অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কৌটাটি কিসের?

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০২:৪৩ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২১ মঙ্গলবার

আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ মোজাম্বিক। যদি কখনও সেখানে বেড়াতে যান, তবে দেখবেন, এখানে-ওখানে ছেলে বুড়ো সবাই নানান আকারের গোলগাল, চ্যাপ্টা কিছু কৌটা ঘিরে রয়েছে। স্বেছাসেবকরা বলছেন, এগুলো সবসময় এড়িয়ে চলবেন। ভুলেও পা দিয়েছেন তো, মরছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তাই জাতিসংঘ সৈন্য এখন পাহারায় কাজ করছে। 

তো, কৌটার মতো এই জিনিসগুলো আসলে কী? জী হ্যাঁ। এগুলো বিষের কৌটা। মাটির তলার মৃত্যুবীজ। স্থলমাইন নামে পরিচিত। পুরো নাম অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন। সংক্ষেপে এপিএম। যার মধ্যে রয়েছে ডেটোনেটিং ডিভাইস। কোনটিতে ব্যবহৃত হয় টিএনটি বা ট্রাইনাইট্রো টলুইন, কোনটি আবার প্লাস্টিক অ্যাক্সপ্লোসিভ। বাইরের আবরনের বা কন্টেইনারের কোনটি ধাতব, কোনটি আবার সিরামিক বা কাঠের হয়ে থাকে। হাল্কা স্পর্শে বা চাপে এগুলো বিস্ফোরিত হয়। চরমপন্থী আইএস জঙ্গিরাও বর্তমানে এতো আধুনিকভাবে স্থলমাইন ব্যবহার করছে যা ব্লুটুথ, শব্দ তরঙ্গ বা চৌম্বক তরঙ্গের সাহায্যেও ফাটানো যায়।

কৌটার ভিতরের মালামাল আর প্রয়োগের ভিত্তিতে স্থল মাইনের বিভিন্ন রকম নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন- ল্যান্ড মাইন, নেভিমাইন, সাবমেরিন মাইন ইত্যাদি বাহারি নাম। এগুলো দেখতে যতো সুন্দরই হোক না কেনো, মাইন কিন্তু ভালো-মন্দ, শত্রু-মিত্র, সময়-অসময় কিছুই তোয়াক্কা করে না। শুধু অপেক্ষা করে, কবে বিস্ফোরিত হবে। যুদ্ধের সময় শত্রুর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে মাইন পাতা হলেও শত্রু এর পাল্লায় কমই আসে। বরং যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ঘুমিয়ে থাকা ভূমি মাইনে পা দিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষ আহত হয়ে মারা যায়। কম্বোডিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামগুলোর এখানে-সেখানে লাল খুলি আঁকা বিপদ সংকেত লাগানো রয়েছে। যার অর্থ ‘এখানে মাইন পাতা রয়েছে। সাবধান।’ আফগানিস্তান আর ইরাকের মাটিতে ইটের টুকরোর মতো লাখ লাখ মাইন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এখনো সেগুলো অপসারণের কাজ চলছে।

এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্ব নামক নীল এই গ্রহের বুকে বর্তমানে সক্রিয় মাইন লুকানো রয়েছে সাড়ে তিন’শ মিলিয়ন বা পঁয়ত্রিশ কোটি। উত্তর পূর্ব এশিয়ায় দুই কোটির মতো আর আফ্রিকা, মিশর, অ্যাঙ্গোলা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রয়েছে তেত্রিশ কোটিরও বেশি। মুশকিল হলো এগুলোর অবস্থান শনাক্ত করা। অপসারণ করা তো দূরূহ এবং ঝুকিপূর্ণ কাজ বটেই। প্রযুক্তিগতভাবেও এক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে এখনও। মাইন ডিটেক্টরের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বর্তমানে ধাতব কন্টেইনারে মাইন তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া মাইন অপসারণের খরচও কিন্তু কম নয়। সারাবিশ্বে এ মুহুর্তে যতগুলো এপিএম পাতা রয়েছে সেগুলো সরাতে সর্বনিম্ন খরচ পড়বে এক লাখ এক চল্লিশ হাজার পাঁচ’শ সত্তর কোটি টাকারও বেশি। 

বিপুল সংখ্যক এসব মৃত্যুবীজ প্রতিদিন শত শত লোকের প্রাণহানি ও অঙ্গহানির কারণ হচ্ছে। তাই শান্তিকামী মানুষ আজ প্রত্যাশা করছে, বিশ্বের বুকে অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন- এপিএম বলতে কিছু আর থাকবে না। থাকবে কেবল জাদুঘরে। মানুষের বর্বরতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ভয় হয়, পারমাণবিক বোমার মতো সর্বনাশা অস্ত্র নিয়ে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ যেখানে মানুষ নিতে পারেনি, তুচ্ছ এই মাইন কি তাদের কাছে আদৌ গুরুত্ব পাবে? উত্তর দিতে পারে কেবল আগামী পৃথিবী।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।