তিন কিশোরযোদ্ধার সেই ছবি, একজন আব্দুল খালেক ও তার গল্প
লেখা ও ছবি: কমল দাশ
প্রকাশিত: ১২:১৮ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ১২:৩২ পিএম, ২৬ মার্চ ২০২১ শুক্রবার
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক ও তার গল্প
চট্টগ্রাম মহানগরীর সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিটির পাশের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেছি বহুদূর। গন্তব্য একজন বীর যোদ্ধার পবিত্র বাসস্থান তার নাম আব্দুল খালেক। একটি জীর্ন বাড়িতে থাকেন খালেকুজ্জামান। অটবির ব্র্যান্ড এ্যাম্বেসেডার। একসময় স্কুলে স্কুলে একাত্তরের বীরত্বের কথা শুনাতেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক।
এই তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার এলাসিন ইউনিয়নের মুশুরিয়া গ্রামে। ছবিতে যে কিশোরকে গ্রেনেড ছুড়তে দেখা যাচ্ছে, তার নাম আব্দুল খালেক। মাঝে রাইফেল হাতে আব্দুল মজিদ। বাঁয়ে মজিবর রহমান। প্রায় সমবয়সী তিন কিশোরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেই ছবিটি বহুল প্রচারিত। তাদের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক ছিলেন সবচেয়ে বেশি আলোচিত। খালেক, মজিদ ও মজিবর প্রায় সমবয়সী। তখন ১৩-১৪ বছরের কিশোর ওরা। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা পান।
সেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মুশুরিয়া গ্রামের মৃত হযরত আলী ও রূপজানের ছেলে। মজিবর রহমান ওই গ্রামের মৃত মনসের আলী ও মৃত সখিনা বেগমের সন্তান। আব্দুল মজিদও একই গ্রামের মৃত সলিম উদ্দিন ও সোনাবানুর সন্তান। ছবিতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে একজন লক্ষ্যবস্তুতে গ্রেনেড ছুঁড়ছেন। পাশে দুজন একই লক্ষ্যবস্তু দিকে বন্দুক তাক করে গুলি ছুঁড়ছেন। এটি কেবলই একটি ছবি নয়। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মারক হয়ে উঠেছে ছবিটি।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোধূলিলগ্নে ময়মনসিংহের সম্ভুগঞ্জে পাকসেনাদের একটি শক্ত ঘাঁটির বাংকার ধ্বংসের চিত্রটি ফ্রেমে আটকান মানিকগঞ্জের নাইব উদ্দিন নামের একজন ফটোগ্রাফার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই তিন বীরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ছবিটি প্রকাশের পর স্বজনরা জানতে পারে তারা বেঁচে আছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে এই তিন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার ছবিটি অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অধিকাংশ পোস্টার-কার্ড, ফেসটুন, ব্যানারসহ পাঠ্যবইয়ের গল্পের প্রচ্ছদেও ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই তিন বীরের পরিচয় ও দুঃসাহসিকতা অনেকেরই অজানা বা তাঁদের খোঁজ ক’জইন জানে?
মজিবর রহমানকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে রিকশা চালাতে হয়েছে। আরেকজন কখনো কারখানার শ্রমিক কখনো বা নৌকার মাঝি হয়ে জীবিকার সংস্থান করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে তাদের ভাগ্যে জোটেনি বাড়তি কোনো সম্মাননা। তিনজনের মধ্যে দুজনই দীর্ঘ সময়ে পাননি সম্মানজনক কোনো উপার্জনের উৎস।
এই প্রতিবেদককে কাছে পেয়ে দেখালেন অনেক পোষ্টার রাষ্ট্রীয়ভাবে ছাপা এসব পোস্টারে তারই ছবি। ভারতে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিলেন খালেকুজ্জামান। শিখলেন উড়ন্ত গ্রেনেড কী করে হাতে ধরে ফেলা যায়। আরো সব প্রশিক্ষণ ময়মনসিংহের সীমান্ত এলাকার পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলো একের পর এক উড়িয়ে দিয়েছেন।
“এখনো আমার হাতের রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়ে চলন্ত বিমান ধ্বংস করতে পারবো আমি,” অপরাজেয়বাংলাকে বললেন এই বীর মুক্তিসেনা।
কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করলেন ভারতীয় সেনাদের। কমান্ডার এস কে দাস, কে এল দাসসহ অনেক যোদ্ধদের। সরল বিশ্বাসে বলেন, “আমাদের যেন মশা না কামড়ায়, পেট ভরে ভাত খেলাম কিনা- তারও খবর তারা রাখতেন। এতো যত্ন করতেন তারা।
২৫ বছর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এবং সীতাকুন্ডের থানা নির্বাহী অফিসারের সহযোগিতায় ভাটিয়ারীতে ১০ শতক জায়গায় একটি ছোট্ট ঘর বেঁধেছিলেন খালেক। সাদা মনের মানুষ এই আব্দুল খালেক। দেশপ্রেম হৃদয়জুড়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে প্রচার পেতে তার প্রবল অনীহা। সংসার যে সচ্ছল নয়, এরই সাক্ষী তার ভাঙা বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করে বাচঁতে তার মন কখনো সায় দেয় না, জানালেন।
তবে দেশে আটকে পড়া বিহারিদের উপর ক্ষোভটা এখনো রয়ে গেছে। বললেন , “এখনো পাহাড়তলী ঝাউতলা বিহারি কলোনি গেলে আমার বুকের ভেতর থেকে ঘেন্না উঠে আসে। এই দেশের নিরীহ মানুষদের রক্তে যারা গোসল করেছে- তাদের জন্যে বিদ্যুৎ, গ্যাস, বাসস্থান, সব ফ্রি কেন? তারা তো আজো বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধের কোন ছবি তাদের ঘরে রাখেনা। কাছাকাছি কোন বাজার না থাকায় আমাকে কেনা কাটা করতে তাদের বাজারে যেতে হয়। কথায় কথায় আমাদের এখনো অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয় এরা। সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি- হয় এদের (পাকিস্তানী বিহারিদের) ফেরত পাঠান না হয় আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলেন। আমরা তো বোনাস বেঁচে আছি। ”
আরো আক্ষেপ করে বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাবার কোনো সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, "মৃত্যুর আগে একবার হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই।"
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সন্ত্রাসীদের অবৈধ দখলে থাকা তার ভিটেটি কোনদিন উদ্ধার হবে কিনা জানেন না তিনি। নিজের ভিটেয় আদৌ ফিরে যেতে পারবেন কিনা তাও জানেন না।
অটবির কর্ণধার অনিমেষ কুন্ডুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আবদুল খালেক। বলেন, “আমাকে তিনি স্যার সম্বোধনে কথা বলেন। আমি তাকে স্যার বললে তিনি রাগ করেন। তার কারণেই নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার একটি সুযোগ আমি পেয়েছি তখন।”
এদেশে অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তি থাকলেও একজন অন্তত বিনম্র শ্রদ্ধায় এই বীর যোদ্ধাকে নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে গেছেন।
চট্টগ্রামের ফয়েজ লেক এলাকায় কয়েকশ’ গাছ লাগিয়েছেন আবদুল খালেক। মানব প্রেম এবং বৃক্ষ প্রেম তার ব্রত। তিনি বলেন,“ জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” তবে ব্যক্তি খালেক স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি।