প্রকৃতিকে ধ্বংস করেই অগ্রগতির হিসাব কষছি, আর নয়
ক্লাইমেট ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:৫৩ পিএম, ২২ মার্চ ২০২১ সোমবার আপডেট: ০৩:৩৩ পিএম, ২২ মার্চ ২০২১ সোমবার
প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে। ছবি: গেটি ইমেজ থেকে
বিশ্বজুড়ে মানবকুলের স্বাস্থ্য নিয়ে কম কথা হয় না। কিন্তু খোদ পৃথিবী নামের গ্রহটির স্বাস্থ্য নিয়েও তো ভাবতে হচ্ছে। সে ভাবনা যে একেবারেই ভাবা হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, এতদিন যেভাবে ভেবেছেন সেভাবে আর ভাবলে চলবে না। বরং মানবতার ভাবনায় বড় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
"মেকিং পিস উইথ নেচার" নামে ১৬৮ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটিতে ধরিত্রিতে চলমান জলবায়ু ও মানবতার যুদ্ধের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সম্পদ ও নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই আমাদের প্রাকৃতিক মূলধনকে মূল্য দিতে শিখতে হবে। আমাদের ভূমি, বায়ু, পানি এসবের কথা ভাবতে হবে। আর তা জরুরিভিত্তিতেই ভাবতে হবে।
অনেক বছর ধরে আমরা প্রকৃতি নিয়ে এক নির্বোধ ও আত্মঘাতি লড়াই লড়ে চলেছি, বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। নতুন প্রতিবেদনটি উপস্থাপনকালে তিনি এই উক্তি করেন।
"এর ফরে তিনটি পারষ্পরিক সংযুক্ত পরিবেশ সঙ্কট ঘটেছে: জলবায়ু ব্যহতকরণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও দুষণ। যা সরাসরি হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে প্রজাতি হিসেবে মানবকূলের টিকে থাকাকেই," বলেন গুঁতেরেস।
"আমরা ধরিত্রির ক্ষতি করছি, আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য ও সম্মৃদ্ধিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে" এমনটা বলছিলেন জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি-ইউএনইপি'র নির্বাহী পরিচালক ইংগার এন্ডারসেন। ইউএনইপি-ই এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বস্তুত ধরিত্রিকে সুরক্ষ দিতে বিশ্ব তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ধারে কাছেও নেই। প্রাণিকূলের নানা প্রজাতি আর তার সঙ্গে তাদের প্রাণহীন পরিপার্শ্বের পারষ্পরিক ক্রিয়া অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দ্রুততায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এর সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতি অনেক আগে থেকেই দিয়ে আসছেন বিশ্বনেতারা। প্যারিস চুক্তিতে নেতারা যে বিশ্ব উষ্ণায়ন সীমিতকরণের অঙ্গিকার করেছিলেন তা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছেন।
বর্তমান হারে বাড়তে থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ, কিংবা তার আগেই এই উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে দাঁড়াবে। আর এ পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ ও জাতীয় নীতিমালা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো মেনে নিলও ২১০০ সাল নাগায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে।
মানবতা এরই মধ্যে এ জন্য তিক্ত মূল্য দিতে শুরু করেছে। কেবল যে আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন, তা নয়, এই প্রতিবেদন মতে, বিশ্বজুড়ে আজ যত রোগভোগ তার এক চতুর্থাংশই এই পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বুনোপ্রাণিকুল তার নিজস্ব বাসস্থান হারিয়ে যত মানুষের সংস্পর্শে এসে যাচ্ছে, এই রোগ ততই বেড়ে চলেছে। ঠিক যেমনটা ঘটেছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ক্ষেত্রে। ভাবাই হচ্ছে- এই রোগের উৎপত্তি বাদুর থেকে। আরও রয়েছে বিষাক্ত সব আবর্জনাময় পরিবেশ। স্রেফ দুষণের কারণে, প্রতি বছর ৯০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়, বলছে প্রতিবেদনটি।
বিশ্ব যখন একটি মহামারির মধ্য দিয়ে গেলো এবং কিছুটা হলেও পুনআবির্ভাবে পথ দেখতে শুরু করেছে তখন এই সব কিছু পাল্টে দেওয়ার সময় এসে গেছে। সরকারগুলো তাদের পুনরুত্থানের পথ খুঁজতে নতুন নতুন অর্থনৈতিক নীতি নিচ্ছে। তাতে করে আবারও তাদের মাথা থেকে সরে যেতে পারে ধরিত্রিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু সমাজকে কিভাবে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে হবে তার শিক্ষাও আমারা এই কোভিড-১৯ থেকে পেয়েছি।
প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। যা সরকার থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিমানব, সকলের জন্য প্রযোজ্য। তবে এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নতুন পথ বাতলে দেওয়া। যা মূলে রয়েছে পরিবেশ ও বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ে সভ্যতার মাপকাঠি থেকে চিন্তা করা।
বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক ও আর্থিক ব্যবস্থাগুলো বস্তুত প্রকৃতি থেকে মানবতা যে সুবিধা পায় তা মেপে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এর মূল্য যাচাইয়েও ভুল করেছে। সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)র মাত্রাকে উন্নয়নের মাপকাঠী হিসেবে ধরে নেওয়ার গতানুগতিক ধারা বরাবরই অগ্রগতির ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখিয়ে আসছে। কারণ এই সব উন্নয়ন প্রাকৃতিক মূলধনের কতটা ক্ষতিসাধন করেছে, এবং তার মূল্য নির্ধারণে ব্যর্থ ছিলো এই প্রক্রিয়া। মানবতা যদি আমাদের পরিবেশের মূল্য ধরতে শুরু করে-- এবং আমাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাহীনতার মূল্যও যদি নির্ধারণ করা যায়-- আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ভিন্ন হতে বাধ্য, বলছে জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন।
প্রকৃতির মূল্যকে যখন ধর্তব্যেই নেওয়া হয়না তখন প্রকৃতি সংরক্ষণ, দুষণ রোধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তার, আর সম্পদের টেকসই ব্যবহার বিষয়ক উদ্যোগে অর্থায়ন কমে যায়। বিষয়টিকে গুতেরেস বলেছেন এভাবে, "মনোজতে এই পরিবর্তন কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা তুলে ধরতে একটি উদাহরণ দিচ্ছি- এমনকি আমরা যে পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক নীতি ও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান তৈরি করছি, তাতে আমরা বেশি বেশি মাছ ধরা পড়লে তাকেও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে যোগ করি। বস্তুত আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেই অধিকতর সম্পদের হিসাব কষছি।"