বিহারে বড় পরীক্ষা
পলাশ মাহবুব
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৪:৪৬ পিএম, ২৮ অক্টোবর ২০২০ বুধবার
ভোট সমীক্ষার কয়েকটি যদিও প্রথম দিকে বলছিলো বিহারে নীতিশ কুমারের সরকার টিকে যাবে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর সেই হাওয়া বদলাতে থাকে দিন দিন। বিরোধীদের মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদবের সমাবেশে যেভাবে মানুষের উপচে পড়া ভীড় হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে রাজ্যে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা প্রবল। পরিবর্তন মানে বিহারের বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ক্ষমতাসীন জেডিইউ (জনতা দল ইউনাইটেড) ক্ষমতায় ফিরতে পারছে না। যারা কিনা বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়ন্সে) জোটের শরিক।
কিন্তু বিজেপি তার জোটকে আবারও বিহারের ক্ষমতায় আনতে মরিয়া। সেই সঙ্গে তারা বিহারে তাদের নিজস্ব অবস্থানকে আরও পোক্ত করতে চায়। বিহার বিধানসভায় আসনের দিক দিয়ে বিজেপি’র চেয়ে এগিয়ে তাদের জোট শরিক জেডিইউ। বিজেপি চাইছে এবারের নির্বাচনে নিজেদের আসন সংখ্যা যদ্দূর সম্ভব বাড়িয়ে নিতে। তাদের সেই মরিয়া চেষ্টার প্রতিফলন দেখা যায় বিহারের সন্তান বলিউড তারকা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের রহস্যজনক মৃত্যু পরবর্তী কার্যকলাপে। সুশান্তের মৃত্যু রহস্যের তদন্তকে রাজনীতিকরণের অভিযোগ করেছে কংগ্রেস, আরজেডি (রাষ্ট্রীয় জনতা দল) সহ বিহারের অন্যান্য বিরোধী দল। তাদের অভিযোগ, সুশান্তকে ঘিরে বিহারের মানুষের যে আবেগ তা নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি।
বিরোধীদের অভিযোগ বিজেপি মুখে স্বীকার না করলেও তারা যে ভোটের মাঠে সুশান্ত ইস্যু ব্যবহার করবে তা অনেকটা পরিষ্কার হয় যখন বিজেপি’র পক্ষ থেকে বিহারের ভোটের দায়িত্ব দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় দেবেন্দ্র ফাডনবিসকে। এই দেবেন্দ্র ফাডনবিস মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মুম্বাই হচ্ছে মহারাষ্ট্রের একটি শহর। যে মুম্বাইয়ে বলিউড অভিনেতা সুশান্তের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এবং সুশান্তের মৃত্যুর পর এর তদন্ত নিয়ে মুম্বাই পুলিশের ভূমিকাকে বিজেপি’র তরফ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। সেই চেষ্টা অনেকটা সফলও হয়েছে বলা যায়। কারণ মামলার তদন্তভার মুম্বাই পুলিশের হাত থেকে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশননের (সিবিআই) কাছে চলে গেছে। সিবিআই-এর নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রিয় সরকারের হাতে।
মহারাষ্ট্রে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে কংগ্রেস-এনসিপি-শিবসেনা জোট। নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েও ক্ষমতায় যেতে পারেনি বিজেপি। তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র শিবসেনা বিজেপি জোট ছেড়ে বেড়িয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দল কংগ্রেস আর এনসিপি’র সাথে হাত মিলিয়েছে শুধুমাত্র মূখ্যমন্ত্রী পদ পাওয়ার জন্য। শিবসেনার এমন ভূমিকা ভালোভাবে নেয়নি বিজেপি।
রাজ্যের বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী শিবসেনা প্রধান উদ্ভব ঠাকরে। তার ছেলে আদিত্য ঠাকরে রাজ্যের মন্ত্রী। এই আদিত্য ঠাকরের বিরুদ্ধে সুশান্ত সিং কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। অন্যদিকে বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত শুরু থেকেই শিবসেনা তথা মহারাষ্ট্র সরকার এবং মুম্বাই পুলিশকে এই ইস্যুতে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন। কঙ্গনা সরাসরি বিজেপির রাজনীতি না করলেও তিনি বিজেপি ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। এবং বিরোধীদের অভিযোগ আছে, বিজেপির হয়ে কাজ করছেন কঙ্গনা। সব মিলিয়ে সুশান্ত সিং-এর ইস্যুকে বিহারের ভোটে কাজে লাগাতে চায় বিজেপি। যে কারণে দেবেন্দ্র ফাডনবিসের মতো মহারাষ্ট্রের একজন শীর্ষ নেতাকে বিহার ভোটের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যিনি সুশান্ত সিং কেসে মহারাষ্ট্র সরকারের ‘অবহেলা’কে বিহারের মানুষের সামনে ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন।
তবে শুধু সুশান্তের আবেগকে ব্যবহার করে জেডিইউ-বিজেপি জোট কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বিহারের পিছিয়ে পড়া অর্থনীতি, বন্যা এবং করোনা মোকাবেলায় রাজ্য সরকারের বড় রকমের ব্যর্থতাসহ আরও বেশ কিছু মোটা দাগের ব্যর্থতার অভিযোগ আছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন জেডিইউ-বিজেপি জোটের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে এনডিএ জোটের সবচেয়ে বড় দল বিজেপি ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন। তাদের বিরুদ্ধেরও অভিযোগের নানা আঙ্গুল। দেশজুড়ে সঠিকভাবে করোনা মোকাবেলা করতে না পারার অভিযোগতো লাগাতার করে যাচ্ছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে দেশটির জিডিপিতে স্মরণকালের ধ্বস নেমেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদ্য পাস হওয়া ‘কৃষক বিল’। এই বিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিরোধী দলগুলো ভারতজুড়ে তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেছে। বিজেপির দীর্ঘদিনের মিত্র অনেক দল, যারা এনডিএ জোটে আছে তারাও অবস্থান নিয়েছে এই বিলের বিরুদ্ধে। শরিক দলের একজন মন্ত্রী তো নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভা থেকেও পদত্যাগ করেছেন এই ইস্যুতে।
সবকিছু মিলিয়ে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ভারতের কোনও রাজ্যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেটি বিহার। সেখানে শুধু সুশান্ত সিং রাজপুতের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কতোটা সফল হবে বিজেপি জোট তা নিয়ে শংকা অমূলক নয়।
অন্যদিকে বর্তমান সময়ের নানা সমীক্ষায় বিহারের সবচেয়ে বড় দল ভাবা হচ্ছে লালু প্রসাদের আরজেডি’ কে। সমীক্ষাগুলো বলছে এবারের বিহার নির্বাচনে এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন পাবে আরজেডি। এই আরজেডি আবার কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ এলায়েন্স) জোটের সদস্য।
ওদিকে অতীতের মতো কংগ্রেসও আর হালকা চালে নেই। বিহারে নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করতে চেষ্টা করছে তারা। যতটা সম্ভব নিজেদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নিতে মরিয়া কংগ্রেস। আর সমীক্ষা অনুযায়ী আরজেডি এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন পেলেও ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে তারা। সেজন্য কংগ্রেসকে প্রয়োজন হবে তাদের। এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে আসন ভাগাভাগিতে দর কষাকষি জারি রেখেছে কংগ্রেস। একইসঙ্গে সিপিএম, সিপিআই-এর মতো কিছু দলকেও ইউপিএ জোটে টানতে চাইছে কংগ্রেস। বিহারের রাজনীতিতে সিপিআই, সিপিএম অতোটা প্রভাবশালী না হলেও সিপিআই-এর তরুণ নেতা জহওরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি কানাইয়া কুমারের বেশ প্রভাব আছে রাজ্যে। সেই কানাইয়া কুমারকেও ভোটের প্রচারে কাজে লাগাতে চাইছে কংগ্রেস।
তবে দর কষাকষি নিয়ে বাহাস হলেও আরজেডি-কংগ্রেস জোট যে ভাঙবে না তা অনেকটা নিশ্চিত। কারণ ‘বিজেপি’ হঠাও নীতিতে দল দুটি অনেক আগে থেকেই একজোট। তাছাড়া আরজেডি সুপ্রিমো লালু প্রসাদ যাদব পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। পশুখাদ্য দুর্নীতি মামলায় তিনি অনেকদিন ধরে জেলে। জেলে বসেই ভোটের কৌশল ঠিক করছেন পোড় খাওয়া এই নেতা। এই নির্বাচনের সঙ্গে তার জেলে থাকা না থাকার ব্যাপারটিও নির্ভর করছে। ফলে আরজেডিও চাইছে যেকোনও মূল্যে বিহারের ক্ষমতায় ফিরতে। আর ক্ষমতায় ফিরতে হলে কংগ্রেসকে তাদের লাগবেই।
সবকিছুই মিলিয়ে অনেক হিসাবের ফল পাওয়া যাবে বিহার নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। এই নির্বাচনে ভারত জুড়ে নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক প্রভাবের তাপমাত্রাও আঁচ করা যাবে। যদিও নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত চারটি প্রদেশের নির্বাচন হয়েছে। যার একটিতে মাত্র ক্ষমতায় আসতে পেরেছে বিজেপি।
কোন পথে হাঁটবে বিহার? জানা যাবে ১০ নভেম্বর, নির্বাচনের ফল ঘোষণার দিন।
পলাশ মাহবুব: কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার।