয়েছে।
সামাজিক আচারগত পরিবর্তনে শব্দের অর্থের পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টিও সমাজভাষাবিজ্ঞানের একটি প্রসঙ্গ। বরিশালের ভাষায় এমন পরিবর্তনের উদাহরণ অনেক রয়েছে। এ বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য শব্দ হলো ‘খোসাবুন্দি’ বা ‘খোসামুন্দি’। বরিশালের ভাষায় বর্তমানে শব্দটির অর্থ হলো একই সাথে প্রশংসা ও অনুনয় দ্বারা কাউকে কিছু করার বা দেয়ার পক্ষে রাজি করানোর চেষ্টা। কিন্তু শব্দটির উৎসমূল ছিল ফারসি শব্দ ‘খোশ আমদেদ’ যার অর্থ স্বাগতম জানানো। সামাজিকভাবে ‘খোশআমদেদ’ দ্বারা ইতিহাসের এ জাতীয় চর্চার আদিতে হয়তো স্বাগতম জানানোর কর্মকাণ্ডই সম্পাদিত হতো। কিন্তু কালে কালে দেখা গেল খোশ আমদেদ শুধু স্বাগতম জানানো নয়। এর রয়েছে অন্তর্নিহিত অন্য উদ্দেশ্য। সামাজিক আচারের বিবর্তনে দেখা গেল কাউকে নিবেদিত আমাদের ‘খোশ আমদেদ’ তথা অভিনন্দন অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা সাধারণত তার বিপুল প্রশংসা করি আর তার কাছ থেকে আমরা কী পেতে চাই সে মর্মে অনুনয়ের সাথে দাবি জানাই। ‘খোশ আমদেদ’ এর এই আচারগত পরিবর্তনের সাথে শব্দটির ব্যুৎপত্তির অর্থও ধীরে ধীরে সরে গিয়ে বর্তমান অর্থ অর্জন করেছে। তাই এখন পারিবারিক পরিম-লে যেখানে ‘খোশআমদেদ’ জাতীয় আনুষ্ঠানিকতার কোনো প্রসঙ্গ নেই সেখানেও ‘খোসামুন্দি’ শব্দের প্রয়োগ এসেছে এবং মানুষ হরহামেশাই এমন বলছে- ‘এ্যাত্তো খোসামুন্দি হইর্যা কইলাম- বাবা, তুই ভালো, মোগো আম কউগগা পক্কিতে খাইয়া হালায় এট্টু পাইর্যা দে- হেইয়া পোলাডায় দেলে না পাইর্যা’ (= এত তারিফ ও অনুনয়ের সাথে বললাম- ‘বাবা, তুই ভালো, দেখ, আমাদের আমগুলো পাখিতে খেয়ে ফেলছে, একটু পেড়ে দে, তা ছেলেটা দিলোই না পেড়ে)।
সমাজভাষাবিজ্ঞানে স্বীকৃত সামাজিক প্রভাবকসমূহ এভাবেই বরিশালের ভাষায় ক্রিয়াশীল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা চোখে পড়ছে না। আমার এ প্রবন্ধ বিষয়টির ওপরে একেবারেই একটি তাৎক্ষণিক দৃষ্টিপাত, মোটেই কোনো কার্যকর গবেষণা নয়। আশা করবো অচিরেই বিষয়টির দিকে যোগ্য গবেষকরা নজর দিবেন।
মুহম্মদ মুহসিন, শিক্ষক ও গবেষক