বগ মানব
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ০২:৫২ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ০২:৫৫ পিএম, ৯ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার
শেখ আনোয়ার
প্রাকৃতিক ইতিহাসের কথা বলে কার্নেগি জাদুঘর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট পিটার্সবার্গে রয়েছে এই কার্নেগি জাদুঘর। এখানে সাতটি মমি রাখা হয়েছে। এগুলোকে বলে ‘বগ পিপল’। এই নামে পরিচিত মমিগুলো। কার্নেগি জাদুঘরটি ব্যাপক পরিচিতি পায় মূলত মিসরের রাজা টুটের মমির মতো বিশাল দামি একটি সম্পদ এখানে থাকায়। এজন্যই জাদুঘরের সংগ্রহশালা নিয়ে এতো আলোচনা আর কৌতূহল। আর এই কৌত‚হলে নতুন মাত্রা এনেছে এখানকার ‘বগ পিপল’ বগ মানবের সমৃদ্ধ ভান্ডার।
বগ মানব কী? বগ পিপলের বাংলা হলো কাদামাটির মানব। কালক্রমে জলা শুকিয়ে যাওয়ার পর জলাভূমির বিশেষ ধরণের মাটি জমাট বেঁধে শক্ত পাথুরে রূপ নেয়। এই মাটি কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের রেওয়াজও আছে। এই জমাটবদ্ধ মাটি ইংরেজিতে বগ নামে পরিচিত। শত সহস্র বছরের প্রাচীন ইউরোপীয়দের মৃতদেহ এসব জলার জমাট মাটির অভ্যন্তর থেকে উদ্ধারের বেশ কিছু নজির রয়েছে। তো জমাট কাদামাটি থেকে এসব মৃতদেহ উদ্ধারের পর এগুলোর নাম দেয়া হয়েছে বগ পিপল বা কাদামটির মানব। মিসরে মমি করে রাখা মৃতদেহের মতোই এগুলো জমাট কাদার চাপে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও। পার্থক্য একটাই মিসরে মৃতদেহ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি সেরেছে মানুষ। আর এক্ষেত্রে পুরো দায়িত্ব পালন করেছে প্রকৃতি। তবে কাদামাটি জমাটবদ্ধ হওয়ার পর চারপাশের চাপে মৃতদেহগুলো ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ে অনেকটা অস্থিচর্মসার। অবশ্য এই প্রচন্ড চাপের কারণেই মৃতদেহে পচন ধরার কোনো লক্ষণ নেই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাটির বৈশিষ্ট্যের গুণে বগ পিপল মমিতে যোগ হয়েছে আরো বেশ কিছু দুর্লভ রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ, যা দেহ সংরক্ষণে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা। বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই মাটিতে সঞ্চিত রয়েছে প্রচুর পরিমাণ লৌহ, উদ্ভিজ্জ, খনিজ এসিড এবং অক্সিজেন। ব্যাপক আয়োজন সত্তে¡ও এই মাটির অভ্যন্তর থেকে উদ্ধারকৃত মৃতদেহ বা অন্যান্য বস্তু নষ্ট হয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে অনেক।
কার্নেগি মিউজিয়ামে রক্ষিত সাতটি মমির মধ্যে কমবয়সী এক বালিকার লাশ রয়েছে। যা তিন হাজার তিনশ’ ত্রিশ বছরের পুরনো। এই টিনএজারের দেহটি শতবর্ষ আগে নেদারল্যান্ডসের একটি জলার জমাটবদ্ধ কাদামাটির অভ্যন্তর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দেহটি পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ধারণা মেলে যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তার গলা ও ঘাড়ে রশি পেচে বসার চিহ্ন এখনো বর্তমান। কে এই তরুণী? কে তাকে হত্যা করেছে এবং কেনো তাকে হত্যা করা হয়েছে? তাকে হত্যার পেছনের কারণ কি কোনো অনৈতিক আচরণ না সামাজিক কোনো আচার অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ? এসব নিয়ে নানান কৌত‚হল আর জিজ্ঞাসা সবার মনে। এই ঘটনা আরেকটি ধারণাকেও দৃঢ় করে যে, এটা উত্তর পশ্চিম ইউরোপে প্রাচীনকালে ধর্মীয় আচারের অংশ হিসেবে মানুষ বলি দেয়ার ইতিহাসের অংশ হতে পারে। ইউরোপের ওই অংশে অতীতে ধর্মের নামে মানুষ বলি দেয়ার বিষয়টি প্রত্নতত্ত্ব ও ফরেনসিক গবেষণায় এরই মধ্যে অনেকটা প্রতিষ্ঠা পেলেও বিতর্কও রয়েছে প্রচুর। বিস্তর আলোচনা গবেষণার পরও এ বিতর্কের সমাধান হয়নি।
মিউজিয়ামে রক্ষিত আরেকটি মমি সর্বসাধারণের জন্য এখনো প্রদর্শিত হয়নি। ‘টোলাড ম্যান’ নামে পরিচিত পুরুষের এই দেহটি পঞ্চান্ন বছর আগে ডেনমার্কে পাওয়া যায়। এটির গায়ের চামড়া ধূসর সিলভার। দেখে মনে হয় সিসা দিয়ে এটি মোড়ানো ছিলো। দেহগুলো উদ্ধারের সময় এগুলোকে পাওয়া যায় একেবারে অস্থিচর্মসার অবস্থায়। অনেক দেহেরই কঙ্কাল ছাড়া অন্য কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রচণ্ড চাপে থাকার কারণেই হয়তো এগুলোর অবস্থা এমনটা হয়ে থাকে। আর উদ্ধারের পর এগুলো সংরক্ষণের জন্য যথোচিত পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্রমেই তা হয়ে পড়ে আরো বিবর্ণ ও ক্ষীণকায়।
মিউজিয়মে দু’হাজার বছরের পুরনো দু’টো মৃতদেহ উদ্ধারের সময় যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো সে অবস্থায়ই প্রদর্শিত হয়েছে। এগুলোর চুলের রং লাল, থুতনিতে দাড়ি এবং ঘাড়ের কাছ থেকে লম্বালম্বিভাবে কাটা দাগ। ধারণা করা হয় এদের একটি পুরুষ, অপরটি মহিলা। একজনের বুকের মাঝখানে রয়েছে বেশ বড় আকারের একটি গর্ত আবার অনেকের ধারণা উভয়েই পুরুষ। বগ মানুষের পাকস্থলি ও কোমল দেহকলার উপস্থিতি থেকে আদিম ইউরোপীয়দের সম্পর্কেও একটা ধারণা মেলে। আবার কোনো কোনো দেহের আলামত থেকে ধারাণা করা হয়, এদের হত্যা করা হয়েছে। সেটা অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার শাস্তি বা কোনো হামলার কারণে হতে পারে। আবার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে বলির শিকার হওয়াও বিচিত্র নয়। এরকম প্রায় তিনশ’ দৃষ্টান্ত রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে মমির সঙ্গে মুদ্রা, অলংকার বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন জিনিস পাওয়া গেছে। এ থেকে ধর্মীয় আচার হিসেবে বলি দেয়ার ধারণাটিই বাস্তব ভিত্তি পায়।
প্রাচীন ইউরোপীয়রা তাদের প্রভু হিসেবে প্রকৃতিকেই মনে করতো। সে হিসাবে তারা বিভিন্ন নদী, লেক এবং কাদাপূর্ণ জলাশয়কে প্রভুর আর্শীবাদপুষ্ট স্থান হিসেবে গণ্য করতো। এজন্য নির্দিষ্ট কিছু স্থান যেমন অন্ধকার কোনো গুহা, কুয়াশাচ্ছন্ন জলাশয়ে প্রভুকে খুশি করার জন্য মানুষ বলি দেয়া হতো। তারা বিশ্বাস করতো এসব স্থানে প্রভুর বিশেষ কৃপাদৃষ্টি রয়েছে। আর মানুষের কোনো আচার আচরণে অখুশি প্রভু তাদের নরবলির মাধ্যমে খুশি হলে ভূমির উর্বরতা বাড়ার পাশাপাশি তাদের শস্যভান্ডার সমৃদ্ধ হবে এমন ধারণা ও বিশ্বাস ছিলো মানুষের।
যা হোক জাদুঘরে রাখা বগ মানবের মমি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। উত্তর পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের সম্ভাব্য বিভিন্ন আদিম জলাশয়, যা আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেগুলোর অসুন্ধান চলছে। তারপরও বগ মানব নিয়ে রয়ে গেছে ব্যাপক কৌতূহল।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।